আমি এখন ক্লান্ত
... ফেরার কোনো পথ নাই...
'রান্না ঘরে একটা রুটি আছে। ডাল গরম করে দিব? রুটি দিয়ে ডাল খাবেন?'
'না না। থ্যাংকস।'
'তাহলে ঘি দিয়ে খাবেন? দিব?'
মেঘলা একটু নড়ে বসল, 'তুমি কি আমার সাথে মজা করছ? এই ভর সন্ধ্যাবেলায় আমি ঘি দিয়ে রুটি খাব?'
'ইয়ে, আসলে আমার মা তো এখনো...'
'তুমি এত অস্থির হয়ো না। আমি কিছু খাব না।' মেঘলার ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলে ও সেটা ব্যাগ থেকে বের করে একটু দেখল। তারপর কলটা কেটে আবার হাতব্যাগে ভরে রাখল। আমার দিকে তাকিয়ে অযথা হাসল। ঠিকানা-পরিচয় জানিনা এমন একজনকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখেছি। আমার মাথাটা বোধ হয় নষ্টই হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে মেঘলা যেন রোজ এ বাসায় বেড়াতে আসে। না ওর আচরণে কোনো কৃত্রিমতা আছে না আমার আচরণে।
'যা নিয়ে কথা হচ্ছিল - বললাম আমি, ধন্যবাদ আমাকে ভীতু আর দুর্বল বলার জন্য।'
মেঘলা আনত মুখে ভুরু জোড়া কপালে তুলে আমার দিকে তাকাল। মুখে মুচকি হাসি। এমন ভঙ্গি আমার কাছে নতুন। এখন যে মেঘলাকে দেখছি তাঁর সাথে খানিক আগের মেঘলা কিংবা আমার উপন্যাসের মেঘলার কোনো মিল নাই। ওর চেহারাটা পর্যন্ত অনেকখানি বদলে গিয়ছে যেন। সালোয়ার কামিজের রংটাও কি বদলেছে? আগে যেন কী রং ছিল - মনে পড়ছে না।
'একভাবে দেখলে আপনার কথাও ঠিক। আমি শারীরিকভাবে দুর্বলই বটে... ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আচ্ছা যান। মানসিকভাবেও একটু দুর্বল মানলাম। আর একা। ভীষণ একা। আর একটা ঔদ্ধত্য, হ্যা, নামকরণের সময় থেকেই যেটা চাপা ছিল আমার মধ্যে। বাইরে থেকে যেটা কোনদিনও প্রকাশ পায়নি। আর ছোটবেলা থেকেই কিছুটা অন্তর্মুখী আমি। জাগতিক সব ব্যাপারে...'
'অন্তর্মুখী আর একটু "মানসিক", আমি জানি, বলতে হবেনা।' মেঘলা বলল। এমন সময় আমার চোখ চলে গেল সিলিং এ। ফ্যানের সাথে একটা মেয়ের লাশ ঝুলছে। আমি বাস্তবে কাউকে ওভাবে মরতে দেখিনি। ফলে এখন মস্তিষ্ক আমাকে যেটা দেখাচ্ছে সেটা যতটা না সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তার চেয়ে বেশি কল্পনাপ্রসূত। মেঘলার দেখি সিলিং এর দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। অথচ ধবধবে সাদা পা দুটো ঠিক ওর মুখের সামনে ঝুলে আছে। জানতে ইচ্ছা করল ও কি সত্যিই কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা? থাক, কী দরকার। দিব্যি তো বসে আমার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। যেন তার আর কোথাও কাজ নাই। যেন সে আমার মায়ের সাথে দেখা করতেই এসেছিল। আমিও অপেক্ষা করতে লাগলাম, ঝুলন্ত লাশটা কতক্ষণে অদৃশ্য হবে তার জন্য।
'খুব মজা লাগে বুঝি তাই না?'
'হু? আমাকে বলছেন?'
'হ্যা তোমাকে বলছি। এই যে অলৌকিক জগৎ তৈরি, তারপর সেখানে যাতায়াত... নিজের সমস্ত ইচ্ছার বাস্তবায়ন করা।'
'সত্যি কথা বলি, এখন আর মজা পাই না। আমি ক্লান্ত।খানিকটা... ভয়ও হয়। প্রথম যখন ওই কল্পনার রাজ্যে পা দিলাম... নিজের যোগ্যতা, সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে তখনো কোনো ধারণা ছিলনা। নিজেকে খুব ক্ষমতাবান মনে হত। আর এখন, একটা "ভুলভুলাইয়া"র মধ্যে পড়ে গেছি যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নাই।'
'বাবারে, এত কথাও বলতে পার!'
আমি নিজেই অবাক হলাম। সত্যিই তো, অন্য মানুষের সামনে মুখই খোলেনা আমার। অথচ আজ এত বকে ফেললাম। আসলে 'আত্মানং বিদ্ধি'র উপর আরো কিছু কোর্স করা দরকার আমার।
এমন সময় কলিং বেল বাজল। যাক, মা ফিরল তাহলে। দরজা খুলে দেখি মার সাথে আরেকজন কে এসেছে।'
'সারা বাসা অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?'
সত্যিই, পিছনে ফিরে দেখি পুরো বাসা অন্ধকার। আলো জ্বাললাম। কোথাও মনুষ্য চিহ্ন নাই। কেউ ছিল বলেও বোঝা যাচ্ছেনা। মার ঘর থেকে বিড়ালটা হাই তুলতে তুলতে বের হলো।
'আসো, ভিতরে আসো - আগন্তুককে ঘরে ঢোকাল মা। আমাকে দেখিয়ে বলল, এটা আমার ছেলে।'
আগন্তুক নিজের পরিচয় দিল, আমার নাম মেঘলা। শুভর বোন।
'অ্যাঁ! কার বোন?' মাথাটা আবার ঝিমঝিম করে উঠল। পরিবেশ কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল।
'কী ব্যাপার, কী হলো তোর?'
ঝড়ো বাতাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি বোধ হলো।
'... কে বলল তোমাকে যে আমি জীবিত?... '
বাতিগুলোর ভোল্টেজ ওঠানামা করছে।
'... তুমি জানো না সৃষ্টি যতটা স্রষ্টার দ্বারা প্রভাবিত হয় স্রষ্টাও ঠিক ততটাই হয় সৃষ্টির দ্বারা...' '... হয়ত তোমার সমস্ত কল্পনাই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে...' '...আমাকে মরতে হলো কেন?...'
শুনতে পেলাম কেউ হাসছে। কোনদিন শুনিনি। তবু বহুদিনের চেনা, মাথা ঘোরানো-ভয় ধরানো হাসি...
এমন সময় কলিং বেল বাজল। একটানা অনেকক্ষণ। আমার তখন পাগলপ্রায় অবস্থা।
(সমাপ্ত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন