মিডিয়া সাক্ষরতা ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় জিজ্ঞাসা - মিডিয়া নিজে যতটা প্রাচীন তার চেয়ে কম পুরনো নয়। বর্তমানে তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা মিডিয়া সাক্ষরতাকে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে সত্য। কিন্তু মিডিয়ার প্রভাব ও মিডিয়া সাক্ষরতার গুরুত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন অনেক অনেক আগে থেকেই আলোচিত হয়ে এসেছে। এটাও লক্ষণীয় যে মিডিয়ার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন বিতর্ক একইসাথে নবাগত প্রযুক্তি, শিল্প (আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয় অর্থে), এমনকি সংস্কৃতির গতিপথকে সময় সময় প্রভাবিত করে এসেছে। তবে ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত পরিভাষা বা গবেষণাক্ষেত্র হিসাবে এর অস্তিত্ব ছিল না।
যতদিন না বিষয়টি যোগাযোগ স্কলার ও মিডিয়া প্রফেশনালদের কাজের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তার আগ পর্যন্ত (কিংবা এখনো কিছুসময়) যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট ভাবনাসমূহ পরিচালিত হয়/হয়েছে তাত্ত্বিক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও ভাষাতত্ত্ববিদদের দ্বারা।
এ যাবৎ মিডিয়া সাক্ষরতা নিয়ে যত তত্ত্বীয় চিন্তা হয়েছে তাতে --- প্লেটো থেকে ফ্রয়েড, সসার(১) থেকে সিক্সাস(২) --- প্রত্যেকেরই রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
উৎপত্তি ও সংজ্ঞা
এই তথ্য মোটেও অভিনব নয় যে, মিডিয়া সাক্ষরতা শব্দজোড়টি ভাঙাচোরাভাবে ধার করা হয়েছে ইংরেজি media literacy থেকে। ইন্দো ইউরোপীয় ভাষায় media হলো medium তথা মাধ্যম-এর বহুবচন। অপরদিকে লাতিন literatus/litteratus থেকে উৎপত্তি হয়েছে literacy শব্দটির, যার সরল অর্থ হলো --- লেখা ও পড়ার সক্ষমতা। বাংলায় এর দুর্বল-কিন্তু-কাজ-চালিয়ে-নেয়ার-মতো পরিভাষা আমরা করেছি সাক্ষরতা।
মিডিয়া সাক্ষরতা হলো শিক্ষার অভিমুখে ২১ শতকের যাত্রা। এটি বিভিন্ন ফর্মে বার্তাগুলি অ্যাক্সেস, বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন, তৈরি এবং তাতে অংশগ্রহণের জন্য কাঠামো প্রদান করে --- প্রিন্ট থেকে ভিডিও, ভিডিও থেকে ইন্টারনেট পর্যন্ত। ইহা সমাজে গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্বন্ধে এবং একই সাথে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য অপরিহার্য অনুসন্ধান ও ভাব প্রকাশের দক্ষতা সম্বন্ধে উপলব্ধি দাঁড় করায়।(৩)
গ্রীক যুগ : লিখে রাখার বিড়ম্বনা
তথ্যকে বহন ও সংরক্ষণ করার পদ্ধতিটি মহান দার্শনিক প্লেটোকেও ভাবিয়েছে। ফিদ্রাসের(৪) সাথে সক্রেটিসের আলাপচারিতায় প্লেটো দেখিয়েছেন --- সবকিছুকে লিখিত রূপ দেয়াটা সক্রেটিস তৎকালীন গ্রীক সমাজের সর্ববৃহৎ সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেন। কথোপকথনটির একাংশ নিম্নরূপ -
"মানুষ যদি লিখে রাখতে শিখে, তাদের অন্তরে বিস্মৃতির বীজ রোপিত হবে; তারা স্মৃতিশক্তির চর্চা বন্ধ করে দিবে কারণ তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়বে সমস্তকিছুর লিখিত রূপের ওপর, স্মৃতিচারণ করবে অন্তর থেকে নয়, বরং বহির্মাধ্যম থেকে। সুতরাং যা তোমরা আবিষ্কার করেছ তা স্মরণে রাখার নয় বরংস্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রণালী মাত্র।"
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, মিডিয়া সাক্ষরতা নিয়ে ভাবনার মূলেই রয়েছে --- স্রেফ সাক্ষরতা --- লেখা ও পড়ার ব্যাপার।
প্লেটোর আমলে, এমনকি কয়েক শতাব্দী পরেও, তথ্য আদান-প্রদান হোত মৌখিকভাবে, এবং বেশিরভাগ, মানুষের ক্ষেত্রেই শিক্ষা ছিল একটি অনানুষ্ঠানিক বিষয়।
তথ্য ও যোগাযোগে প্রথম বড় ধরনের পরিবর্তন আসে এর দেড় হাজার পরে।
ছাপার অক্ষরে বিশ্ব
মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গুটেনবার্গ(৫) মিডিয়ায় বিপ্লব আনেন।
এতদ্বারা, মাধ্যম যত সস্তা হতে থাকল তত বেশি সংখ্যক মানুষ শিক্ষার সংস্পর্শ পেল যা ক্ষমতাসীনদের জন্য নতুনতর সমস্যা ডেকে আনে।
মিডিয়া সাক্ষরতার ইতিহাস মিডিয়া প্রযুক্তির ইতিহাসকে নিকটে থেকে অনুসরণ করে এসেছে --- প্রতিটা নতুন আবিষ্কার সঙ্গে নিয়ে এসেছে নতুন নতুন ভীতি ও সমালোচনা। লেখনীর ব্যাপারে প্লেটো যেরকম শঙ্কিত অবস্থানে ছিলেন, ছাপার অক্ষরের ব্যাপারে ঠিক একইরকম শঙ্কা তৈরি হয় শাসক এবং যাজকদের মনে। ক্ষমতায় যারা থাকে তারা একইসাথে তথ্য প্রবাহের ক্ষেত্রে দ্বাররক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চায় --- চমস্কির(৬) গণতন্ত্রের দ্বিতীয় সংজ্ঞা --- এবং মিডিয়ায় অধিগমনে বাধা প্রদান করে, যা কিনা মিডিয়া সাক্ষরতাকে রীতিমতো অসম্ভব করে তুলতে সক্ষম।
মিডিয়া সাক্ষরতা ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এরও তিন শতাব্দী পরে, নতুন একটি মাধ্যমকে সাথে করে --- পৃথিবীর প্রথম গণমাধ্যম: সংবাদপত্র।
এক পয়সার ছাপাখানা
স্থানীয় খবরের কাগজ প্লেটোর যুগ থেকেই প্রচলিত। কিন্তু ১৭ শতক পর্যন্ত এমন কোনো নিয়মিত প্রকাশিত নথি ছিল না যা দ্রুত ও সস্তায় মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করে। আর, প্রথমদিকে, তাদের বেশিরভাগই ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত।
প্রিন্ট মিডিয়া যখন আকার নিতে আরম্ভ করে, তখন থেকেই মানুষ মুক্ত সাংবাদিকতার পক্ষে উদগ্রীব ও লড়াকু হয়ে ওঠে। ১৮০০-র শুরুর দিকে সংবাদপত্রগুলো গণতন্ত্রবাদী শক্তি হয়ে ওঠে।
'Penny Press'(৭) -এর যুগে সংবাদপত্র দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে (বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝে) যেহেতু এসব ছিল সস্তা ও বহুল প্রচারিত। এরপর খবরের কাগজ শুধুমাত্র আর জনশিক্ষার মাধ্যম থাকে না বরং কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপার্জনের অবলম্বন হয়ে ওঠে। ১৮৩৩ সালে বেঞ্জামিন ডে(৮) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত 'নিউ ইয়র্ক সান' পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার উপরে লেখা থাকত ---
"এই কাগজের উদ্দেশ্য জনগণের সামনে, সকলের জন্য সুলভ মূল্যে, দিনের সব খবরাখবর তুলে আনা, এবং একই সঙ্গে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য একটি লাভজনক মাধ্যম পেশ করা।"
১৮৮০ এর দশকে বিজ্ঞাপন থেকে এই পত্রিকাগুলোর আয় এত বেড়ে গেল, যাতে জনমনে আশঙ্কা দেখা দেয় যে হয়তো প্রকাশকরা সত্যের চেয়ে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আর সত্যি সত্যি দেখা গেল প্রকাশকরা খাজনা দেয়ার জন্য বিজ্ঞাপনের ওপর যত বেশি নির্ভরশীল হচ্ছে তাদের কাগজগুলো তত বেশি রোমাঞ্চকর হয়ে উঠছে। বিশ শতকের মোড়ে এসে এই চল মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
হলুদ সাংবাদিকতার যুগ
১৮৯০ এর দশকের শেষের দিকে, দুই কীর্তিমান পত্রিকাওয়ালা পুলিৎজার(৯) ও হার্স্ট(১০) নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করেন কে কত বেশি মানুষের হাতে নিজেদের কাগজ পৌঁছাতে পারেন তা নিয়ে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল অন্যের চেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন পাওয়া। তাঁরা পত্রিকার জন্য এমন এমন গল্প বানাতে থাকেন, যেখানে তথ্যের নির্ভুলতার দিকে গুরুত্ব কম দিয়ে বরং ফোকাস রাখা হয় বেশি পাঠক আর বেশি পয়সা কামানর দিকে। এর মধ্যে দিয়েই ওনারা জন্ম দেন কুখ্যাত হলুদ সাংবাদিকতার।
হলুদ সাংবাদিকরা মোটা হরফের, উদ্বেগজনক ও ভ্রান্তিমূলক শিরোনাম ব্যবহার করতেন; সাক্ষাৎকার জাল করতেন এবং সংবাদকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করতেন; আর বহু চটকদার ছবি ও আলোকচিত্রের ব্যবহার করতেন। মোট কথা, পত্রিকা বিক্রির জন্য যা যা করা দরকার সবই করতেন। তারা পেশাদারিত্ব ও সাংবাদিকতার নীতির ওপরে sensationalism-কে প্রাধান্য দিতেন। স্ক্যান্ডাল, ক্রীড়া, অপরাধ ও আত্মপ্রচার ছিল তাদের মূল বিষয়বস্তু।
হলুদ সাংবাদিকতা, তখন আর এখন, আমাদের তিনটি প্রাচীন প্রশ্নই স্মরণ করিয়ে দেয় ---
- কী হয় যখন আমরা মিডিয়ার ওপর ভরসা করি?
- মিডিয়া সকলের জন্য সহজলভ্য হওয়া উচিৎ কিনা?
- কী হবে যদি কেউ এই সহজলভ্যতার অপব্যবহার করতে চায়?
লক্ষণীয়
- আগেই বলেছি, মিডিয়া সাক্ষরতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এটা সময়ের সাথে সাথে নিয়ত বদলাচ্ছে এবং খাপ খাইয়ে নিচ্ছে।
- এককালে মিডিয়া সাক্ষরতার জন্য আবশ্যক ছিল ভাষার ওপর পাণ্ডিত্য ও দোয়াত-কালি। অথচ পেনি প্রেসের যুগে শুধুমাত্র শিরোনামে একবার নজর বুলিয়ে সত্য বনাম রঙ-চড়ান-খবরের মাঝে ফারাক ধরতে পারাটাই হয় যথেষ্ট।
- প্রতিবার নতুন মিডিয়া উদ্ভাবনের সাথে তাদের পরিচালনে নব নব দক্ষতা প্রয়োজন হয় --- এদিকে আমাদের টেলিভিশন যুগে প্রবেশ করা এখনো বাকি!
জনপ্রিয় মিডিয়া
বিংশ শতাব্দীর প্রবেশমুখে, পেনি প্রেসের লড়াই যখন তুঙ্গে, আরেকখানা মিডিয়া তখন বিস্ফোরিত হতে বাকি। ১৮৯০ এর দশকে প্রদর্শিত হয় প্রথম চলচ্চিত্র, এবং আমরা যে জনপ্রিয় সংস্কৃতির সাথে আজ পরিচিত, সে ছাপার অক্ষর থেকে বেরিয়ে তার প্রথম পদক্ষেপ ফেলে।
স্রেফ তিন দশকের ব্যবধানে, সে আর এক কদম এগিয়ে যায়, আর তারপর আর এক কদম। বেতার সম্প্রচার একসঙ্গে খবর, গান ও আরো অনেক কিছু নিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ে একেবারে মানুষের ঘরের ভেতর। ১৯৫০ এর দশকে তার সাথে যোগ দেয় টেলিভিশন সেট। আর তার ৪০ বছর পরেই, ব্যক্তিগত কম্পিউটার আর ইন্টারনেট মিডিয়া জগতে বিপ্লব এনে দেয়।
প্রযুক্তি যতবার সামনে এগিয়েছে, ততবার নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে আমাদের সামনে। গণমাধ্যম আসার আগে মানুষের চিন্তা ছিল মিডিয়ায় প্রবেশযোগ্যতা নিয়ে। কিন্তু ২০ শতকের প্রথমার্ধে, চিন্তাটা স্থানান্তিরত হয় মিডিয়া বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের দিকে। মার্টিন লুথার(১১) ও গুটেনবার্গ যেখানে চিন্তা করতেন আমাদের পর্যাপ্ত মিডিয়ার অভাব, সেখানে বিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা শঙ্কিত হই যে আমাদের মিডিয়া অতিরিক্ত কিনা। কারণ তখন আমরা যেদিকেই তাকাই, চতুর্দিকে দেখি চলচ্চিত্র আর বেতার সম্প্রচার আর টিভি শো। একই সময় আইনপ্রণেতা, শিক্ষা সংস্কারক আর অভিভাবকরা এই নতুন, জনপ্রিয়, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। তাদের অভিযোগ এই গণমাধ্যম জনগণের জন্য হানিকারক (বিশেষ করে শিশুদের জন্য)।
মোদ্দা কথা হলো এখন আমরা যা করছি, যেমন মিডিয়ার গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান, তারা সম্পূর্ণ তার বিপরীত কাজটা করছিল। তারা ছিল রক্ষণশীল ও কঠোর। একে বলা হয় ‘সংরক্ষণবাদ’।
সংরক্ষণবাদ ও নৈতিক উদ্বেগ
আধুনিক মিডিয়া স্কলারদের মতে, সংরক্ষণবাদের রূপ ভিন্ন ভিন্ন। যেমন---
- সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ হলো যেখানে কিছু মিডিয়ার সাংস্কৃতিক মূল্য অন্য মিডিয়ার চেয়ে বেশি বলে অভিহিত করা হয়।
- রাজনৈতিক প্রতিরোধ হলো যেখানে মানুষকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে রক্ষা করার প্রশ্ন আসে।
- নৈতিক প্রতিরোধ হলো যেখানে মিডিয়ায় যৌনতা, সহিংসতা, পুঁজিবাদ প্রভৃতির প্রভাব সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।
নৈতিক উদ্বেগ (Moral Panic) পরিভাষাটি এসেছে স্ট্যানলি কোহেনের(১২) হাত ধরে। নৈতিক উদ্বেগ বলতে বোঝান হচ্ছে, সামাজিক স্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে হুমকি হিসাবে অনুমিত যেকোন কিছুর প্রতি জনগণের প্রতিক্রিয়া। আইনপ্রণেতা, শিক্ষাবিদ ও মাতাপিতা প্রথমে জানতে পারেন, তারপর উদ্বিগ্ন হন এবং পরে সেইসব ‘হুমকি’ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব হুমকি মূলত নির্ধারিত হয় গৎবাঁধা চিন্তা, বর্ণবাদ ও লিঙ্গবৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে।
মত-বদল ও পুনঃ মত-বদল
সংরক্ষণবাদ ছাড়াও মিডিয়া সাক্ষরতার অন্যান্য সংস্করণ রয়েছে। অধুনায় মিডিয়া সাক্ষরতার ব্যাপারে ধারণার যে পরিবর্তন ঘটে তা শুরু হয় ১৯৬০ এর দশকে। সে সময় দাবি ওঠে যে, শিক্ষার্থীদের অবাধে মিডিয়া ব্যবহারের সুযোগ করে দিলে তা কার্যকরী হতে পারে; এমনকি মিডিয়া সম্পর্কে ভালো, সমালোচনামূলক বোঝাপড়া তাদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে পারে! এই মত-বদলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যিনি রেখেছিলেন তিনি মার্শাল ম্যাকলুহান(১৩)।
মিডিয়া সাক্ষরতা যখন ডালপালা মেলছে, তখন স্কলাররা নতুন করে আবিষ্কার করলেন মিডিয়া কীভাবে রক্ষণশীল ভাবনা-চিন্তাকে উসকে দেয় এবং বর্ণ বা লিঙ্গের মতো সামাজিক উদ্ভাবনগুলোকে পুনর্জাগরিত করে। মিডিয়ার এই প্রভাবগুলো সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা যত বাড়ে তখনি এই অধ্যয়ন ক্ষেত্রের ফোকাস আবার সরে আসে। ভোক্তাদের মিডিয়ার বার্তা থেকে নিরাপদ রাখার বদলে, বর্তমানে মিডিয়া সাক্ষরতার লক্ষ্য হলো তাদেরকে এসব গ্রহণ ও নির্মাণে প্রস্তুত রাখা।
আজকের দিনে মিডিয়া সাক্ষরতার অধিবক্তারা যে ধরনের প্রশ্ন উপস্থাপন করে থাকেন ---
- কখন গ্রাহক নিজে প্রণেতার ভূমিকা নেন?
- মিডিয়া কীভাবে এর দর্শককে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে?
- আমরা কীভাবে মিডিয়া ব্যবহারকারীদের আরো অল্প বয়স থেকে শক্তিশালী হিসাবে গড়ে তুলতে পারি?
একবিংশ শতাব্দী : ডিজিটাল ও সংবাদ সাক্ষরতা
আজকের পৃথিবীতে এসে প্রযুক্তি মিডিয়াকে সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী করে তুলেছে। তাই আমাদের সময় ডিজিটাল সাক্ষরতা (digital literacy) ও সংবাদ সাক্ষরতা (news literacy) নামে অতি তাৎপর্যপূর্ণ দুইটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
সোজা বাংলায় ডিজিটাল সাক্ষরতা হলো, ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য আবশ্যক ধারণা ও কৌশল। এটা জানা যে, ইন্টারনেট কীভাবে চালাতে হয়, ইমেইল কীভাবে পাঠাতে হয় অথবা meme বলতে কী বোঝায়। কিন্তু তার সাথে এটাও জানতে হবে কীভাবে ক্যাটফিশ হওয়া(১৪) অথবা মোবাইল অ্যাপের প্রতি আসক্তি এড়ান যায়।
সংবাদ সাক্ষরতা হলো নির্দিষ্টভাবে সংবাদ মাধ্যমকে বোঝা ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা। সংবাদ সাক্ষরতায় নিম্নোক্ত প্রশ্নসমূহ আলোচ্য ---
- কোন কোন উৎস হতে প্রাপ্ত সংবাদ বিশ্বাসযোগ্য?
- কীভাবে দায়িত্বশীলতার সাথে সংবাদ প্রচার করা যায়?
- সংবাদ সংগৃহীত হয় কীভাবে?
কিন্তু এই ‘ফেক নিউজ’-এর যুগে সত্যকে চিহ্নিত করতে পারাটাও একটি বিবেচ্য বিষয়। একইসাথে আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে ফিল্টার বুদ্বুদ(১৫) ও সমমনা ব্যবহারকারীদের কথা।
আজকের প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, মিডিয়ার জন্য আমাদের বরাদ্দ সময়ের সিংহভাগ গ্রাস করছে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর তাদের প্রভাব একটি হট টপিক। এখন এই মুহূর্তে, মিডিয়া সাক্ষরতার শিক্ষকরা নতুন প্রজন্মের ভোটারদের শেখাচ্ছেন কীভাবে মিডিয়া থেকে গৃহীত তথ্যের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতে হয়। একইভাবে স্কলার ও অ্যাক্টিভিস্টরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ইন্টারনেট নিরপেক্ষতা ও শিল্প প্রবিধান নিশ্চিত করার পক্ষে, যাতে করে তথ্যের মুক্ত প্রবাহ নিরবিচ্ছিন্ন থাকে।
টীকা
(১) ফারডিনান্ড দ্য সসার, Ferdinand de Saussure (১৮৫৭-১৯১৩), বিখ্যাত সুইস ভাষাবিজ্ঞানী।
(২) হেলেন সিক্সাস, Hélène Cixous (১৯৩৭-), ফরাসি নারীবাদী দার্শনিক, সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক।
(৪) Phaedrus. আনুমানিক ৩৭০ খ্রি. পূ. -এ প্লেটো তাঁর গুরু সক্রেটিস ও তাঁদের বন্ধু ফিদ্রাসের মধ্যে একটি কথোপকথনের উল্লেখ করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ডায়ালগে। তাঁদের আলাপচারিতা শুরু হয় ভালোবাসা নিয়ে এবং শেষ হয় বক্তৃতা দেয়ার উৎকৃষ্ট পদ্ধতি সংক্রান্ত বিতর্কের মাধ্যমে।
(৫) জোহাননেস গুটেনবার্গ, Johannes Gutenberg, (১৪০০-৬৮), জার্মান উদ্ভাবক, ১৪৫২ খ্রিষ্টাব্দে ছাপাখানা আবিষ্কার করেন।
(৬) আভ্রাম নোম চমস্কি, Avram Noam Chomsky (১৯২৮-) একজন মার্কিন তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক।
(৭) ১৮৩০ এর দশকে অত্যাধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ট্যাবলয়েড স্টাইলের খবরের কাগজ। বাষ্পচালিত ছাপাখানা আসার পর থেকে এ ধরনের পত্রিকার দাম কমে যায় এবং প্রচার বেড়ে যায়। এদের বেশিরভাগের মূল্য ছিল এক সেন্ট।
(৮) বেঞ্জামিন হেনরি ডে, Benjamin Henry Day (১৮৩৮-১৯১৬), মার্কিন প্রকাশক, লেখক, সম্পাদক।
(৯) জোসেফ জন পুলিৎজার, Joseph John Pulitzer (১৮৪৭-১৯১১), মার্কিন সাংবাদিক। বিখ্যাত পুলিৎজার প্রাইজ তাঁর নামে প্রদান করা হয়।
(১০) উইলিয়াম র্যানডলফ হার্স্ট, William Randolph Hearst (১৮৬৩-১৯৫১), মিডিয়া মোগল। কারো কারো মতে হার্স্টের ছায়া অবলম্বনে ‘সিটিজেন কেইন’ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
(১১) মার্টিন লুথার, Martin Luther (১৪৮৩-১৫৪৬), জার্মান ধর্ম-সংস্কারক।
(১২) স্ট্যানলি কোহেন, Stanley Cohen (১৯৪২-২০১৩), দক্ষিণ আফ্রিকান চিন্তক, সমাজবিদ, অপরাধবিজ্ঞানী।
(১৩) হার্বার্ট মার্শাল ম্যাকলুহান, Herbert Marshall McLuhan (১৯১১-৮০), কানাডিয়ান দার্শনিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, ভবিষ্যৎবাদী। গ্লোবাল ভিলেজ ধারণার প্রবর্তক।
(১৪) To be catfished means to lured [by someone] into a relationship by means of a fictional online persona.
(১৫) Filter bubble is a situation in which an Internet user encounters only information and opinions that conform to and reinforce their own beliefs, caused by algorithms that personalize an individual’s online experience.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন