কসাই 'আল্লাহু আকবর' বলে চেঁচিয়ে উঠতেই শেষ চেষ্টা করল ধলু। তার চেষ্টা সফলও হলো, ছুটে বেরিয়ে এল দড়ি ছিঁড়ে। তারপর সোজা বেড়ার বাইরে। বেরিয়ে এসেও স্বস্তি নেই। বাড়ির কর্তা সহ আরও চাকর-বাকর, কসাই সবাই ছুটে এল। ধলু প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। এ পাড়ার মানুষেরা বড় সাংঘাতিক। ফি-বছরই এ সময় তারা খুব আনন্দ করে পশুপাখির গলা কাটে। কী মজা পায় কে জানে! তেমনই এ পাড়ার এক লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। এর আগে সে যে বাড়িতে থাকত তারা খুবই ভালো ছিল। রোজ পেট ভরে খাবার খাওয়াতে পারত না তাও সে চিৎকার করত না। খুব ক্ষিদে পেলে নিঃশব্দে কাঁদত। সেই বাড়িতেই তার জন্ম হয়। তার মা ছিল কালো। তার ভাইবোনেরাও মিশমিশে কালো। দু'জন আবার সাদাকালোও ছিল। কেবল সেই ছিল ধবধবে সাদা। মালিকের ছোট্ট ছেলে মানিক আদর করে নাম রেখেছিল ধলু। বাকিদের কারো নাম তার মনে নেই। তবে এক ভাইয়ের নাম ছিল বোধ হয় কালু। মানিক তাকে যেমন খুব ভালোবাসত তেমনি সেও। তার মালিক মিজান সাহেবও তাকে খুব ভালোবাসত। কিন্তু এই মানুষটি টাকার জন্য কেমন নিষ্ঠুর হয়ে গেলেন। অভাবে পড়ে তাকে বিক্রি করে দিলেন হাটে। তার খুব মন খারাপ হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগল মানিকের কান্না দেখে। হাট থেকে তাকে কিনে নিলেন এক ভদ্রলোক। সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে আসা হলো তাকে। প্রথমটা সে খুব খুশিই হয়েছিল তবে ক'দিন বাদেই সে বুঝল, তাকে আনা হয়েছে মেরে ফেলার জন্য। ধীরে ধীরে একদিন সেই দিনটি চলে গেল। আগের রাতে সে খুব করে কাঁদল। তারপর ব্যাকুল হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল। পৃথিবীতে কত জনে কত রকম বিপদে পড়ে। হয়তো সেজন্যই ঈশ্বর এই ক্ষুদ্র জীবটির দিকে ফিরেও তাকালেন না। তার পরদিন তাকে দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে ফেলা হলো। মস্ত একটা ছুরি হাতে এক লোকের পাল্লায় পড়ল সে। দড়ি ধরে সে অনেক টানাটানি করল, কোনো লাভ হলো না। এরপর সে কাকুতি মিনতি শুরু করল। তাতেও কোনো লাভ হলো না। এরপর ক্ষেপে গিয়ে সে শেষ চেষ্টা করে দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ল। সে আসলে একজন ছাগল। তবে সে ছাগল হলেও বুদ্ধি কিছুটা কম নয়। তার বুদ্ধি দিয়েই সে তাড়া করা মানুষগুলোকে বোকা বানাল। সে জানত রাস্তা দিয়ে দৌড়ালে বিপদ হতে পারে তাই সে বাঁশবনের ভেতর ঢুকে পড়ল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। সে বুঝতে পারল যে মানুষগুলো তাকে খুঁজছে, পাতার মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। একটু পরে সে মুখ বের করে তাদের দেখতে পেল না। আস্তে আস্তে সে বেরিয়ে এল। না কেউ নেই। অর্থাৎ মুক্তি! মুক্তি! কী যে আনন্দ হলো তার। খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল সে। এবার দৌড় সেই চেনা রাস্তার চেনা বাড়িটার দিকে। শেষ পর্যন্ত সে পৌঁছে গেল বেড়ার সামনে। ব্যাঁ ব্যাঁ করে চেঁচাতে লাগল। ওদিক থেকে বাড়ির কর্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন, দেখ তো সোনামানিক আমার, ছাগল এলো নাকি সব গাছ নষ্ট করে দেবে।' অমনি তার চিরচেনা একটা কণ্ঠ শুনতে পেল। 'হ্যাঁ মা, ভুলুদের বাড়ির ছাগল বুঝি।' হঠাৎ মানিক গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, 'ওমা! এ তো দেখি আমাদের ধলু।' দু'জনের চোখ দিয়েই জল বেরিয়ে পড়ল। মা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মিজান সাহেবও খুব খুশি হলো। কিন্তু…। এ খুশির কারণ অন্য। মিজান সাহেব আল্লাহকে অজস্র ধন্যবাদ দিল। গরীব মানুষ তারা। কোনবারই কোরবানী দিতে পারেন না। এবার বুঝি আল্লাহর দয়া হলো। এক ঢিলে দু'পাখি। সঙ্গে সঙ্গে বেঁধে ফেলল তাকে। তারপর সে নিজেই চেঁচিয়ে উঠল, 'আল্লাহু আকবর।' তারপর
তারপর আর কি… গল্প শেষ।
[১৩/১২/০৮ সালে গল্পটা লিখি আমি। অনুমেয় কারণে কোনো বইয়ে একে স্থান দেয়া যায়নি। শিশু হাতের যাবতীয় ভুল-ভ্রান্তি অবিকল রেখেই প্রকাশ করলাম।]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন