এডয়ার্ড ময়ব্রিজ
স্থির আলোকচিত্র থেকে চলচ্চিত্রের দিকে অগ্রযাত্রায় প্রথম সফল পদক্ষেপ রাখেন যে ব্যক্তি তার নাম এডয়ার্ড ময়ব্রিজ। একজন ভীষণ প্রতিভাবান পাগলাটে অ্যাংলো আমেরিকান, যিনি তার সিনেম্যাটিক বৈচিত্র্যময় জীবনে ওয়াশিং মেশিন উদ্ভাবন করেছেন এবং খুনের দায়ে কাঠগড়াতেও দাঁড়িয়েছেন। যদিও তাকে নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো রেসের বাজি আর চলন্ত ঘোড়ার ছবি তোলার গল্প। ১৮৭২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাক্তন গভর্নর লিলেন স্ট্যানফোর্ড এক অদ্ভুত বাজি ধরে তা প্রমাণের জন্য চিত্রগ্রাহক ময়ব্রিজের শরণাপন্ন হন। বাজিটা ছিল, একটি ঘোড়া দৌড়কালীন কোনো সময়ে মাটি থেকে তার সবগুলো খুর শূন্যে তোলে কিনা। প্রায় পাঁচ বছর নিরন্তর প্রচেষ্টার পর ১৮৭৮ সালের জুন মাসে ময়ব্রিজ এই দাবি পুরোপুরি প্রমাণ করতে সফল হন এবং একইসাথে আবিষ্কার করেন চলমান ছবি তোলার নতুন প্রযুক্তি। এই বিশেষ কায়দায় রেসের ট্র্যাকে এক ডজন ক্যামেরা পরপর এমনভাবে রাখা হয়েছিল যাতে করে ছুটন্ত ঘোড়ার শরীরের স্পর্শে একেকটা ক্যামেরার শাটার চালু হয়ে যায়। ফলাফল চমকপ্রদ। এই সিরিজটি ‘দি হর্স ইন মোশন’ নামে প্রকাশিত হয়ে অচিরেই শিল্পী, সমালোচক ও প্রাণীবিদদের ভেতরে সাড়া ফেলে দেয়। ময়ব্রিজ কিন্তু থেমে থাকেননি। তিনি এই ছবিগুলি গতিময়ভাবে প্রদর্শনের জন্য উদ্ভাবন করেন জুপ্র্যাক্সিস্কোপ নামের এক যন্ত্র। তবে ময়ব্রিজের সবচেয়ে প্রভাবশালী কীর্তি সম্ভবত পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘অ্যানিমেল লোকোমোশন’ শিরোনামের কাজগুলি। স্টুডিওতে মানুষ ও ফিলাডেলফিয়া চিড়িয়াখানায় পশুপাখির প্রায় লক্ষাধিক ছবি তোলেন ময়ব্রিজ। ময়ব্রিজের গবেষণা তাকে চলচ্চিত্রের দিকে অনেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় যখন তিনি মোটরযুক্ত ক্যামেরা উদ্ভাবন করেন। ফলে আর ছবি তোলার জন্য সাবজেক্টের সংস্পর্শের প্রয়োজন থাকল না। জুপ্র্যাক্সিস্কোপে সেসব ছবি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে উনি পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক সিনে প্রদর্শনী শুরু করেন।
টমাস এডিসন
লুমিয়ের ভার্তৃদ্বয়
জর্জ মেলিয়ে
লুমিয়েরদের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন ফ্রান্সেরই একজন জাদুকর যার হাত ধরে চলচ্চিত্র এক বিরাট মোড় নেয় প্রামাণ্য থেকে কাহিনীচিত্রের দিকে। নাম তার জর্জ মেলিয়ে। উনি লুমিয়ের ভাইদের অনুষ্ঠান দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে সিনেমাতোঘাফ কেনার প্রস্তাব দেন। যদিও তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখাত হয়েছিল। তিনি নিজের জাদুর ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে সর্বস্ব বাজি রেখে ১৮৯৭ সালে তৈরি করেন তার নিজস্ব স্টার ফিল্ম কোম্পানি। উনি যে ক্যামেরাটা ব্যবহার করতেন সেটাও তার নিজেরই তৈরি, একটা প্রজেক্টরের বিপরীত কর্মকৌশল অনুসরণের মাধ্যমে। তিনি নিজেই তার চলচ্চিত্র পরিচালনা করতেন, সম্পাদনা করতেন এবং অভিনয়ও করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এরকম প্রায় ৫০০ চলচ্চিত্রের জনক ছিলেন মেলিয়ে। চিত্রগ্রহণ চলাকালীন ক্যামেরা চালু-বন্ধ করার মধ্য দিয়ে উনি ‘ট্রিক ফটোগ্রাফি’ আবিষ্কার করেন। ১৯০২ সালে মুক্তি পায় তার ৩০ দৃশ্যের কাহিনীচিত্র ‘লো ভোয়াজ দঁ লা লুন’। এই ছবি তাকে আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। দ্রুতই লুমিয়ের ভাইদের 'আকচুয়ালিতে'র দিন শেষ হয় এবং কাহিনীচিত্রের জয়জয়কার আরম্ভ হয়।
এডউইন এস পোর্টার
আমেরিকাতে মেলিয়ের ‘লো ভোয়াজ দঁ লা লুন’ ছবির অনুলিপি করে সেসবের অবৈধ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন আর কেউ নন টমাস আলভা এডিসন। এবং এই নকল করার দায়িত্ব তিনি দেন তারই কোম্পানির এক মেধাবী প্রকৌশলী এডউইন এস পোর্টারকে। মেলিয়ে দ্বারা প্রভাবিত এবং এডিসন দ্বারা আদিষ্ট হয়ে ১৯০২ সালেই পোর্টার তৈরি করেন ‘দি লাইফ অফ অ্যান আমেরিকান ফায়ারম্যান’। তার ছবিতেই আমরা দেখতে পাই পৃথক পৃথক শট ব্যবহার করে কাহিনীর ধারাবাহিকতা নির্মাণ করতে। ১৯০৩ সালে, পর্দায় অরৈখিক গল্প বলার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত নির্মাণ করেন পোর্টার, তার ‘দা গ্রেট ট্রেইন রবারি’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। মেলিয়ের দেখানো পথ ছেড়েও তিনি অনেকখানি এগিয়ে গেলেন সিনেমায় সমান্তরাল কাহিনী বিন্যাস, ক্যামেরা প্যানিং আর ক্রস কাটিং ব্যবহার করে। প্রথমবারের মতো আমরা দেখলাম যে, পর্দায় একটি গল্প বলার জন্য একটানা একই সময় একই জায়গার কাহিনী না দেখালেও চলে। ‘দা গ্রেট ট্রেইন রবারি’ এত দর্শকপ্রিয় হয় যে পরবর্তীতে স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ খোলা কিংবা চলচ্চিত্রের একটি বাণিজ্যিক শিল্প হিসাবে গড়ে ওঠায় এটি সরাসরি প্রভাব রাখে। ১৯০৯ সালে এডউইন এস পোর্টার এডিসনের কোম্পানি ছেড়ে দেন এবং স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৯১৫ সালে মুক্তি পাওয়া তার সর্বশেষ ছায়াছবি ‘নায়াগ্রা ফলস’ ছিল বিশ্বের প্রথম অ্যানাগ্লিফ ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র।
ডেভিড ওয়র্ক গ্রিফিথ
পোর্টার যখন এডিসন কোম্পানি ছাড়বেন, তার আগ দিয়ে তার কাছে একজন তরুণ আসেন সিনেমায় অভিনয় করতে। খুব সাধারণ একটা চলচ্চিত্রে তাকে সুযোগও দেয়া হয়। অভিনয় করতে করতেই তিনি এক সময় হাত দেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। তার পরিচালিত ১৯১৪ সালের ‘দি বার্থ অফ অ্যা নেশন’ আজ অবধি চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম বিতর্কিত ছবি। একইসাথে একে বলা হয় ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের সূচনা। প্রচলিত দুই রিলের সিনেমা থেকে বেরিয়ে উনি নির্মাণ করেছিলেন প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি। তাছাড়া লং শট, ফুল শট, ওয়াইড শটের ব্যবহারও তিনিই শুরু করেন। সোভিয়েত তাত্ত্বিকদের নামকরণের ১০ বছর আগেই তিনি ফিল্ম মন্তাজের প্রয়োগ করেন। 'দি বার্থ অফ অ্যা নেশন' তার বর্ণবাদিতার জন্য যতটা আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিল, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব রেখেছিল, সে তুলনায় পরবর্তী চলচ্চিত্র 'ইনটলারেন্স' ততটা সাড়া ফেলতে পারেনি। পূর্বসূরির বিপরীতে ১৯১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ছায়াছবিটি ছিল অত্যন্ত উদার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এটি ব্যবসাসফল হয়নি। অথচ তার শত্রুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে ছবিটি এমন প্রভাব রাখে যে চলচ্চিত্রের শিল্পরূপকে তা স্থায়ীভাবে বদলে দেয়।
লেভ কুলেশভ
রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবার সিনেমাকে পড়াশোনার একটি বিষয় হিসেবে উপলব্ধি করে। বিপ্লবের পরপরই সদ্য সংগঠিত রাষ্ট্রের নায়ক ভি. আই. লেলিন ঘোষণা দেন, সমস্ত শিল্পমাধ্যমের মধ্যে চলচ্চিত্রই সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। ভি.জি.আই.কে. বা মস্কো ফিল্ম স্কুলে শুরু হয় 'সেলুলয়েডবিহীন ফিল্ম' তৈরির চর্চা। এই চর্চার পুরোভাগে ছিলেন সিনেমার শিক্ষক লেভ কুলেশভ। কোনভাবে তার হাতে আসে গ্রিফিথের 'ইনটলারেন্স' ছবির একটি কপি। কুলেশভের কর্মশালায় একেই নানাভাবে কেটেকুটে, শট অদলবদল করে বসিয়ে, পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি কুলেশভ ইফেক্ট আবিষ্কার করেন। যদিও 'বাই দ্য ল' (১৯২৬)-এর মতো ছবি তিনি পরিচালনা করেছেন তবুও তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান চলচ্চিত্র শিক্ষার একজন গুরু হিসাবেই।
আইজেনস্টাইন ও পুদোভকিন
কুশেলভের দুই কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সের্গেই আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্র নির্মাণের আগেই 'মনতাজ অব অ্যাট্রাকশন' লেখার দ্বারা তাত্ত্বিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯২৪ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম ছবি 'স্ট্রাচকা'। ১৯০৫ সালের বিপ্লবকে উপজীব্য করে আইজেনস্টাইন নির্মাণ করেন 'দি ব্যাটেলশিপ পটেমকিন' (১৯২৫)। যার বিখ্যাত ওডেসা স্টেপ সিকোয়েন্স চলচ্চিত্র ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত সিকোয়েন্স। আইজেনস্টাইনের মন্তাজ তত্ত্বের - বিশেষ করে ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজের - সফল প্রয়োগ দেখা যায় তাঁর ছবিতে।
কুশেলভের আরেক শিষ্য সভেদলভ পুদোভকিন চলচ্চিত্রের তত্ত্বীয় জগতের বাইরে স্বল্প পরিচিত। তিনি চলচ্চিত্র সম্পাদনার পাঁচটি কৌশল বর্ণনা করেন: বৈপরীত্য, সমান্তরবাদ, প্রতীকবাদ, যুগপততা (ক্রস কাটিং), ও লেইট মোটিফ। নির্মাতা হিসাবে পুদোভকিনের হাতেখড়ি হয় 'মাত' (১৯২৬) সিনেমা দিয়ে। পরের বছর মুক্তি পায় 'দি এন্ড অব সেন্ট পিটার্সবার্গ'। আইজেনস্টাইনের ছবিতে যেরকম বৃহৎ প্রেক্ষাপটের রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক আখ্যান গুরুত্ব পেয়েছে তার বিপরীতে পুদোভকিনের চলচ্চিত্র অনেকটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ১৯২৮ সালে অক্টোবর বিপ্লবের এক দশক পূর্তিতে দুইজনকেই দায়িত্ব দেয়া হয় চলচ্চিত্র নির্মাণের। তার প্রেক্ষিতে আইজেনস্টাইন ও পুদোভকিন যথাক্রমে 'অক্টোবর' ও 'স্টর্ম ওভার রাশিয়া' তৈরি করেন। স্তালিন প্রশাসনের আমলে তারা উভয়ই নানারকম বিধি নিষেধের সম্মুখীন হন। তাদের ছবিকে শুদ্ধবাদী বলে আখ্যাও দেয়া হয়। ১৯৩২ সালে 'আ সিম্পল কেস' ছিল পুদোভকিনের তৈরি প্রথম সবাক চলচ্চিত্র, সোভিয়েত সেন্সর বোর্ড যার শব্দ কর্তন করে দেয়। পরে তিনি আরো কিছু সবাক ছবি বানিয়েছিলেন।
দোভজেঙ্কো
ইউক্রেনের এক কৃষক পরিবারে জন্ম নেন অলিয়েক্সন্দর পেত্রোভিচ দোভজেঙ্কো। তাঁর ছবিতে উঠে এসেছে একেবারেই প্রান্তিক জনের কথা। তাঁর ইউক্রেন ত্রয়ী 'যোয়ানেহোরা' (১৯২৮), 'আর্সেনাল' (১৯২৯), ও 'যেমলিয়া' (১৯৩০) নির্বাক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র। এর মধ্যে শেষ দুইটি যথাক্রমে 'আর্সেনাল' ও 'আর্থ' নামে পশ্চিমে বিখ্যাত হয়। মূলত তাঁকে দিয়েই তিরিশের দশকে সোভিয়েত চলচ্চিত্র শিল্প আন্তর্জাতিক পরিচিতি পায়। যদিও তাঁর বেশিরভাগ চলচ্চিত্র সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের অপ্রিয় হয়। চরম উত্থান-পতন ও ঘটনাবহুল জীবনে দোভজেঙ্কো নিজে হাতে ছবি নির্মাণ করেন মাত্র সাতটি। ছবি ও চিত্রনাট্যের বিষয়বস্তুর জন্য এই মেধাবী পরিচালককে যেমন রাষ্ট্রের সাথে বিরোধে দেখা গেছে, আবার 'অর্ডার অব লেলিন'-সহ একাধিকবার তিনি ভূষিত হয়েছেন 'স্তালিন পুরস্কারে'। নির্মাতা হিসাবে তাঁর শেষ কাজ ছিল জীবনী চলচ্চিত্র 'মিচুরিন'।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন