এই ভূমিতে একদিন দণ্ডকারণ্য ছিল। আমি তাকে পাই পতিত অবস্থায়। দাবানল না কী একটা লাগিয়ে ভূমির রক্ষক সটকে পড়েছিল। নামেই রক্ষক। শুনেছি সে ব্যাটা ঘোর অনাচারী। প্রকৃতির স্রেফ পূজা করলেই হয় না, তাকে রক্ষাও করতে হয় - এমনটা সে বিশ্বাস করত না। অরণ্যের আবার যত্ন কীসের।
আমার নিজের ভেতর সংস্কারের খুব অভাব থাকলেও, কীভাবে আর কী ভেবে যেন এই এক টুকরো বসুন্ধরার সংস্কারে নেমে পড়েছিলাম। প্রথমে কিছুটা মায়ায় পড়ে, কিছুটা কি কর্তব্যের খাতিরে। তারপর নিজের ভালো লাগা থেকে। এত অল্প তাও আবার এমন স্বার্থপর খাটুনিতেই বসুমতি তার মালিকানা সঁপে দিবে আমার তো জানা ছিল না। সবাইকে দেয়ও না বোধ হয়।
সে জঙ্গল দিনে দিনে সাফ করেছি। মাটির আজ্ঞা বয়েই মাটি থেকে অবাঞ্ছিত সব উপড়েছি একে একে। তার ব্যাথা হয়েছে কিনা বলতে পারিনা। লজ্জাজনক হলেও সত্যি যে, তার সব কান্নাকে আমি জানি না। জেনেছি বনটা কেমন প্রকাণ্ড আর ঘন ছিল। শ্বাপদও ছিল, সাপও ছিল। ছবিতে কিন্তু আমার সুন্দরই লেগেছে সেসব। বনদেবী নিজে অবশ্য এককালের বনটাকে শাপশাপান্ত করেই চলে। অনবরত। আচ্ছা... কেন? আমি তো শুনতে চাই না। কাকে শোনায় তবে? সুন্দরের কথা সে কদাচিৎ বলে। সে বলে লকলকে লালসার কথা, আদিম হিংসার কথা, বিভীষিকাময় গর্জন, হিংস্র আর্তনাদ আর নীরব অশ্রুপাতের কথা। বীভৎস আঁচড়ের বিবরণ শুনতে শুনতে কোন এক রাতে বোধ হয় আমারও বিশ্বাস উঠে গেল অরণ্যের সৌন্দর্যের ওপর থেকে। ওঠেনি?
সে জানিয়েছে ওই গাছ ফুল লতা পশুপাখি নিয়ে তার আক্ষেপ নাই। পাখি তো এখনো আসে। ফুল তো এখনো ফোটে। যা আসে না, যা ফোটে না তার জন্য মায়া আছে, আকুতি নাই। দুঃখ আছে, প্রেম একেবারেই নাই। আমার তো ভালো লাগা উচিৎ এসব শুনে।
আমি সমতলে গোলাপের চারা বুনেছিলাম। এখন যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা গোলাপ দেখি। এরই নাম এখন নন্দন। কখনো সাময়িক অবহেলায় আগাছা জন্মাতে দেইনি তা নয়। তবে জমতে দেইনি এখন পর্যন্ত। অপাত্রে দানের সুবিধা হলো গ্রহীতার একটা তাগিদ থাকেই নিজেকে প্রমাণ করার। অযোগ্যতা ঢাকা দিতে কসুর করি না। ভূমি বলে, সে তুষ্ট। সে এখন পূর্ণ। আগের ক্ষত সে ভুলে গেছে নতুন ভালো লাগার আবেশে। সে বলে সে সুখী। বাইরে থেকে কেমন দেখায় জানিনা, কিন্তু আমি যা করি, যতটুকু শ্রম দেই তার সবটাই আসলে নিজের জন্য। তবু তো বসুন্ধরা শোনায়, সে চিরকাল শস্যই নাকি ফলাতে চেয়েছে। বনমালী চায়নি। গেরস্ত চেয়েছিল। সে পুড়েছিল আমারই জন্য। বেশ।
নেহাত অজ্ঞ হলেও চলতে গিয়ে জানাশোনার মধ্যে দামী রত্ন কুড়িয়ে পাই। ভূমির খুব লজ্জা। এসব লুকিয়ে রাখে। হয়তো ভাবে দশজনে খোঁড়াখুঁড়ি করলে আমি হতভাগা বঞ্চিত হব। অথবা সত্যিই আদা-রসুন-পেঁয়াজে তার তৃপ্তি, খনির সুখ্যাতি সে সত্যিই চায় না। সে বলে সে ভালো আছে। সকলেই বলে জমিনটা এতদিনে সুন্দর দেখায়। কান না পাতলেও তার গান শোনা যায়। আমি যে ভালো আছি সে কথা তো বলাই বাহুল্য।
ভূমি এখন প্রাচীর তোলার কথা বলে। কাজটা আমার ধর্মবিরুদ্ধ তাও সম্মত হয়েছি। ভূমি অট্টালিকা তুলতে বলে। বনভূমি উজাড় করে অট্টালিকা! তাতেও সম্মত হয়েছি। আমি ভূমিকে ভালোবাসি। কে জানত যাযাবরও যে নিজের অজান্তে একটা স্থায়ী সমাধি খোঁজে। আমি এই শীতল সবুজ নরম মাটিতে আশ্রয় পেয়েছি। জীবনে প্রথম একটা ঠিকানা পেয়েছি। আর কোথাও ঘুরে দেখার লোভ নাই, শক্তি নাই, ইচ্ছা নাই। এখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
তাই বলে বনাঞ্চলের সব চিহ্ন বিলীন হয়নি। সীমাহীন প্রান্তরের পুরোটা জুড়েই যে ছিল। কোথাও পোড়া নমুনা পেলে আজও আমার কষ্ট হয়। চোখ ধাঁধান নমুনাও কি কম? প্রশংসা করলে সে কষ্ট পায়। ধরিত্রী চায় না আমি আগের কিছুতে মুগ্ধ হই। নাকি চায়, এটাও জানিনা। অবাক হয়ে দেখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র পাথুরে মন্দিরের অবশেষ। খোদ খোদাইকর ছাড়া আজতক সে ভাষার পাঠোদ্ধার করতে পারে শুধু একজনই। সবটাই মিথ্যা হয়ে গেছে, না? সে বলেছিল, পূজা হয়নি। আমি কিন্তু পূজার সরঞ্জামও পেয়েছি। তখন বলেছিল, পূজা দিয়ে করবটা কী। দ্বারে দাঁড়িয়ে ভাবি স্বর্গীয় প্রেম ছাড়া কেউ এমন মূর্তি গড়তে পারে! শুনেছি ওই একই কারিগর লোকালয়ে অমনটা গড়েছে আরো অনেকের ছাঁচে। আচ্ছা এরকমও সম্ভব? আজকাল কিন্তু শুনছি দেশান্তরে শিল্পী যাতেই হাত দেয় তাতেই অপ্রতিসম আদল আসে। পূজিতা বলেছে কাজের কিছু থাকলে তা রেখে আর সব গুঁড়িয়ে দিতে। কিন্তু যা গড়তে পারিনা তা ভাঙতে আমার গড়িমসি আসে।
কখনো বা ঘুমঘোরে তাকে তার অরণ্য ফিরিয়ে দেয়ার মিথ্যা স্বপ্ন দেখেছি। অবশ্য স্বপ্নের কথাটা মুখ ফসকে জানিয়ে আমাকে দিব্যি দিতে হয়েছে। বনচারীর পাপাচারে সে বনটাকেই এখন ঘৃণা করে। ঘৃণা করে তো। যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তাকেই কি সব থেকে বেশি ভালোবাসা সম্ভব? আচ্ছা আশ্চর্য, সেটা তো আমার নিছকই স্বপ্ন। আমি তো জানি দণ্ডকারণ্যে অট্টালিকা স্থাপন আমার জন্য খুব কঠিন না। কিন্তু এর বিপরীতটা চাইলেও কখনো সম্ভব না। আর চাইব বা কেন। আমার কী হবে। কে না স্বার্থপর - এই দোহাই দিয়ে আজকাল আমিও সেই দলে। তাছাড়া এই ভূমি আমাকে ভালোবাসে। নিশ্চয়ই বাসে। আমার জন্যই তো সে উর্বরা।
প্রকৃতির যেটুকু অদৃশ্য সেটুকু নিয়ে সময় গড়াতে চাই না। সহস্রাব্দ আসে যায় কিন্তু ওর কোনো মীমাংসা আসে না জানি। আমার বরং আজকাল জমির নকশা, মাপজোক, প্রাসাদের পরিকল্পনা করে বেলা যায়। অবসরে তার রূপ-রস-গন্ধে মাতি। ধরায় অন্ধকার নামলে লাঙলটাকে মাটির কোলে রেখে নিজেকে মৃত নক্ষত্রে মুগ্ধ হয়ে ঘুমাতে বলি। কখন কোন অমৃতের কলকল ধ্বনিতে প্রাণ চঞ্চল হয়ে ঘুম ভাঙে। মনে পড়ে এখানেই না কোথাও একটা সরোবর ছিল। ছিল তো। স্বচ্ছ নীল জলের একটা সরোবর। জেগেছিল একটি নিষ্পাপ পদ্ম প্রথম ও শেষবারের মতো। আছে না এখনো? ধার ঘেঁষে রক্তিম বুনো ফুল ফোটে না এখনো? চোখের ভেতর ভাবতে ভয় পাই, অথচ চোখ মেলে একটাবার দেখার ক্ষীণ-তীক্ষ্ণ লোভ। শুধু একবার। আমি বা আর কেউ তাকে মাটিচাপা দিয়েছি ভাবতে পারি না। হতেও তো পারে, এই ভূমি তার সরোবরটাকে কোথাও লুকিয়ে এখন ভুলে গেছে। না, হদিস দাবি করি না তো। করবও না কোনদিন। এখনো রয়ে যায় যদি, এই এখানেই তাকে পেয়ে যাব কোথাও একদিন। পাব না? একবার?
নাকি... অতলের মানচিত্র নিয়ে যে ফেরারি হয়েছে তারই সাথে হারিয়েছে ওই তলের সন্ধান।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন