‘আম্মু দেখো দেখো-’
প্রতিদিন এই এক কাহিনী করে মেয়েটা স্কুলে লেট করে। আর আমারও অফিস যেতে দেরি হয়। গলির এক কুকুর পাঁচখানা বাচ্চা দিয়েছে। বাসায় যেতে আসতে আমার মেয়ে বিগলিত হয়ে ওঠে ওদের দেখে। পারলে আমার হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে ছানাগুলোকে আদর করত। কুকুর বিড়ালে এমনিতে আমার এলার্জি। আর রাস্তার কুকুর তো দেখলেই ঘেন্না লাগে। মেয়ে হয়েছে উল্টোটা। আঁচড় দিবে, কামড় দিবে - এর কোনোটা বলেই ওকে ভয় দেখাতে পারিনা। গায়ে হাত দিতে নিষেধ করেছি বলে রোজই যেতে যেতে বায়না ধরে, ‘ওদেরকে চিপস দেই? চকলেট দেই?’
‘ওরা চিপস খায় না। তাড়াতাড়ি হাঁটো।’
‘ওদেরকে কে খেতে দেয়?’
‘দেয় কেউ একজন। নাহলে বাঁচে কী খেয়ে? এই রিকশা এই-’
সেদিন পুরো রাস্তা জ্যামের মধ্যে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছে কুকুর কী খায় আর কী খায় না। জিজ্ঞাসাবাদে অতিষ্ঠ হয়ে দুই-একবার চরম অসত্য ও অবাস্তব তথ্যও দিয়ে ফেলেছি মেয়েকে। বাড়ি ফিরে দুপুরে খাবার সময় বলল, ‘মামণি, বাবুগুলোকে (কুকুরশাবক) ভাত দিয়ে আসি? আমি কাছেও যাব না। তুমি বুয়াকে বলো দিয়ে আসতে। আমি শুধু দূর থেকে দেখব। আচ্ছা?’
প্রথমে স্পষ্ট অসম্মতি জানালাম। তারপর মেয়ে প্যান প্যান শুরু করলে শর্ত সাপেক্ষে রাজি হলাম; চুপচাপ নিজের ভাত খেতে হবে। যতটুকু দিব তার সবটা। ‘আর তোমার ওইদিকে যাওয়া চলবে না। বুয়া একা গিয়ে ভাত দিয়ে আসবে। রাজি?’
মেয়ে কিছুক্ষণ ভেবে নিচু স্বরে বলল, ‘এক টুকরা মাছও দিও তাহলে।’
সেই থেকে কুকুরদের খাওয়ানর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েকে দুই বেলা ভাত খাওয়াই। বুয়া নিজের বাসায় ভাত-তরকারি নিয়ে যাওয়ার সময় কুকুরের খাবার বেঁধে নিয়ে যায়। আমার কন্যার শিশুমনে কোনো সন্দেহ জাগে না যে খাবারটা আদৌ বাচ্চাগুলো পায় কিনা।
আজকে স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে ফেরার পথে বিজয় সরণির সিগন্যালে আটকা। ও ছটফট করছে। গত এক সপ্তাহ ছুটি ছিল তাই কুকুরগুলোকে দেখা হয়নি। সকালে তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও আশপাশে দেখেনি। তাই এখন রাজ্যের আবোল তাবোল প্রশ্ন করছে - ছানাগুলো এর মধ্যে বড় হয়ে গেল না তো? ওরা দূর থেকে দেখলে আগের মতো লেজ নাড়বে তো? বাচ্চাসহ মা কুকুরটাকে কেউ অন্যত্র তাড়িয়ে দিতে পারে এই সম্ভাবনার কথা মেয়েকে জানালাম না। একে তার প্রশ্নের জ্বালায় বাঁচি না এর মধ্যে পিছের এক গাড়ি সমানতালে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে জুটল এক ভিক্ষুক।
‘মা দশটা টাকা দেন না।’
‘মাফ করেন।’
‘দুইদিন ধরে কিছু খাই নাই মা।’
আমার মেয়ে প্রথমে ঘাবড়ে গেছিল লোকটাকে দেখে। তার সারা গায়ে অসংখ্য আঁচিলের মতো। আমার নিজেরই কেমন কেমন লাগছিল। হঠাৎ দেখি মেয়ে বলে, ‘দাও না মামণি ওনাকে দশ টাকা।’ বাচ্চা মেয়ে বলে ফেলেছে অগত্যা কিছু করার নাই। পার্সে খুচরা বেশি ছিল না রিকশা ভাড়া ছাড়া। গজগজ করতে করতে দশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিলাম ভিক্ষুকের হাতে।
‘আল্লাহ আমার জাদুকে অনেক বড় করুক। আমার জাদু অনেক বড় মানুষ হবে।’ প্রথমে আমার মেয়ে তারপর আমার দিকে সেলাম ঠুকে লোকটা চলে গেল পাশের গাড়ির দিকে।
‘ওনার শরীরে কী হয়েছে?’ আমার কন্যা রত হলো নতুন জিজ্ঞাসায়। মনে মনে ভাবছিলাম বলি যে, কুকুর ধরলে ওইরকম হয়। পরে কী ভেবে আর মিথ্যা বললাম না। লোকটা আমাদের পাশের গাড়ি থেকে আরেকখানা নোট পেয়েই ছুটে রাস্তা পার হয়ে দোকানে গেল কিছু একটা কিনতে। দেখলাম রুটি কিনল। যাক তাও ভালো। এখন যদি দেখতাম সিগারেট কিনেছে তাহলে মা-মেয়ে দুইজনেরই মনটা যেত ভেঙ্গে।
আমরা এদিকে জ্যামে বসে আছি আর ব্যাটা ভিক্ষুক দেখি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আমাদের ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেল। এতক্ষণ রিকশায় বসে সময় নষ্ট করেছি ভেবে তখন নিজের ওপর রাগ হলো। পাঁচ মিনিট পর মেয়েকে নিয়ে নেমে গেলাম। রিকশাওয়ালা পুরো ভাড়াই নিল; এক পয়সাও কম না। পৃথিবীতে আর ভালো মানুষ অবশিষ্ট নাই। সব জোচ্চোর দিয়ে ভরে গেছে। আমার মেয়ে কিন্তু খুশি। পায়ে হেঁটে যাওয়ার সুবাদে সে চলতি পথে কুকুরগুলোকে খুঁজতে পারবে। আমরা নেমে রাস্তা পার হওয়ার সাথে সাথে সিগন্যাল ছেড়ে দিল। ভগ্ন হৃদয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মেয়ে কী বকবক করছিল আর খেয়াল নাই। মাথায় ঘুরছে অফিসের যত ঝুট ঝামেলার কথা।
বাসার কাছাকাছি এসেছি - হঠাৎ আমার মেয়ের আত্মচিৎকার! ভাবনার জগৎ থেকে মুহূর্তে ফিরে এলাম। রাস্তার লোকজনও আমার মতো চমকে উঠেছে।
‘আম্মু দেখো দেখো-’
কুকুরগুলোকে দেখতে পেয়েছে কন্যা।
‘ওফ, আর কক্ষনো ওইভাবে চিৎকার করবে না রাস্তার মাঝখানে।’ ঝাড়ি দিলাম মেয়েকে। সত্যি ভয় পেয়ে গেছিলাম। মেয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আমিও শক্ত করে ধরে রাখলাম ওর হাত; পাছে দৌড়ে গিয়ে কুকুরের গায়ে হাত দেয়।
‘মামণি দেখো ওই লোকটা-’
হ্যা তাই তো। শরীরে আঁচিল ভিক্ষুকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দাঁড়াল কুকুরগুলোর কাছে। মেয়েকে নিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু সে হাত নিয়ে টানাটানি শুরু করায় বাধ্য হলাম দাঁড়িয়ে থাকতে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমরা দেখছিলাম লোকটার কাণ্ড। বাচ্চাসহ মা কুকুরটা ছুটে এল লোকটার কাছে। তাকে ওরা এমনভাবে চাটতে লাগল যে দেখে আমার মেয়ে আত্মহারা। আমার ধমকানি উপেক্ষা করে সে খুশিতে লাফাতে লাগল। আর তারপর - আমার বিস্মিত হওয়ার পালা!
লোকটা হাঁটু গেড়ে বসে শান্ত করল কুকুরগুলোকে। তারপর শতছিন্ন কোটের পকেট থেকে একটা রুটি বের করল। মা কুকুর বাধ্যের মতো চুপটি করে বসে পড়ে রুটিটা দেখে। ছানাগুলো ঘুরঘুর করছিল তার আশেপাশে। লোকটা রুটিখানা থেকে ছোট্ট ছোট্ট পাঁচ টুকরা ছিঁড়ে ছানাগুলোকে দেয়। একটা তুলনামূলক বড় টুকরা দেয় ওদের মা-কে। তারপর নিজের অংশটা - যেটা এক কামড়ে মুখে পোরা যায় - সেটা একটু একটু করে চিবোতে থাকে খুব আয়েশে।
আমার মেয়ে মুখ তুলে আমার দিকে তাকায়। আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ ভিখারিটার ওপর। নাহ, ওনাকে ভিখারি ভাবতে ইচ্ছা করছে না আর। মেয়ে দৌড়ে গেল ওদের দিকে।
ওর হাতটা যে কখন ছেড়ে দিয়েছি খেয়াল-ই করিনি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন