…Mais oui, je t'aime, lui dit la fleur. Tu n'en as rien su, par ma faute…
হ্যাঁ, রত্না ঠিকই সন্দেহ করেছে যে আমি পরকীয়া করছি।
ও চিরকাল সন্দেহপ্রবণ ছিলই। তবে এই প্রবণতায় প্রথম দিকের সেই মাধুর্য নাই, যখন ওর সন্দেহের পেছনে ওর রক্ষণাত্মক প্রেমকে দেখতে পেতাম। আজকে দেখি কেবলই চাপা বিদ্বেষ। রত্না, তুমি আমাকে হারিয়েছ। কিন্তু আমার থেকে হারিয়েছ আরো আগে।
এক সময় আটপৌরে জীবন থেকে রেহাই পেতে যে মানুষটাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম, একদিন আবার সেই মানুষটাকে এড়ানর জন্য ওই একই জীবনের কাছে মরিয়া হয়ে ফিরতে চেয়েছি। রূঢ় জীবনকে সহনীয় করত যে কণ্ঠস্বর, আজকে সেই কণ্ঠস্বর থেকে পালাতে জীবনের চাপের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে শান্তি খুঁজি। অফিস, টাউন-হল-বাজার আর শুক্রবারের আসরে অতিরিক্ত সময় দেই শুধুমাত্র যেন রত্নার মুখোমুখি কম হতে হয়। ও হয়তো আমাকে আরো বেশি চায়। সে কথা বলতে পারেনি বলেই হয়তো দিন দিন আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তারপর ধীরে ধীরে নিজেই ভুলে গেছে কী চায়। আমার টক শো দেখা নিয়ে ও বিরক্ত। অথচ আমি জোর করে টক শো’র ঘ্যানঘ্যানানি শুনি যাতে ও ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ে। বোঝে না ও? আমাকে দখল করতে গিয়ে আমাকে ক-ত দূরে ঠেলে দিয়েছ দেখো রত্না।
রত্না আমাকে ভালোবাসে জানি। ও ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু ভালোবাসতে জানে না। আলো নেভানর পর ধাঁধাটা মাথার ভেতর নেড়েচেড়ে আমি শুয়ে শুয়ে হেসে ফেললাম। রত্না সাথে সাথে পাশ ফিরে দেখল। ও জেগে ছিল। ওর চোখে সবুজ সংশয়। এই চাহনি দেখলে আমার হৃদপিণ্ডের চারটা প্রকোষ্ঠ চারদিকে ফেটে পড়ার কথা। অথচ আমার কিছুই হলো না। যা ভাবছে ভাবুক। ও ওর মতো ভাববে আর আমি আমার মতো। তোমার উচ্চ কম্পাঙ্কের পৃথিবী থেকে একখানা চাদর আমাকে আগলেছে। রত্না তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছ।
সুলক্ষণাকে আমি প্রথম পেয়েছি স্বপ্নে। ২৭ নাম্বারের ফুটপাথ ধরে কোথাও ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল আর আমি কিছু না জেনেই তার পিছু নিয়েছিলাম। ৮ নাম্বার ব্রিজ, রবীন্দ্র সরোবর, সুধা সদন… স্বপ্নটা কেটে যায়। আবার পরের রাতে একই জায়গা থেকে জাহাজ বাড়ি, জিগাতলা… তাকে ধরতে পারিনি। তার পরনে জাম বেগুনি রঙের কালো পেড়ে শাড়ি। একবারও পিছনে না চেয়ে, একবারও না থেমে সে খোলা চুলে হেঁটে যায়। আমি হয়রান হয়ে যতই কাছে যাই, ব্যবধান একই থাকে। পুরোটা পথ একটা চেনা সুর সে ভাজতে থাকে গুনগুন করে। ঘুম ভাঙার পর আর কিছুতেই খুঁজে পাই না কোন গানের সুর। সেই তার পর থেকে আমার সবকিছু বদলে গেল। বাস্তবের সব দায় বহন করছি কিন্তু বাস্তবতা থেকে আমার মন উঠে গেছে। এটিএম থেকে টাকা তুলি, রত্নার মার জন্য ওষুধ কিনি, বাবুর হোস্টেলের ফি জমা দেই, ডিশের অফিসে অভিযোগ করে আসি কিন্তু আমি আমার মধ্যে নাই। খাওয়ার সময় রত্নার রাজ্যের অভিযোগ আমি শুধু নীরবে শুনে যাই। অভিযোগ দাখিল করো, কাজ হয়ে যাবে। সেখানে কোনো বিচ্যুতি পেলে দ্বিতীয় দফা জানিও। আমি একটা দায়িত্ব পালনকারী প্রোগ্রাম। আমি জানি রত্না এর বেশি চায়। আমাকে মানুষ থেকে মেশিন তুমি বানিয়েছ রত্না।
আমি আর পারিনি ওর চাওয়ার সাথে পাল্লা দিতে। দশকের পর দশক কেবল ওর না-পাওয়া, না-হওয়া, নাখোশি। ও যত চায় না তার চেয়ে বেশি চেয়ে ফেলে। এর সবটা জেনেবুঝেও আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। যতই ভালোবাসি না কেন এভাবে সম্ভব না। শারীরিক, মানসিক, সাংসারিক চাহিদা পূরণের এত ভারসাম্য রাখা একটা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। হয়তো অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হতো। অথচ রত্না আমাকে বেছে নিয়েছে। আমাকেই বেছে নিয়েছে এটা জেনেও যে আমি ওর বরাবর নই। তুমি তো আমাকে ঠকিয়েছ রত্না। তুমি আগে প্রতারণা করেছ আমার সাথে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করিয়েছ যা তুমি নিজেও বিশ্বাস করোনি।
এ এক অদ্ভুত ট্র্যাজেডি। আমাদের ভালোবাসাই আমাদের আলাদা করেছে। ভালো না বাসলে ওর এত দাবি, এত আকাঙ্ক্ষা থাকত না। ভালো না বাসলে আমার এই হতাশা, এই ব্যর্থতাবোধ থাকত না। এই সমস্ত বোধ থেকে ওর ওপর নাকি নিজের ওপর ক্রোধ জন্মেছে সময় সময়। গলা ভারী হয়ে এলেও নিরাবেগ থেকেছি। ওর কাছে আমার আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কতটুকু মূল্য আছে যে রত্নার সামনে প্রকাশ করব। তখনি সুলক্ষণা আমাকে কাছে টেনেছে। তার কোমর জড়িয়ে ধরেছি দুই হাতে। হাউ মাউ করে কেঁদেছি তার কোলে মাথা রেখে। জানতাম না তো এই বেলাতেও এত কান্না জমে ছিল। সুলক্ষণা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তার চাঁপাকলি আঙুল আমার মিহি হয়ে আসা চুলের ভেতর দিয়ে চালিয়ে গেছে। সুলক্ষণা কথা বলে না। সুলক্ষণা কথায় কথায় খোঁচা দেয় না। সুলক্ষণা আমাকে দিয়ে শপথ করায় না। সুলক্ষণা আমাকে নিঙরে নেয় না। সুলক্ষণার কাছে নিজেকে শিশু মনে হয় কিন্তু কখনো ছোট মনে হয় না। সুলক্ষণার কোনো অনুযোগ নাই, কেবলই অনুকম্পা, আমার প্রতি। ব্যস, তারপর থেকে তোমাকে আর প্রয়োজন নাই রত্না।
তারপর থেকে আমি আর গুমড়ে থাকি না। রত্নার সাথে ভালো ব্যবহার করি। যতটুকু ভালো ব্যবহার করা উচিত। তাতে কিন্তু ও আরো ক্ষিপ্ত হলো। কড়া কড়া কথা শোনাল, যা ইচ্ছা তাই, অন্যায় কথা শোনাল ইচ্ছা করে। এমন কথা বলল, এমন অভিযোগ করল যা সে নিজেও জানে মিথ্যা। হয়তো চায় আমি নিজেকে আরো আরো অযোগ্য ভাবি। অথবা হয়তো আঘাত দিয়ে দিয়ে আমাকে আকর্ষণ করতে চায়। কিন্তু আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখল না। জবাব তো কখনোই দেইনা, আগের মতো মুখও কালো হলো না। জলের কলটা মেরামত করে নীরবে পত্রিকা নিয়ে বসলাম। মনে মনে আমি সেই গুনগুনটাকে পাকড়াতে চাইছি।
‘তুমি আর আমাকে ভালোবাসো না-’ রত্না খানিক দূরে বসে বলল। আগের মতো অভিমানী সুরে না। বলল হতাশা নিয়ে। কিছুটা হতাশা আর কিছুটা বিস্ময়। আমি পাথর হয়ে গেছি। নির্বিকার পত্রিকার পাতা ওল্টালাম। ও অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর উঠে চলে গেল। ভাবলাম পিছু নিই। ওকে হাত ধরে টেনে এনে বসাই। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে সেই পুরাতন কথাটা বলি। কিন্তু না। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এতটা পিছিয়ে আসার পর আর সেই দূরত্ব ডিঙানো যায় না। আমার বর্তমান স্ত্রী এখন আমার সাবেক প্রেমিকা। আমাদের গল্প শেষ হয়ে গেছে গো রত্না।
সেই কথাটা আমি গিয়ে বললাম সুলক্ষণাকে। চুল সরিয়ে চুমু আঁকলাম সুলক্ষণার কপালে। সুলক্ষণার পায়ের কাছে বসে উজাড় করে দিলাম চাপা দেয়া সব ইচ্ছা। গভীর রাতে পাশ ফিরে হঠাৎ পিছন থেকে জাপটে ধরা, টিভি দেখার সময় ধপ করে পাশে বসা, কানের দুল সরিয়ে রাখা, কাজের সময় খোঁপা খুলে দেয়ার পাগলাটে সব ইচ্ছা। আমি সুলক্ষণাকে ভালোবাসি। সুলক্ষণা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় সেসব জায়গায়, যেসব রাস্তা আমি ভেবেছিলাম কেউ মনে রাখেনি। সুলক্ষণার আমার মুখের দিকে চেয়ে শোনে যেসব শোনার অবসর রত্নার কখনো হয়নি। সুলক্ষণা বাসের মধ্যে আমার পাশের সিটে এসে বসে। আমাকে তার কাঁধে মাথা রাখতে দেয়। আমরা চুপ থাকি। স্রেফ চুপ করে থাকি। আর তার ওই গানের সুরটা যেটা ঘুম ভাঙলেই হারিয়ে ফেলি…
ওটা যে কোন গানের সুর, কবে শুনেছি, গানের কথাগুলো কী ছিল? আমি ওর মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকি। টক শো’র বদলে মধ্য রাতের সঙ্গীতানুষ্ঠান চালাই। রত্না প্রথমে ভেবেছিল ভীমরতি। দিনে দিনে বুঝেছে, আমি প্রেমে পড়েছি। এই কথাটা ভয়ে জিজ্ঞাসা করে না। যদি নিজের মুখে স্বীকার করি তাহলে সেই কথা ও নিতে পারবে না। ওর সেই সাহস নাই। আমাকে অবাক করে দিয়ে রত্নাও নিজেকে গুটিয়ে নিল দ্রুতই। আর যে আশা নাই। আমার আঙিনা থেকে ওকে দূর করেছি জানলে তবু লড়াই করার থাকে। কিন্তু আমি যে চারপাশে বেড়া তুলে দিয়েছি অন্যের নামে। মায়া হয় ওর জন্য। আমি নিরুপায়। চেষ্টা চালিয়ে গেছি যতদিন বিশ্বাস ছিল দুইটা মানুষ ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু কোন পর্যায়ে হাল ছাড়তে হবে এটাও জানা উচিৎ। সুলক্ষণা জীবনে না এলে এই চক্র থেকে বেরতে পারতাম না। এপাশ ওপাশ করতে করতে কেটে যেত সব রাত। সুলক্ষণা, প্রেম আমার, ঠিকানা আমার, তোমাকে জড়িয়ে ধরব এই শহরে আমার প্রিয় সব জায়গায়।
সেদিন ছুটির বিকালে বাসাতেই ছিলাম। এখন আর রত্নার থেকে পালাতে হয় না। ও থাকে নিজের মতো। আমার ছাদে ওঠা হয় না অনেকদিন। রত্না বোধ হয় মার ঘরে। নিঃশব্দে সদর দরজা খুলে পা বাড়ালাম। চার তলা বেয়ে উঠতেই সিঁড়ির ধাপে আচমকা পা অসাড় হয়ে গেল আমার। সেই সুরটা… ওপর থেকে…
বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। হুঁশ ফিরে পেয়ে বয়স ভুলে ছুট দিলাম ওপরে। সুলক্ষণা… সুলক্ষণা…
ও প্রাচীরের কাছাকাছি ঝুঁকে বসে ভুঁই চাঁপার মাটি খুঁড়ে দিচ্ছিল। পরনে কালো পাড়ের পুরাতন জাম বেগুনি শাড়ি। আঁচলটা কোমরে জড়ানো। দিনান্তের লালচে সোনালী আলোয় ওকে অপার্থিব দেখাচ্ছে। আমার সাড়া পেয়ে রত্না গুনগুন থামিয়ে মুখ তুলল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন