সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইফরিত


মোহাম্মদপুরের এক ভীষণ ব্যস্ত সড়কের পাশে আমাদের দুই বেড-ড্রয়িং-ডাইনিং এর ভাড়া বাসা। বাসাটা যখন নেয়া হয় তখন আমি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। এই এলাকায় ভাড়া তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সদ্য তোলা বাড়ি আর তমালের অফিসও কাছেই হয় তাই ভাবলাম - এই ভালো।

বাসায় উঠে গোছগাছ তখনো সারিনি। এক মাস গেছে কি যায়নি তখন থেকে সমস্যাটার শুরু। তমাল অফিস করে ফিরতে রাত নয়টা দশটা বাজত। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও সময় নিত না। আমি কোনদিন ওর সাথে শুয়ে পড়তাম, কোনদিন গল্পের বই পড়তাম অথবা ডায়েরি লিখতাম। এক রাতে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে কিছু একটা পড়ছি হঠাৎ দরজায় টোকা দেয়ার মতো আওয়াজ পেলাম। আমার কান খুব খাড়া। আওয়াজটা বাইরের ঘর থেকে এসেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাত্রি একটার সময় কে বড় দরজায় টোকা দিবে? পড়ায় মন ফিরিয়েছি মিনিটও হয়নি আবার... নক নক। খুব স্পষ্ট আওয়াজ। ভাবলাম সত্যিই বুঝি কেউ এসেছে। রাত হয়েছে বলে কলিং বেল টিপছে না। উঠে গিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রাখলাম। সারারাত বাহিরের আলো জ্বলত। কাউকে দেখলাম না। ঘরে ফিরে আসার কিছক্ষণের মধ্যেই আবার... নক নক। এবার আর দেখতে গেলাম না। দরকার হয় বেল বাজাবে। শীত করছিল। আলো নিভিয়ে তমালকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার পর আর আওয়াজ পেয়েছি কিনা মনে নাই। 

পরদিন সকাল থেকে আমার বমি বমি ভাব হচ্ছিল। সারাদিন একবারও মনে পড়েনি রাতের কথা।

পরের রাতে আমি তমালের সাথে সাথেই শুয়ে পড়েছি। আমার রাতে কয়েকবার বাথরুমে যেতে হোত। শোয়ার এক-দেড় ঘণ্টা পরে একবার উঠেছি। বাথরুম সেরে বেরিয়ে এক গ্লাস পানি খেলাম। আবার শুয়েছি অমনি... নক নক। খুব শান্তভাবে। ভাবলাম গত রাতেও তো এমন শব্দ পেয়েছি। ও কিছু না, কাঠপোকা। আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করতেই যেন আরেকবার খুব জোরে এবং অশান্তভাবে দরজায় টোকা পড়ল। একাধারে চারটা... ঠক ঠক ঠক ঠক। চমকে উঠলাম। মনে হলো আওয়াজটা যেন বাইরে থেকে নয়। বাসার ভেতরে কোথাও!

'তমাল ওঠো!' আমি ঝাকুনি দিয়ে তুললাম ওকে, কে যেন এসেছে দরজায়!'

তমাল ঘুম ঘুম চোখে বলল, কই?

তারপর ড্রয়িংরুমের আলো জ্বেলে পাজামার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে দরজার ফুটোয় চোখ রাখল। কাউকে না দেখে ছিটকিনি নামিয়ে বাইরে বেরল। কেউ নাই। তমাল সম্ভবত আমার গলার স্বরে কিছু একটা টের পেয়েছিল। বাইরেটা ভালোভাবে দেখে বলল, চলো ঘুমাই। সকালে দেখব। 

সকালে উঠে তমালকে সব খুলে বললাম। দুইদিন ধরে এরকম শুনছি তা-ও বললাম। মনের ভুল তো আর এতবার হতে পারে না। আমরা সন্দেহ করলাম যে কেউ শয়তানি করছে। ও অফিস যাওয়ার সময় দারোয়ানকে সেকথা বলে গেল। আমি ইন্টারকমে ফোন দিয়ে বাড়িওয়ালার বউকে জানালাম - আমাদের অসুবিধা হচ্ছে। ওনাকে আন্টি ডাকি। ভদ্রমহিলা একটু চিন্তিত হলেন। ফোন রাখার পর মনে হলো, উনি কী-ই বা করবেন। কাল রাতে একটু আচমকা ভয় পেয়েছিলাম। নাহলে হয়তো আন্টিকে বলতামও না। 

কিছুদিন পরে। আমি রান্নাঘরে কী ভাজি করছিলাম। তমাল অফিসে। হঠাৎ ড্রয়িংরুম থেকে টোকার আওয়াজ। বাইরের দরজার কাছাকাছি থাকায় এটুকু বুঝলাম যে টোকা দরজায় পড়েনি। অন্যকোথাও পড়েছে। তাও দরজার কাছে যাব অমনি আবার... নক নক নক। আমি আওয়াজ করে শিউরে উঠলাম। কারণ শব্দটা আসছে গেস্ট বাথরুমের ওপর ফলস ছাদের যে ছোট্ট দরজা আছে সেখান থেকে। স্পষ্ট টোকা দেয়ার আওয়াজ। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। আমি সাহস সঞ্চয় করলাম। নিশ্চয়ই এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। বাথরুমের দিকে কিছুটা এগোতেই আবার টোকা। এবার কিছুটা অশান্তভাবে। 

'কে?' আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। ফলসের দরজায় ছিটকিনি লাগান। কেউ যদি ভেতরে থেকে থাকে তাহলে বাইরে থেকে ঢুকেছে। কীভাবে? বাসার দেয়াল ভেঙে! 

আমার 'কে'-র জবাবে আবারো টোকা। যেটা কিছুক্ষণের মধ্যে দুমদাম ধাক্কায় পরিণত হলো। এবার আমি পুরোপুরি ঘাবড়ে গেলাম। কেউ থেকে থাকলে কথা বলছে না কেন - কে? কে??

উত্তর নাই। পাগলপ্রায় ধাক্কাধাক্কিতে একবার ভাবলাম চেয়ার টেনে ছিটকিনি খুলে দেখি। পরে ভাবলাম দরজা খোলার সাথে সাথে যদি কোনো অঘটনে নিচে পড়ে যাই তাহলে তো মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে।

ধাক্কিয়ে যখন দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম হলো তখন আমি ইন্টারকমে ফোন করে কেয়ারটেকারকে ডেকে আনলাম। বাসার দরজা খোলাই ছিল। সিঁড়িতে কেয়ারটেকার চাচার পায়ের আওয়াজ আসতে না আসতে অপ্রত্যাশিতভাবে সব বন্ধ হয়ে গেল। আমার পঁচিশ বছরের জীবনে এত অদ্ভুত ঘটনা আমি কখনো দেখিনি। চাচা টুল নিয়ে ফলসের দরজা খুললেন। আমরা পার হওয়ার পর একদিনও ফলস ছাদ খোলা হয়নি। উৎকট ঝাঁঝাল গন্ধ বেরল দরজা খোলার সাথে সাথে। ভেতরে জমাট অন্ধকার। চাচা মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বললেন ভিতরে পুরাতন খবরের কাগজ দলা পাকিয়ে আছে। আর কিছু নাই। 

ভাগ্যিস ওনাকে ধাক্কাধাক্কির কথা বলিনি। নির্ঘাৎ পাগল ভাবতেন। কেবল বলেছি, শব্দ আসছে। তাতেও উনি কম চিন্তিত হলেন না। শব্দ আসবে কোথা থেকে? 

যা হোক আমি তমালকে কিছু আর বলিনি। কারণ ঘটনাটা আমার নিজের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছিল না। দরজায় অমানুষিক ধাক্কাধাক্কি রাতের বেলাতেও চলল একটানা। প্রথমে নক দিয়ে শুরু হয়। তারপরে এক পর্যায়ে দরজা ভাঙার উপক্রম দেখা দেয়। এত আওয়াজেও তমাল নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে। তার মানে আওয়াজটা পুরোপুরি আমার মানসিক। ভাবলাম পাত্তা না দিলে চলে যাবে। আর সত্যি সত্যি চলেও গেল। 




scary cupboard এর ছবির ফলাফল




সেদিন সকালের ঘটনাটা নিশ্চিতভাবে আমার হেলুসিনেশন ছিল। গর্ভাবস্থায় এরকম হওয়াই কি স্বাভাবিক? তখন বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট ছিল না। নিজে থেকে ঘেঁটে কিছু বের করব তার উপায় নাই। কাউকে কিছু বললে পাগল ঠাওড়াবে। কখনো এরকম হয়নি আমার সাথে। গেস্ট বাথরুমে কোনো কারণে ঢুকলেই শুনতে পাই উপরের ফলস ছাদে নড়াচড়া, ভারী কিছু টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে। থালাবাসন ধুতে ধুতে মনে হয় পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরবেলা একটু শুলেই মনে হয় ফলসের দরজায় চাপড়ের আওয়াজ। আর সবচেয়ে ভয়াবহ যেটা ঘটে এসব তার কাছে কিছুই না। একা শোয়া অবস্থায় মাঝেমধ্যেই অনুভব করি আমার উপর ঝুঁকে এসে কেউ একজন আমাকে দেখছে। তার দুর্গন্ধযুক্ত নিশ্বাস আমার মুখের ওপর এসে পড়ে। তীব্র আতঙ্কে চোখ মেলতে পারিনা। তার হাঁটুর সাথে আমার হাঁটুর ঘষা লাগে। আমি আড়ষ্ট হয়ে পড়ে থাকি। কখন সে দূর হবে তার অপেক্ষায়। 

নিজেকে বুঝিয়েছি যে এসব আমার মনের ভুল। কোনো লাভ হয়নি। 

এক-দুই মাস এরকম চলার পর তমালকে বলেই ফেললাম। সর্বক্ষণ এই অস্বস্তি নিয়ে থাকা মুশকিল। ও খুব গুরুত্ব দিয়ে শুনল। বলল, এরকম তো হতে পারে। আগে কেন বলো নি? 

ড. নাসরিন আমাকে দেখতেন। তমাল আমাকে তার কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার খুব একটা পাত্তা দিলেন না। অডিটরি হেলুসিনেশন নাকি এই সময় হয়ে থাকে অনেকের। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, না। তবে ফলস ছাদে বাচ্চার হামাগুড়ি দেয়ার মতো থপথপ আওয়াজ পাই মাঝমধ্যে, সেটা জানালাম। উনি হাসলেন। তমালকে বললেন আমাকে আরো বেশি সময় দিতে। আর আমি যেন রাতে না জাগি সেটাও বললেন। তবে ঘুমের সমস্যা বেশি মাত্রায় না হলে ঘুমের ওষুধ খেতে নিষেধ করলেন।    

তমাল বাসায় ফিরে জিজ্ঞাসা করল আমি কি আম্মুর সাথে থাকতে চাই কিনা। বুঝলাম ও কিছুটা অনুতপ্ত। আমার খুব খারাপ লাগল তমালের জন্য। আম্মুর এখানে এসে থাকার কথা সেপ্টেম্বর থেকে। আমি বললাম আমি কোথাও যাব না। আমি ছোটবেলা থেকেই সাহসী আর যুক্তিবাদী। মনকে সাহস দিলাম। তাও মাঝে মাঝে রান্না করতে করতে মনে হোত আমি ছাড়া বাসায় আর একজন কেউ আছে। টিভি দেখতে দেখতে মনে হোত কে যেন পিছন দিয়ে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে চলে গেল চট করে। একদিন স্পষ্ট মনে হলো কালো কাপড় পরা কেউ একজন পর্দার পাশ ঘেঁষে হেঁটে গেল। আমি পিছন পিছন গেলাম। দেখি ফলস ছাদের দরজার চিপা দিয়ে একটা লম্বা কালো কাপড় সুড়ুত করে ভিতরে ঢুকে গেল। মনে হলো দরজাটা খোলা। প্রায়ই এমন মনে হোত। চশমা চোখে দিয়ে দেখতাম - নাহ, ছিটকিনি লাগানই আছে।  উপর থেকে মাঝে মাঝে উৎকট গন্ধ পেতাম। এটাও নাকি গর্ভাবস্থায় অস্বাভাবিক কিছু না। এক-একদিন ফ্যান ছেড়েও দুর্গন্ধ যেত না। আমি গন্ধে কয়েকবার বমি করেছি এমনও হয়েছে। 

একদিন সকালের কথা। আমার পেট তখন অনেক বড়। পেটের মধ্যে নড়াচড়াও সর্বক্ষণ টের পাই। পাশের বাসার আপুর সাথে গল্প করছিলাম। তমালের কথায় দুপুর পর্যন্ত ওই বাসাতেই থাকতাম। আপু কথাচ্ছলে বলল আশেপাশের কোন ফ্ল্যাট থেকে প্রায় সময় পচা দুর্গন্ধ আসে। এমনকি গত রাতেও এসেছে।

এ কথায় আমি চমকে উঠলাম। কারণ গত রাত আড়াইটা নাগাদ আমি বাথরুমে যাওয়ার সময় ফলস ছাদ থেকে কড়া দুর্গন্ধ বেরচ্ছিল। বাথরুমে গিয়ে আমি বমি করেছি। আপুকে জিজ্ঞাসা করলাম, কয়টার দিকে গন্ধ পেয়েছেন?

'রাত আড়াইটা তিনটা এরকম হবে। তোমার দুলাভাই পানি খেতে উঠেছিল। আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। এমন সময় পচা গন্ধ। বমি করে দেয়ার উপক্রম। সব জানালা আটকে তারপর রক্ষা। এই গরমে জানালা আটকে থাকা যায়?'

'মাঝেই মাঝেই পান? মাংস পচা গন্ধ?'

'হ্যা ঠিক বলেছ। মাংস পচা গন্ধ। মাঝেই মাঝেই পাই। তুমিও পাও নাকি?'

বললাম, হ্যা। কিন্তু গন্ধ যে আমার বাসা থেকে আসে সে কথা বললাম না। 

তমাল দুপুরেই বাসায় চলে আসে অনেকদিন যাবৎ। পথে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনে। বাইরের খাবারের প্রতি এখন আমার এতটা লোভ হয়েছে যে কী বলব। সেদিন খেতে বসে তমালকে গন্ধের কথাটা বললাম। বললাম যে পাশের বাসার ভাড়াটিয়ারাও গন্ধ পায়। ও খেতে খেতে কিছু বলল না। খাওয়া শেষে বলল ফলস ছাদে কী আছে খুলে দেখবে। আমি আপত্তি করলাম। কারণ আমি জানি সেখানে কিছুই নাই। আর যদি বিপজ্জনক কিছু থাকে? তমালকে বললাম শুক্রবার ছুটির দিনে খুলে দেখা যাবে। এখন খুললে যদি দুর্গন্ধ আরো বাড়ে তখন কী হবে? 

'তাই বলে গন্ধ নিয়ে থাকব নাকি?'

ফলস ছাদের দরজা এর আগে যে খুলেছিলাম সেকথা ওকে বলিনি। বললাম, তাও থাক। ভিতরে নোংরা কিছু থাকলে এখন পরিষ্কার করবে কে? আমি ভয় পাচ্ছি এটা জানতে দিলাম না। 

দুপুরবেলা শুয়ে আছি। তমাল ড্রয়িংরুমে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। আমার চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। কেন জানিনা শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হলো জানালার শিক ধরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চমকে বসে জানালায় তাকিয়ে দেখি কেউ নাই। অথচ সেই দাঁড়িয়ে থাকাটা এত জোরাল ভাবে অনুভব করেছি যে ভয়ে আমার বুক ধুক ধুক করতে লাগল। নিজেকে শান্ত করে চশমা চোখে জানালার ধারে গেলাম। নিচে রাস্তায় গাড়ির পর গাড়ি জ্যামে আটকা আছে। কাত হয়ে জানালার বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম। এই সাইডে কোনো পানির পাইপ নাই। কোনো দড়ি দেখলাম না। মানুষও দেখলাম না। কোনো উপায় দেখলাম না যাতে করে সাত তলার জানালায় কেউ উঁকি দিতে পারে। হঠাৎ পিছনে খট করে একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম, আ!

'কী হলো?' তমাল নিজেও ঘাবড়ে যায়। ওকে দেখে আমি হেসে ফেললাম। তমাল এগিয়ে এসে আমার গায়ে হাত দিল, 'তোমার শরীর তো অনেক গরম। এত চমকালে কেন হঠাৎ?'

আসলেই আমি ব্যাখ্যাতীত চমকেছিলাম। পরে শুনেছি আমার মুখ নাকি রক্তশূন্য হয়ে গেছিল। তমাল আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। আমাকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। ওর শরীরের ঠাণ্ডায় বুঝতে পারি আমার গা কতটা গরম হয়ে উঠেছে। প্রেশারও বেড়েছিল হয়তো। 


ultrasonogram এর ছবির ফলাফল



আমার তখন রাত জাগা রীতিমত বন্ধ। কিন্তু মাঝখানে কয়েকবার ঘুম ভাঙে। কী হয় - তমাল হয়তো আমাকে পাশ থেকে জড়িয়ে শুয়েছিল। মাঝরাতে আচমকা খেয়াল করি ও আদতে আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। অথবা বিছানাতেই নেই, বাথরুমে গেছে। তাহলে এই এক সেকেন্ড আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল কে? এসব চিন্তা করতে চাই না। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আবারও মনে হলো জানালার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঘাড় তুলে না তাকিয়েও স্পষ্ট টের পাচ্ছি। এভাবে অনেকক্ষণ শুয়ে ছিলাম। কিন্তু আচমকা যখন সে কেশে উঠল আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে উঠে বসলাম। কেউ নাই। সময় নষ্ট না করে খাট থেকে নেমে জানালার কাছে গেলাম। আমি যদি প্রমাণ না করতে পারি এসব আমার মনের ভুল তাহলে ভয়টা বাড়তেই থাকবে। ধারে গিয়ে 'কে' বলে তাকাতে যাব ওমনি বাইরে থেকে লিকলিকে একটা হাত এসে খপ করে আমার হাত চেপে ধরল। 

'আ আ আ আ আ...'

আমার চিৎকারে তমাল তড়াক করে উঠে পড়ল। হাতটাও সাৎ করে সরে গেল। তমাল 'কে কে' করে জানালার কাছে যায়। আমাকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে ও মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে জানালার বাইরে দেখার চেষ্টা করল। আমি তমালের বাহু আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কাঁপছিলাম। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। ওকে যে জানালার বাইরে হাত বের করতে নিষেধ করব সে সামর্থ্য ছিল না। ও নিশ্চয়ই কিছু একটা দেখেছে যার জন্য এতটা ব্যস্ত হয়ে বাইরে খোঁজাখুঁজি করছিল। ও আমাকে ঘরের আলো জ্বালাতে বলে পাশের ঘরের জানালাতে গিয়েও ঘাড় কাত করে বাইরে দেখার চেষ্টা করে। আমি ওর পিছে পিছে গেলাম। কিছু পাবে না জানতাম। তমাল রেগে গেল, 'চোর দেখেও আমাকে ডাকলে না কেন?'

চোর! চোরের ওরকম গলে যাওয়া হাত হয়?

আমার হাতে বরফ দিতে হলো। কারণ হাতে যেখানে ধরেছিল সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। বরফ দেয়ার সময় প্রথমে তমাল বিষয়টা খেয়াল করল। পরে আমি। আমার হাতে চার আঙুলের ছাপ। পাঁচ আঙুলের নয়। 

'হাতটা তুমি দেখেছিলে?' আমি জিজ্ঞাসা করলাম। তমাল বলল দেখেনি। ও কেবল একটা কালো মাথা দেখেছে জানালার পাশ থেকে সরে যেতে। কারণ আমি যখন চিৎকার দিয়েছি ততক্ষণে সে হাত ছেড়ে দিয়েছিল। আমি তমালকে হাতের বিবরণ দিলাম না। নিজেকে বুঝালাম যে আমি হয়তো ভুল ভেবেছি। ওটা মানুষের হাতই ছিল আদতে। পরে তমাল জানিয়েছিল - ও নাকি অনেক দূরে পাশের বাসার কার্নিশে আলো ফেলে দেখেছিল এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। একমুহুর্ত ছিল। তারপরই চলে গেল। সেজন্যই তমাল তখন অতটা ব্যস্ত হয়। 

সে রাতে তমাল জোর করে আমাকে ঘুমাতে বলে। ও ঘুমায় নি। যতবার আমি বাথরুমে গেছি তমালকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ও টের পেয়েছিল যে আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। আমি দিব্যি বলতে পারি, সে রাতে বা অন্য কোনো রাতে যদি আবার আমি বাথরুমের জানালায় কারো মাথা দেখতাম তো হার্ট ফেল করে মারা পড়তাম। তমাল বলে দিয়েছিল এরপর যেকোন প্রয়োজনে কখনো ঘুম ভাঙলে যেন আমি ওকে আগে ডেকে তুলি।

পরদিন সকাল। টিভিতে ভুতের সিনেমা দেখছিলাম। এমন সময় সেই আগের মতো দুম দুম ধাক্কা দিল কেউ ফলস ছাদের দরজায়। আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি ভয় পেলাম তখন। যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল তেমন আচমকা আওয়াজ বন্ধ হলো। তবে কিছুক্ষণ পর রক্ত হিম করা ফ্যাসফ্যাসে গলায় ভেতর থেকে আওয়াজ এল - 'জ্যোতি! জ্যো-তি!!' 

আমি কাঁপছিলাম রীতিমতো। অডিটরি হেলুসিনেশন - নিজেকে বললাম। 

তখন আরেকবার ডাকল, 'জ্যোতি... আয় আয়।'

আমার নিয়ন্ত্রন আর আমার ছিল না। আমার পা জোড়া নিজে থেকেই এগিয়ে যাচ্ছিল বাথরুমের দিকে। 

'আমার একটা কথা শুনবি জ্যোতি? একটা কথা বলব।' 

ভয়ে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো আবার। মনে হচ্ছিল যেকোন মুহুর্তে বুঝি সেই ভয়াবহ হাতটা নেমে আসবে উপর থেকে। আমি ঘামছিলাম। আর ফ্যাসফ্যাসে গলায় সে হাসতেই লাগল। এত বিশ্রী আর ভয়ংকর হাসি কোনদিনও শুনিনি। হাসি শব্দে চেতনা ফিরে পেয়ে আমি কয়েক কদম পিছিয়ে এলাম। 

'দরজাটা খোল জ্যোতি। জ্যোতি দরজা খোল। জ্যোতি দরজাটা খোল। দরজাটা খোল জ্যোতি...'  

আমি যেই পিছাতে লাগলাম ওমনি ধাক্কা শুরু হলো। এবারের ধাক্কাটা অন্যরকম। থেমে থেমে। এমনভাবে ধাক্কা পড়তে লাগল যে মনে হচ্ছিল ছিটকিনিটা এখনি খুলে আসবে। আমি জানি ছিটকিনি একবার খুলে গেলে পরের ঘটনা আমার সহ্য হবে না। দেরি না করে কোনমতে ওড়নাটা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। পাশের বাসার আপু বাচ্চাকে স্কুলে দিতে গেছে। আমি বাড়িওয়ালার বাসায় গেলাম। আন্টি বুঝলেন আমার প্রেশার বেড়েছে। পানি খাওয়ালেন। বাতাস করলেন। তমাল না আসা পর্যন্ত ওখানেই থাকলাম। ও এলে আন্টি বললেন এখন আমাকে বাসায় একা রাখা ঠিক না। 

আম্মু আগামী মাসের জন্য অগ্রিম ছুটি নিয়েছিল। এখন আসতে হলে তাকে সেই ছুটি বাতিল করে নতুন করে ছুটি নিতে হবে। ঝামেলা। তাও আমি আপত্তি করলাম না। কারণ এই বাসায় একা থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তমাল ছুটি নিল অফিস থেকে। আমি ওকে কিছু বলিনি। ও জানে যে কারণেই হোক এখন আমার ভয় পাওয়া বা মানসিক চাপ নেয়া ঠিক না। 

তমাল তখন গোসলে। আমি বিছানায় শুয়ে লুকিয়ে ভুতের গল্প পড়ছি। এ সময় আবার গেস্ট বাথরুমের ওপর থেকে দুমাদুম কিলের আওয়াজ পেলাম। একবার ভাবলাম ওদিকে মনোযোগ দিব না। পরমুহুর্তে ভাবলাম গিয়ে দেখি ব্যাপারটা। আমি জানি যে তমাল আছে তাই এখন কিছু হবে না। আজকেই প্রমাণ হয়ে যাবে এই সমস্তটা আমার কাল্পনিক। কাছাকছি যেতে ফলস ছাদ থেকে সেই ফ্যাসফ্যাসে গলায় হাসি শুরু হলো। সত্যি বলতে হাসিটা যেই না শুনলাম আর আমার সব সাহস কোথায় উড়ে চলে গেল। আর এর পরপরই প্রথমবারের মতো সেই বাক্যটা শুনলাম। যেটা শুনে আমার পা থেকে মাথা অব্দি কেঁপে ওঠে।   

'তোর বাচ্চাটা আমাকে দে জ্যোতি।' টেনে টেনে বলল উপর থেকে। এই কথা শুনে যতদূর মনে পড়ে আমি এক জায়গায় আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। আবার সে একই কথা বলে উঠল, তোর বাচ্চাটা আমাকে দে।

তমাল যখন গোসল সেরে বের হয় তখন আমি মেঝেতে বসা। ও ভাবল আমার প্রেশারে গণ্ডগোল হয়েছে হয়তো। হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসতেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। মনে আছে এতটুকু শুধু বলেছিলাম, 'ও আমাদের বেবিকে নিয়ে যেতে যায়।'  আমার কথা তমাল বুঝতে পারল না। পারার কথাও না। কিন্তু এই নিয়ে আমাকে চাপাচাপি করল না। তখনকার মতো চুপ হয়ে গেল। 

তমাল আর দুপুরে খাবার আনতে গেল না আমাকে রেখে। আমাকে তৈরি করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। খেতে খেতে আমরা দুজনই একমত হলাম যে, আমার সাইকো থেরাপি প্রয়োজন। ও আমাকে বলল যা হয়েছে ভুলে থাকতে। ও আর কক্ষনো এক মুহুর্তের জন্যও আমাকে একা ছাড়বে না। 

কিন্তু আমি ওই একটা কথা ভুলতে পারছিলাম না। প্রিন্যাটাল প্যারানয়া? রাতের বেলা চোখ বুজলে মাথার ভেতর বাজছিল - 'তোর বাচ্চাটা আমার চাই'। শোয়ার সময় তমালের হাতটা আমার পেটের ওপর চেপে নিয়ে ঘুমিয়েছি। ভয় হচ্ছিল যে আমার বাচ্চার নিরাপত্তার জন্য আমি যথেষ্ট নই। একবার ঘুম ভেঙে নিজেকে গেস্ট বাথরুমের সামনে আবিষ্কার করি। মেঝে থেকে কিছুটা ওপরে ভাসমান অবস্থায় ছিলাম। দেখলাম আমার সামনে ফলস ছাদের দরজা ধীরে ধীরে খুলছে। অপার্থিব ভয় আমার গলা টিপে ধরল। আমি জানতাম আমাকে চিৎকার করতে হবে অথবা পালাতে হবে। কিন্তু না আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছিল না আমি এক চুল নড়তে পারছিলাম। অদৃশ্য কয়েক জোড়া হাত আমার শরীর আর মাথা চেপে ধরে আমাকে সামনের দিকে তাকাতে বাধ্য করছিল। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় বলছিল ভেতরে এমন কিছু আছে যেটা দেখলে আমি অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাব। দেখলাম ফলস ছাদের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাংসের দলার মতো কিছু। এই বুঝি তারা আমার দিকে ধেয়ে আসবে। যেই না ভাবলাম ওমনি রক্তাক্ত দলাগুলো আমার দিকে গড়িয়ে আসতে লাগল। সর্বনাশ। প্রচণ্ড ভয়ে একজন মানুষের রক্ত কীভাবে জমাট বেঁধে যায় আমি ওই প্রথম বুঝলাম। দেখলাম মাংসপিণ্ডগুলো আর কিছুই নয় - তারা একেকটা মানব ভ্রূণ! আমি সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। 

জেগে দেখি আমি বিছানায় উঠে বসেছি। তমাল উঠে গিয়ে আলো জ্বালাল। আমার জামা, বিছানার চাদর ভিজিয়ে ফেলেছি। ও আমাকে বাতাস করল। আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। রকিং চেয়ারে বসাল। আমার জামা বদলে দিল। চাদর পাল্টাল। আমি ঘুমাতে গিয়ে আরেকবার ওই স্বপ্ন দেখতে রাজি নই। সারারাত আমরা কেউই ঘুমালাম না। 

পরদিন আম্মু আসে।




scary cupboard এর ছবির ফলাফল



তমাল অফিসে গেলে আমি সব কথা আম্মুকে বললাম। আম্মু জানে আমি ভয় কাতর মেয়ে না। কিন্তু আমার কথা যে তার বিশ্বাস হলো না সেটা বুঝলাম। আমি যেহেতু লেখালেখি করি তাই আম্মুর হয়তো ধারণা আমি এসব কল্পনা করেছি। আমারও বিশ্বাস আমি এসব কল্পনা করছি। তারপরও কল্পনাটা এত জীবন্ত যে এই ভয়ের মধ্যে আমি বাঁচতে পারব বলে মনে হয়না। আম্মু বলল, 'আমি এসেছি এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।'

আসার পরদিন আম্মু তরকারি কাটছিল। আমি রান্নাঘরের সামনে টুল নিয়ে বসে। আম্মু তাবৎ গর্ভকালীন উপদেশ দিচ্ছিল আর আমি একমনে ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। পড়ার মধ্যে হয়তো একটু ডুবে গেছি হঠাৎ আম্মু কথা থামিয়ে বলল, ওটা কিসের আওয়াজ?

'কই?' ম্যাগাজিন নামিয়ে কান পাততেই আমার বুকটা ধড়াক করে উঠল। ট্রানজিস্টরের ঘড়ঘড়ের মতো বিশ্রী হাসির শব্দ আসছে মাঝখানের ঘর থেকে। এই শব্দ আমি চিনি। আমি মোহাচ্ছন্নের মতো এগিয়ে যাচ্ছিলাম বাথরুমের দিকে। আম্মু সহসা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আমার হাত চেপে ধরল। সাথে সাথে হাসি থামিয়ে ধপাধপ ধাক্কা দিল কেউ ফলস ছাদের দরজায়। সাথে সেই পুরাতন কথা - 'আমি তোর বাচ্চাটাকে নিব। তোর বাচ্চাটা আমাকে দে জ্যোতি। দরজাটা খুলে দে জ্যোতি।' আমি অবিশ্বাসের সাথে আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মু বিস্ফারিত চোখে ফলস ছাদের দিকে চেয়ে আছে। অর্থাৎ আমি যা শুনছি সেও তাই শুনছে। আম্মু আমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে উপরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল, তুমি কে? 

অপ্রতাশিতভাবে উপরের আওয়াজ থেমে গেল। আম্মু আবার একই প্রশ্ন করল, 'কে তুমি?' কেন যে আম্মু এরকম প্রশ্ন করছিল জানিনা। তবে তার প্রশ্নে হোক বা গলার আওয়াজে হোক, ফলস ছাদ থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আমাকে রান্নাঘরের সামনে থেকে নড়তে নিষেধ করে আম্মু বাড়িওয়ালার বাসায় ফোন করল। অবিলম্বে যেন তারা এ বাসায় আসে বা কাউকে পাঠায়। 

বাড়িওয়ালা আংকেল বাসায় নাই। আন্টি আসছেন বলে আগে বাসার কাজের মেয়েটা আর কেয়ারটেকার চাচাকে পাঠালেন। ওরা যখন এল তখন ফলস ছাদ থেকে পচা গন্ধ বেরতে শুরু করেছে। চাচামিয়া এবার বাথরুমের উপর উঠে ভালোভাবে দেখবেন বলে মই আনতে গেলেন। আম্মু আমাকে বলল পাশের বাসায় যেতে কিন্তু সত্যি বলতে আমি ওই জায়গা থেকে এক পাও নড়তে পারছিলাম না। 

চাচামিয়া দারোয়ানকে নিয়ে ফেরত এলেন। মই ঠেস দেয়া হলো। আম্মু বলল, 'সাবধানে'। আমি তো জানি ভেতরে কিছু নাই। কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। তবে ফলস ছাদ খুলে একটা বাজে গন্ধে দারোয়ান নাকে হাত চাপা দেয়। 'কিছুই তো দেহি না' বলে সে পারুলের দিকে হাত বাড়ায় টর্চের জন্য। চোখের পলকে ফলসের দরজাটা শব্দ করে আটকে গেল। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠি। দারোয়ান পড়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলে। চাচামিয়া শক্ত করে মই ধরে তাকে রক্ষা করল। পারুল আর চাচামিয়া 'কী হইল কী হইল' বলে নিচে নামাল তাকে। দারোয়ানের বাম গালে লম্বা আঁচড়ের দাগ। চারখানা নখের আঘাতের চিহ্ন আমি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। 

আমি চিন্তাও করিনি এমন কিছু যে ঘটতে পারে। তাও আবার সবার সামনে। প্রায় তখনি বাড়িওয়ালী আন্টি এলেন। একটু পর আংকেলও এলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্যান্য ভাড়াটিয়ারাও এসে হাজির হলো। দুর্গন্ধ তখনো যায়নি।

বেলা বোধ হয় বারোটা। কে বা কারা মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে এনেছে আমি জানিনা। ইমামের সাথে আরো কয়েকজন এসেছে। ওরা প্রায় সবাইকে বের করে দিয়ে যার যার বাসায় যেতে বাধ্য করল। বাসার বড় দরজা আটকে ইমাম সাহেব নিজেই মই বেয়ে উঠে ফলস ছাদের দরজা খুললেন। আরেকবার কিছু ঘটবে এই আতংকে আমি আম্মুর বুকে মাথা গুঁজে রইলাম। এবারে কিছু হলো না। হুজুর টর্চ ছাড়াই বাইরে থেকে ভিতরটা অনেকক্ষণ পরীক্ষা করলেন। ওনার লোকেরা ততক্ষণ পুরো বাসায় গোলাপজল দিয়ে গন্ধ দূর করেছে। হুজুর ভিতরে কিছু একটা দেখে চমকে উঠে নিজ মনে বলেন, ইন্নালিল্লাহ। তারপর ফলসের ছিটকিনি আটকে দরজার হাতলে একটা তসবীহ বেঁধে দিলেন বিড়বিড় করতে করতে। মই বেয়ে নামার পর সাথের লোকরা যখন জানতে চাইল হুজুর গম্ভীর মুখে শুধু বললেন, ইফরিত।

আমরা যদিও জানিনা ইফরিত কী জিনিস কিন্তু ওনার লোকদের চেহারায় স্পষ্ট ভয় দেখে অজানা আতংকে আমাদের গায়ে কাঁটা দিল। হুজুর কোনরকম ব্যাখায় গেলেন না। ওনার কথা থেকে এটুকু বুঝলাম উপরে যে আছে সে বড় হিংস্র। বললেন যতক্ষণ দরজা ওভাবে বাঁধা থাকবে ততক্ষণ আর কোনো উপদ্রব হবে না। অতঃপর আমার দিকে আঙুল তুলে যা বললেন সেটা আমি ইতোমধ্যেই জানি, 'এই মেয়েকে সাবধানে রাখেন। ইফরিত এই মেয়ের পেটের সন্তানের ক্ষতি করবে।' 

উনি বলেছিলেন শুধুমাত্র দোয়া দরূদ পড়ে ইফরিতকে তাড়ান যায় না। তবে সত্যিই পরে সেদিন আর সারা সন্ধ্যা আমরা কেউ কিছু শুনিনি। আগামীকাল ইমাম আবার আসবেন একজন কামেলকে নিয়ে। তার আগ পর্যন্ত ওই ছোট দরজা খুলতে নিষেধ করলেন। দরজা খোলার তো প্রশ্নই আসে না। তমাল আসতেই আম্মু সাফ জানিয়ে দিল, 'আমার মেয়েকে আমি এখানে রাখব না। তোমাকেও কালকে আমাদের সাথে যেতে হবে। এখানে তোমার থাকা যাবে না।'

তমাল বরাবরের মতো চুপ করে সব শুনল। আমি তো ওকে এই বাসায় একা রাখব না। অসম্ভব। ঠিক হলো আজকে রাতের মধ্যে সবাই যা পারি ব্যাগ বোঁচকা গুছিয়ে নিব। কালকে কামেল আসার আগেই বাড়িওয়ালার দায়িত্বে চাবি দিয়ে চলে যাব। আমার ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আম্মু-আব্বুর সাথে থাকব। তমালের সাথে আম্মু আরো কীসব কথা বলল আমার সেসব শোনার শক্তি ছিলনা। ভেবেছিলাম আম্মুর সাথে সারারাত গল্প করব কিন্তু মাথা এত ঝিমঝিম করছিল যে আমি না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম সবার আগে। তমাল পাশের ঘরে ঘুমাবে। 

আম্মু পরে কখন এসে শুয়েছিল আমি টের পাইনি। ঘুমের ঘোরেও নানারকম এলোমেলো ভাবনা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। একবার যখন ঘুম ভাঙল তখন আম্মু গভীর ঘুমে অচেতন। ক'টা বাজে জানিনা। নিজের অজান্তেই বিছানায় উঠে বসেছি। মাথার বালিশ পায়ের কাছে। প্রচন্ড ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। আমি হাতড়ে বালিশ মাথায় দিয়ে আবার শুলাম। তারপর কতক্ষণ ঘুমালাম জানিনা। দ্বিতীয়বার ঘুম ভেঙে মনে হলো আমি যেন দাঁড়ান অবস্থায় আছি। চারদিকে অন্ধকারের সমুদ্র। হাতড়ে বিছানা বালিশ খোঁজার চেষ্টা করলাম। খাটের মাথায় হাত ঠেকল মনে হয়। 

কতক্ষণ পরে চোখ সয়েছিল মনে নাই। কুয়াশা কেটে একমুহুর্তের জন্য সচেতন হয়ে উঠেছিলাম। বুঝলাম আমি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে। আমার হাড় মজ্জা শিরশির করে উঠল। মন জানে আমি স্বপ্ন দেখছি না। আমার ঠিক সামনেই ফলস ছাদের খোলা দরজা... 







পরিশিষ্ট


তৃতীয়বার ঘুম ভাঙে তখন সকাল। মনে হলো আমি হাসপাতালের বেডে। আব্বু-আম্মু-তমাল-দীপ্তি এই চারজনকে প্রথম দেখি। কতদিন ঘুমিয়েছি বা মাঝখানে কী ঘটেছে কিছুই জানিনা। শুধু জানি কোনো একটা মারাত্মক অঘটন ঘটে গেছে। 


পরিশিষ্টের পরিশিষ্ট


বহু পরে শুনেছিলাম আমাকে মেঝেতে অচেতন অবস্থায় প্রথমে দেখে আম্মু। আমার হাতে হুজুরের তসবীহ ধরা। প্রায় সাথেই সাথেই হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। ডা. নাসরিন পরদিন আমার আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করেন। ডাক্তারের মতে তিনি একইসাথে তার ক্যারিয়ারের সব থেকে উদ্ভট, ব্যাখ্যাতীত আর ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। আমার পেটে এক সপ্তাহ আগে যেখানে জলজ্যান্ত শিশু ছিল সেখানে কেবল অস্পষ্ট একটা অবয়ব। সনোগ্রফিক ইমেজ খুব ভালোভাবে লক্ষ করলে মনে হয়, বাচ্চার জায়গায় একটা অপরিণত মানব কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

48 LAWS OF POWER by Robert Greene and Joost Elffers

Vladimir Putin The definition of power in 21st century

হারবার্ট স্পেনসারের 'জৈবিক সাদৃশ্যবাদ'

ইংরেজ সমাজতত্ত্ববিদ ও জীববিজ্ঞানী হারবার্ট স্পেনসারকে বলা হয় সমাজবিজ্ঞানের দ্বিতীয় জনক। তিনি 'সামাজিক ডারউইনবাদ'-এর একজন প্রচারক। স্পেনসারের বিখ্যাত 'জৈবিক সাদৃশ্যবাদ' সমাজ ও জীবকে বিশেষ সাদৃশ্যপূর্ণ বলে দাবি করে। হারবার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) ১। সমাজ ও জীব উভয়েই আকারে বৃদ্ধি পায়। মানবশিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়। মহল্লা থেকে মেট্রোপলিটন হয়, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্য তৈরি হয়।   ২। প্রত্যেকে আকারে যত বড় হয় উভয়ের কাঠামো জটিলতর হতে থাকে। ৩। দুই ক্ষেত্রেই, কাঠামোগত পার্থক্যের কারণে কার্যকারিতায় অনুরূপ পার্থক্য দেখা দেয়। ৪। জীবদেহ ও সমাজ উভয়েই ক্ষুদ্রতর একক দ্বারা গঠিত। জীবের যেমন কোষ রয়েছে তেমন সমাজের রয়েছে ব্যক্তি। একাধিক কোষ মিলে যেভাবে বৃহত্তর অঙ্গ গঠন করে, একইভাবে একাধিক ব্যক্তি মিলে সমাজের বিভিন্ন অংশ গঠন করে। ৫। সমাজ ও জীব উভয়ই মূলত তিন ধরনের তন্ত্র বা ব্যবস্থার ওপর টিকে থাকে। এরা হলো - বিপাক তন্ত্র (sustaining system), সংবহন তন্ত্র (distributor or circulatory system), স্নায়ু তন্ত্র (regulatory system). জীবের জন্য খাদ্য হলো এর চালিকা শক্তি, সমাজের ক্ষেত্রে যা হলো কৃ...

আমার লেখা বই

আমার সর্বশেষ বই বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা শাখা: ভাষাশিক্ষা প্রকাশকাল: ২০২৪ প্রচ্ছদ:  বইটি পড়ুন আমার পঞ্চম বই চিত্রনাট্যচিত্রণ: কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখার কলাকৌশল শাখা: চিত্রনাট্য প্রকাশকাল: ২০২৪ প্রচ্ছদ: পার্থপ্রতিম দাস বইটি পড়ুন আমার সর্বশেষ উপন্যাস অধিনায়ক শাখা: উপন্যাস প্রকাশকাল: ২০২০ প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত বইটি পড়ুন আমার প্রথম উপন্যাস রঙবাহার শাখা: উপন্যাস প্রকাশকাল: ২০১৫ প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান বইটি পড়ুন আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ অপরূপকথা শাখা: গল্প সঙ্কলন প্রকাশকাল: ২০১৩ প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান বইটি পড়ুন আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি শাখা: গল্প সঙ্কলন প্রকাশকাল: ২০১২ প্রচ্ছদ: বিক্রমাদিত্য বইটি সম্পর্কে জানুন My books on Goodreads রঙবাহার (avg rating 5.00) অপরূপকথা (avg rating 5.00) অধিনায়ক ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা

TFP 415 WORLD CINEMA : Class Notes

Aug 14, 2023 LECTURE 2 Expressionism Reality is distorted Artist’s personal feeling From Northern Europe How did it begin? Effects of WWI  Foreign film banned Horror, insecurity, and paranoia From German romanticism  ENLIGHTENMENT ROMANTICISM Reason Emotion Progress Common good Individuality Unique potential Science and technology Rational, ordered society Nature and imagination Spontaneous, passionate life Social conventions and institutions  Resistance to social conventions and institutions First appeared in poetry and theater “The world is a laboratory” by Gottfried Benn Characteristics of german expressionist theater Distorted and exaggerated sets, props, and costumes Unease and anxiety Symbolism- character might be represented by an animal or object or a particular color Non-linear plot Confusion and disorientation Fragmented nature of the human experience The threepenny opera (1928) by bertolt brecht Characteristics of german expressionism The subjective view of the...

স্বর্গচূড়া

অবশেষে, একদিন, এতবছরের অপেক্ষার পর ট্রেনটা পেলাম আমি। সঙ্গের পোটলা-পুটলিগুলো প্রথমে কামরার ভেতর ছুঁড়ে দিলাম। তারপর নিজের নাম মুখে নিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠলাম ট্রেনে। গাড়িটা এক মুহূর্ত থামে না প্লাটফর্মে। জোর গতিতে ছুটে চলে। কারো জন্য অপেক্ষা করতে নারাজ। একজনের জীবনে একবার বই দু’বার কখনো আসে না। পাল্লা দিয়ে ছুটে তাকে ধরতে হয়। নইলে নাই। অন্য গাড়ি ধরতে হবে। কিন্তু সে গাড়ি যাবে আরেক গন্তব্যে। ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। প্লাটফর্মে সাথীকে দেখতে পাই। হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে অথচ ঠোঁটে হাসি নাই। শুনতে পেলাম মনে মনে কেবল বলছে, তোমার যাত্রা শুভ হোক। (২) প্রথম কবে সাথীর দেখা পেয়েছিলাম ভালো মনে পড়ে না। মনে পড়ে, মন খারাপ করে প্লাটফর্মে বসে ছিলাম। সাথীকে পেয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। কেন, তা মনে নাই। এরপর কত দিন, কত রাত পাশাপাশি বসে কেটে গেল। আমি আর সাথী। স্টেশন জুড়ে এত এত মুখ। কাউকে মনে ধরে নি। সাথী বাদে। সাথীর স্বজনরা একই স্টেশনে ছিল। তবু ও ছিল একা। কী জানি কেন, কখনো জিগ্যেস করা হয় নি। কিন্তু সাথী অনেক প্রশ্ন করত আমাকে। খুব অবাক হতো যে অন্যদের মতো আমার শরীরে কেন বাঁধন নাই। আমার মা-বাবার কথা জিগ...

THE ART OF SEDUCTION by Robert Greene

রবার্ট গ্রিন এখানে ‘সিডাকশন’ কথাটাকে ব্যবহার করেছেন শুধুমাত্র যৌন প্রলোভন হিসেবে নয়, বরং আরো ব্যাপক অর্থে—রাজনৈতিক, সামাজিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে যেই প্রলোভন প্রযোজ্য। এই প্রলোভনের নীতিগুলো জানলে নিজেকে ও নিজের সম্পর্কগুলোকে আরেকটু ভালোভাবে ঝালাই করা যাবে। সেইসাথে তাদের প্রয়োগ করা যাবে ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনে।    সারকথা প্রলোভন ব্যাপারটাই মনস্তত্ত্বের খেলা, সৌন্দর্যের না। ফলে এই খেলার একজন ওস্তাদ হয়ে ওঠা যেকোন মানুষেরই আয়ত্ত্বে আছে। এমন নয় যে, একজন প্রলোভনকারী তার ক্ষমতাটাকে একবার চালু আর একবার বন্ধ করেন—প্রতিটা সামাজিক ও ব্যক্তিগত লেনদেনই তার কাছে প্রলোভনের একেকটা সুযোগ। সুযোগের একটা মুহূর্তও নষ্ট করার নাই। প্রলোভনকারীরা কখনো আত্মনিমগ্ন থাকে না। তাদের দৃষ্টি থাকে বাইরের দিকে, ভিতরের দিকে নয়।  প্লেজার বা পুলক হলো আমাদেরকে আমাদের সীমার বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি, উদ্বেলিত করে দেওয়ার অনুভূতি—তা হতে পারে মানুষের দ্বারা, বা কোনো ঘটনার দ্বারা।  শেষত, যারা কিনা প্রলোভনকারী, তাদের দুনিয়াদারির সাথে নৈতিকতা ব্যাপারটার সম্পর্ক একদম নাই। প্রতিটা প্রলোভনের দুইটা উপাদান থাকে...

48 Laws of Power in Bangla Free PDF Download

বিনামূল্যে ই-বুক পিডিএফ ডাউনলোড করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন সরাসরি পড়তে এখানে ক্লিক করুন বিক্রমাদিত্য's books on Goodreads রঙবাহার reviews: 1 ratings: 2 (avg rating 5.00) অপরূপকথা ratings: 1 (avg rating 5.00) অধিনায়ক ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা Goodreads reviews for রঙবাহার Reviews from Goodreads.com

মিডিয়া সাক্ষরতা : আদিপর্ব

মিডিয়া সাক্ষরতা ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় জিজ্ঞাসা - মিডিয়া নিজে যতটা প্রাচীন তার চেয়ে কম পুরনো নয়। বর্তমানে তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা মিডিয়া সাক্ষরতাকে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে সত্য। কিন্তু মিডিয়ার প্রভাব ও মিডিয়া সাক্ষরতার গুরুত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন অনেক অনেক আগে থেকেই আলোচিত হয়ে এসেছে। এটাও লক্ষণীয় যে মিডিয়ার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন বিতর্ক একইসাথে নবাগত প্রযুক্তি, শিল্প (আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয় অর্থে), এমনকি সংস্কৃতির গতিপথকে সময় সময় প্রভাবিত করে এসেছে। তবে ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত পরিভাষা বা গবেষণাক্ষেত্র হিসাবে এর অস্তিত্ব ছিল না। যতদিন না বিষয়টি যোগাযোগ স্কলার ও মিডিয়া প্রফেশনালদের কাজের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তার আগ পর্যন্ত (কিংবা এখনো কিছুসময়) যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট ভাবনাসমূহ পরিচালিত হয়/হয়েছে তাত্ত্বিক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও ভাষাতত্ত্ববিদদের দ্বারা। এ যাবৎ মিডিয়া সাক্ষরতা নিয়ে যত তত্ত্বীয় চিন্তা হয়েছে তাতে --- প্লেটো থেকে ফ্রয়েড, সসার (১) থেকে সিক্সাস (২) --- প্রত্যেকেরই রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। উৎপত্তি ও সংজ্ঞা এই তথ্য মোটেও অভিন...

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি : প্রাচীন অর্বাচীন তর্ক

এই লেখাটা ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় যোসেফাইট কালচারাল ফোরামের বার্ষিক ক্রোড়পত্র ত্রিলয়-এ। আমি তখন সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র প্রাচীন -  ওই অর্বাচীনদের আমি শতবার সতর্ক করেছি, আর যা-ই করো, আত্মপরিচয় কখনো হারাবে না। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি এদের সামনে যেন ঘোর অন্ধকার। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছু ভুলে গিয়ে এরা আজ পাশ্চাত্যের অনুকরণে ব্যস্ত। নিজের চশমার 'স্টাইল'টা যতই বাজে হোক না কেন ওটা পরেই তুমি স্বচ্ছ দেখবে। তা না করে যদি অন্যের চশমা চোখে দাও, তোমাকে মানাবে হয়তো ভালো কিন্তু হোঁচট খেতে হবে পদে পদে। অর্বাচীন - তোমার কথায় কেমন যেন ছাপাখানার গন্ধ। তোমার বয়স হয়েছে। তাই চোখে সমস্যা। চোখের পাতা বন্ধ করে তুমি অতীতটাকে সোনালি রঙের মনে করো। আর চোখ মেলে ভবিষ্যৎ দেখতে গেলেই তোমার মনে হয় সেটা বুঝি অন্ধকার। অর্বাচীনদের যতই গালি দাও।পশ্চিমা চিকিৎসার সাহায্য নিয়েই দেখো না চোখটা ভালো হয় কি না। প্রাচীন - বাবা! আজকালকার ছেলেমেয়েরা এক কথার পিঠে একশ কথাকে চাপায়। আমাদের যুগে বড়রা বলত। ছোটরা শুনত। তার থেকেই শিক্ষা নিত। এখনকার ছেলেমেয়দের কথা ...