ইন্দ্রদা সেদিনকার ছবি দেখে বলেছিলেন আমাকে গোলাপি শাড়িতে মানায়। খুব সহজভাবে বললেন—বৌদির সামনেই। তার পক্ষেই সম্ভব এভাবে বলা যেহেতু লোকটার মনে কোনো দাগ নাই। নিষ্পাপ বলেই এত সুন্দর ছিল বলাটা। আমার যে মন—এদিককার লজ্জা সামলাতে সামলাতেই চোরা চোখে বৌদির প্রতিক্রিয়া দেখে নিয়েছিলাম। অমায়িক। স্বাভাবিক না?
অথচ আমি এরকম কল্পনাও করতে পারি না। না, আমি বৌদির চেয়ে কম সুন্দর নই—বরং উল্টা, রঞ্জুই বলে—তবু যে জানি কারো প্রতি রঞ্জুর এরকম প্রশংসার অর্থ সেই মেয়ের সাথে ও বিছানায় যেতে চায়। বৌদির জায়গায় আমি হলে প্রার্থনা করতাম আমার স্বামীর যেন সেই ডাইনির সাথে মোলাকাত না-হয় আর কোনোদিন। অসহ্য।
বৌদির কী ভাগ্য। ভাবনাটা আমাকে পোড়ায় অস্বীকার করব না। এই ভাবনাটা: আমাদের পৃথিবীতে বিশ্বস্ত পুরুষ বলে কোনো সৃষ্টি আছে, অথচ আমার কপালে তা জোটেনি। বিশ্বস্ত, যত্নবান, সমঝদার। বৌদি অনর্গল স্তুতি করতে পারে মানুষটার—আমি শুনি, ভালোও লাগে—কিন্তু আমি পারি না আমারজনকে নিয়ে ওভাবে বলতে, পারব না, কোনোদিন পারিনি। ওই যে ইন্দ্রদা বিভিন্ন জনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন, যুবতীরাও আছে তাদের মধ্যে। বৌদি একদম নিশ্চিন্তে আরেক জায়গায়। আমি হলে সেঁটে সেঁটে থাকতাম রঞ্জুর সাথে। একটু আড়াল পেলেই একটা ফ্লার্টজাতীয় মন্তব্য করে বসবে কাউকে নিয়ে।
‘দাদা ওই পেইন্টিংটার সামনে ছবি তুলব।’
‘ওটা ভাল্লাগল?’
‘আসেন—’
বলতে চাচ্ছিলাম, আপনি ওইদিন যে শাড়িটায় মানায় বললেন সেটা পরেছি। বললাম না। নিজের মনে আপত্তিকর শোনাল কথাটা। রঞ্জুর আশপাশে ঘুরঘুর করা সস্তা মেয়েগুলি যেমন বলে। আমার মন চাচ্ছিল ইন্দ্রদা খেয়াল করুক। আর কিছু না, আরেকবার সুন্দর বলতে হবে না, স্রেফ খেয়াল করুক। শিল্পকলার এই আলোর কারণে গোলাপিটাকে ট্যাঞ্জারিন দেখাচ্ছে। বাইরে বেরলে নজরে পড়বে হয়তো। কখন বেরব। আচ্ছা, এই আলোতে কি সুন্দর দেখাচ্ছে না তার মানে?
‘রঞ্জু এলো না?’ দাদা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হ্যাঁ, রঞ্জুর হাসির মতো মাদকতা নাই, কিন্তু অন্যরকম স্বচ্ছ-শুভ্র তার হাসি।
আমি রঞ্জুর কথাটা বললাম। ইন্দ্রদা চাইলেই এখন একটা বাজে মন্তব্য করতে পারতেন ওকে নিয়ে। করলে আমি খুশিও হতাম। কিন্তু কখনো করেন না এ কাজ। বিস্ময়কর দায়িত্ববোধ তার। এজন্যই এত শ্রদ্ধা করি লোকটাকে। শুধু আমি না, যেকোন মেয়েকে বল, ইন্দ্রদার সাথে কাজ করতে খুবই নিরাপদ বোধ করে। রঞ্জুর প্রতি এই শ্রদ্ধা আসে? উনি বললেন, ‘দেখ অফিসের কাজে আটকা পড়েছে হয়তো।’ যদিও দু’জনই জানি এটা একটা কথার কথা।
‘ওমা কী মিষ্টি দেখাচ্ছে তোকে, এই, তাই না?’ বৌদি ঠিকই খেয়াল করলেন, ‘তা আমাকেও নে না ছবিতে!’
এতক্ষণে ইন্দ্রদা চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন আমি ছোট্ট মেয়েটা যেন। এবারে আমি একটু বিব্রতই হলাম। এই একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্যেও সেজেছি, চুড়ি পরেছি, টিপ দিয়েছি। নাহ। বেশ করেছি। আমার মনের শান্তির দরকার নাই? বৌদি শুনলে এবারও ঠিক বলবেন, ‘তুই বলেই ওই লম্পটটার সাথে আছিস এখনো।’
এই কিছুটা মুহূর্ত, ইন্দ্রদার কাছাকাছি, আমি একটু স্থিরতা পাই মনে। কোনো পুরুষকে ভক্তি করার স্বস্তি থেকে রঞ্জু আমাকে বঞ্চিত করেছে না? ও করেছে, আমার বাবা করেছে।
সন্ধ্যারও পর বাড়ি ফিরলাম। কী করব ফিরে। এসে দেখি পতিদেব ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। ‘কোথায় ছিলে—’ বলে উত্তর না-নিয়েই হাউমাউ করে কান্না শুরু করল।
‘কার সাথে শুইস রাতে?’
রঞ্জু আমার পায়ে পড়ল।
‘এই খবরদার, ছুঁবা না আমাকে।’
সরে গেল সাথে সাথেই, ‘আচ্ছা, না, ঠিকই আছে, তোমাকে ছোঁয়ার কোনো যোগ্যতা নাই আমার, কিন্তু বল তুমি আমাকে ক্ষমা করসো।’
‘ওকে ভালোবাস?’
‘নাহ!’ রঞ্জু দাঁড়িয়ে পড়ল সটান, ‘না—প্রশ্নই ওঠে না!’
‘ভালো।’
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘বললাম যে ছুঁবা না আমাকে! সরো। বৌদির সাথে থাকব এক সপ্তাহ, এক মাসও হতে পারে—জানিনা।’
‘না প্লিজ… আমি মারা যাব… প্লিজ যেও না আর… এবারের মতো… বিশ্বাস কর আমাকে…’ রঞ্জু পিছে পিছে আসছিল। আমি ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম ওর মুখের ওপর। নোংরা। বিশ্বাসঘাতক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন