সাহিত্যের ভাষাশৈলী, গঠন, পটভূমি প্রভৃতি কতিপয় বৈশিষ্ট্য সাহিত্যিকের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। অপরদিকে, সাহিত্যের পাঠকপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সে সংক্রান্ত আলোচনা, সমালোচনা এ সবকিছুই খোদ সাহিত্যিকের এক্তিয়ার-নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এরকমই এক বৈশিষ্ট্য সাহিত্যের স্থায়িত্বগুণ। অর্থাৎ কোনো সাহিত্যকর্ম কতদিন বেঁচে থাকবে না থাকবে তা সাহিত্যিকের প্রত্যক্ষ প্রভাবমুক্ত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের কালোত্তরণের বিষয়টিকে ব্যাপক প্রাধান্য দিতেন বলে দেখা যায়। প্রসঙ্গত, ‘ষোড়শী’র নাট্যরূপ নিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত ব্যক্তিগত চিঠিতে কবির অভিমত উল্লেখ্য, “...সৃষ্টিকর্তারূপে তোমার কর্তব্য ছিল, এই ভৈরবীকে একান্ত সত্য করা, লোকরঞ্জনকর আধুনিককালের চলতি ‘সেন্টিমেন্ট’ মিশ্রিত কাহিনী রচনা করা নয়। সাহিত্যে তুমি বড় সাধক, ইন্দ্রদেব এখন যদি সামান্য প্রলোভনে তোমার তপোভঙ্গ করেন তাহলে লোকসান সাহিত্যের। তুমি উপস্থিত কালের কাছ থেকে দাম আদায় করে খুশি থাকতে পারো – কিন্তু সকল কালের জন্য কি রেখে যাবে?” বলা বাহুল্য যে প্রশ্নটি সার্বজনীন, এককভাবে কারো ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়।
এখানে জিজ্ঞাস্য, আদতে কী সাহিত্য কত সময় টিকল তা এতই গুরুত্বপূর্ণ? হ্যা, মহাকালের জন্য তা বিশেষ গুরুত্ববহ। নচেৎ হোমার অথবা কালিদাসের কীর্তিগুলো আমরা পেতাম কী করে? অর্থাৎ পাঠকসমাজের জন্য কালোত্তীর্ণ সাহিত্য অতি মূল্যবান। কিন্তু অমর সাহিত্য সৃষ্টিতে সাহিত্যিকের আদৌ কোনো দায় রয়েছে কি? সময়ের হিসাব কি শিল্পের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে? প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ, যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তার লেখা একেবারেই স্থায়িত্বগুণসম্পন্ন নয়; বরং ক্ষণস্থায়ী জনপ্রিয়তা অর্জনের কথিত মোহের ফসল। এ বিষয়ে প্রাবন্ধিকের মতামত, সব লেখক তো শেষতক নিজের আনন্দের জন্যই সাহিত্যসৃষ্টি করেন। সে কর্ম কতটা টেকসই হলো তা তো পরের বিবেচনা এবং অপরের বিবেচ্য। রবি ঠাকুর নিজেই বলেছেন, “স্ফুলিঙ্গ তার ডানায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ/ উড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল সেই, তারি আনন্দ।” কেননা মৃত্যুর কত শতাব্দী পর অথবা মৃত্যুর পর কত শতাব্দীকাল একজনের লেখা গ্রহণযোগ্যতা পাবে তা কেবল অনুমানই করা সম্ভব। সক্রেটিসের সরল তথা সুগভীর উক্তি ‘আমি মরে গেলে আমাকে পাবে কোথায়’ অনুকরণ করে বলা যায়, স্রষ্টার অবর্তমানে সৃষ্টির স্থায়িত্ব তার জন্য কোনো অর্থই বহন করে না। তাই যেসব সাহিত্যিক বর্তমানের কাছ থেকে পূর্ণ হিসাব আদায় করে নিতে পারেন তাঁদের সার্থকতাকে আমি খাটো করে দেখি না। আর জনপ্রিয় সাহিত্য যে দীর্ঘজীবী হয় না এমন পূর্ব ধারণা রাখা সংগত নয়। ‘দেবদাস’ উপন্যাসকে এর লেখক নিজে সাহিত্যের মর্যাদা দিতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এখন দেখা যায় ওই উপন্যাসটিই বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার পড়া হয়েছে।
নশ্বর পৃথিবীতে আগামীকাল, আজকের তৈরি মায়া মাত্র। তবু যদি কেউ ভবিষ্যতকে বিবেচনায় রেখে শিল্প রচনা করে তবে তা শিল্পীর মহানুভবতা। এদিকে কেউ হয়তো ভাবে – ‘এমন মানব জনম আর কি হবে? শতবর্ষ পরে যেই আমার কবিতা পড়ুক তার থেকে তো আর আমি কপিরাইট আদায় করতে পারব না! অতএব আমার প্রাপ্য খ্যাতি, সম্মান, ভালোবাসাটুকু এই জীবনেই উপভোগ করে নিই।’ সময়ের স্রোতে এসব সাহিত্যিক হয়তো হারিয়ে যান কিন্তু যাবার বেলায় সময়ের পাওনা সাথে করে নিয়ে যান। আখেরে কারা যে লাভবান হলেন বলা মুশকিল। পরিশেষে কেবল বলা যায়, সাহিত্যিক রচনাকালে তাঁর কর্মের ভবিষ্যৎ আয়ুষ্কাল বিবেচনা করবেন কি করবেন না সেটা একান্তই তাঁর অভিরুচি। প্রথমত, সৌন্দর্যসৃষ্টি, রসসৃষ্টি সাহিত্যের উদ্দেশ্য, নিরন্তর টিকে থাকাটাই উদ্দেশ্য নয়। দ্বিতীয়ত, সময় কাকে রাখবে আর কাকে ত্যাগ করবে সে বিচারের ভার সময়ের – আমাদের নয়।
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে, এ প্রজন্মের সাহিত্যিক কাকে অনুসরণ করবে? তারা কি বর্তমানের জন্যই লিখবে, নাকি ভবিষ্যতের স্বার্থে বর্তমানের মোহ ত্যাগ করবে? এর জবাব খুব সরল। বুদ্ধদেবের ভাষায় বলতে হয়, ‘মনই সব। মন যা বলে, তারই অনুসরণ কর।’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন