দ্বিতীয় অধ্যায়
বারো বছর আগে এই স্টেশনটাকেই আর্তনাদ শুষে নেয়ার মতো প্রকাণ্ড মনে হতো। ফটকের ওপর লোহার যে ঐরাবত ছিল, নাটোর রাজবংশের প্রতীক, জমিদারি প্রথার সাথে সাথে তারও উচ্ছেদ ঘটেছে। প্লাটফর্মের উল্টোদিকে আতা গাছের যে বনটা—নাই—এখন সামান্য ঝোপঝাড়। দেশভাগের পর লোকের আনাগোনা—সাথে নতুন রাস্তা, কারবার, কারখানা— স্টেশন রোডের ধারেই কারবালা—নাকি সেই সুদূর মগধ ও মিথিলা থেকে এসে বসতি গড়েছে।
‘যে নাটোর দেখে গেছিস—’ ছিগড়ু দুই দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, ‘মানুষ এখন নিঙরে খাচ্ছে শহরটাকে।’
বদলে গেছে, হ্যাঁ। তবু জানালার বাইরে একেকটা ক্ষেত সাঁ সাঁ পেছনে ফেলে নাটোরের যত কাছে এগিয়েছি ঢিপঢিপ বেড়েছেই। তবু প্লাটফর্মে পা রাখতেই সারা শরীর টলে উঠেছিল… এত সুন্দর এত সুন্দর… এই বুঝি পড়ে গেলাম। তবু অরণ্যের একেবারে গভীরে, অনেক দূর শিকড় গেড়ে বসা যন্ত্রণার মহীরুহ মোচড় দিয়ে জানিয়েছে, এখনো আছি। এখনো আছে। আমার শ্বাস আটকে যায় এখনো—সেই নাটোর, সেই রূপ, সেই ব্যথা…
স্টেশনের বাইরে বাজার বসে এখন। কাঁচাবাজারের দিকে প্রথম ঝলক তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি, ‘ছিগড়ু একটু আস্তে হাঁট্ না ভাই—’ ডালিতে ডালিতে উপচে উপচে পড়ছে প্রকৃতির আশীর্বাদ—আর কোথায়—কোথায় আর দেখেছি ভারতবর্ষে? ঠিকই তো, ছিগড়ু বারো বছরে আরো তাগড়াই হয়েছে। আমাকে বলছে রোগা হওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পরিবর্তন নাই।
ওই যে বেদে বুড়ি ঢুলছে, কবে শুনেছি বয়স একশ পার, একটা টকটকে লাল কম্বল থেকে হঠাৎ মাথা তুলে ভুরু কুঁচকে তাকায়।
‘এলি? খুঁজে দ্যাখ পাস কিনা—’
প্রথম অধ্যায়
বয়স তখন বারো। যুদ্ধ এখান থেকে কত ক্রোশ কে জানে অথচ পায়ে পায়ে লাশ বাধত। কাজের খোঁজে হয়রান বাপজান, নিরুপায়, আমাকে ছোট মামার সাথে পাঠিয়ে দিলেন। নাটোর—আলাদা—একেবারেই আলাদা একটা পৃথিবী। একেকটা গাছ ফলের ভারে নুয়ে থাকে। চলনবিলে একবার জাল ফেললে মাছের ভারে ছিঁড়ে যায় যায়। ছেলেপুলে যেকোন জায়গায় খলই ডোবালে কই, রুই, শিং, ট্যাংরা, পাবদা… সপ্তাহ না-ঘুরতে মামাবাড়ির আদর-আহ্লাদে আমার চেহারাই চেনা যায় না।
উদ্দাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছি ছিগড়ু আর পাড়ার ছেলেপেলেদের সঙ্গে। অভিযাত্রীর নেশা নিয়ে আবিষ্কার করছি কোথায় কোন সুড়ঙ্গ, পাথরের গায়ে সাঁওতালি আঁকিবুঁকি, গাছের ফোঁকরে পটুয়াদের পুতুল। বড়দের বারণ কী কম। লাল-সোনালী ফড়িং—ধরা যাবে না; বনতুলসীর ফল—খাওয়া যাবে না; ভুরুই পাখির ডিম—হাত দেয়া যাবে না… ভুল করেও সাঁকো পার হওয়া যাবে না!
সাঁকো পারাপার নিয়ে চরণফকিরের সাথে বনদেবীর চুক্তি ছিল। কী যে ভয় পেত সবাই। লুকোচুরির সময় দৌড়ে নারদের ওই পাড়ে চলে যেতাম, নিশ্চিত নিশ্চিন্ত হয়ে যে পাড়ার ছেলেরা কোনোদিনও খুঁজতে আসবে না…
‘এলি? খুঁজে দ্যাখ পাস কিনা—’
দ্বিতীয় অধ্যায়
বড় মামার বয়স তো বাড়েনি একদিনও, ‘ওই পাশে তো প্রচুর পোড়ো জমি—সরকার সুগার মিলের জন্য ইজারা দিবে—ওই ধর আগামী মাসে এই কালভার্টের কাজটা শেষ হয়ে যাবে। তোকে আবার আসতে হবে না?’
কাঠের সাঁকোটা ভাঙছে। নাটোরের চেয়ে পুরাতন, তাই না? পূর্ণিমা তিথিতে সাঁকো ধরে আসতো বনবাসী ছায়ারা… এপাড়ে রাখা নৈবেদ্য নিয়ে যেত… আর ফেরার সময় রেখে যেত দীর্ঘায়ু, খিরিরের ফল। এই রাজ্যে কেউ বন্যা দেখেনি, খরা দেখেনি, ফসলহানি দেখেনি, কয়েকশ’ বছরে কোনো ভূমিকম্প হয়নি এখানে।
‘দিন দিন বরকত উঠে যাচ্ছে শহরটার উপর থেকে,’ নানিজান এদিকে বাটি উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছেন আমার পাতে, ‘মড়ক লাগবে বললাম যদি ওই পাড়ে হানা দেয় এরা। জাদু তুই সরকারকে বুঝায় বলতে পারিস না—’
নানিজানের বুঝি ধারণা—ওহ নানিজান—সরকার এখনো রাজার মতো কোনো কেউ; যাকে বুঝিয়ে বললেই কাজ হয়। শিং কাঁচকলার ঝোল থেকে মন কিংবা চোখ কোনোটাই না-সরিয়ে বললাম, ‘হুঁ, আচ্ছা—’
ছিগড়ুর বউ লেবু ছিঁড়ে এনে রাখল। লেবু…
প্রথম অধ্যায়
আমাকে প্রথম যেদিন হাতছানি দেয়—সেদিন রাজবাড়ির ছোট কুমারের দল জাপানি সৈন্য, আমরা গোরা। কেন গেলাম ওই পাড়ে? আমার উপাস্য, আমার ধ্বংস আমার অপেক্ষায় ছিল। কেন গেলাম? একবার পার হলে আমার পাত্তা পাবে না কিছুতেই। মহা দেওদারু, শীতলা মন্দিরের দেয়াল—পিছনে রেখে দে ছুট… ছুট ছুট ছুট… সাঁকো ধরে একেবারে নদের ওপাড়। পেরোলেই বাঁশ ঝাড়; নারদের ওই পাড় থেকে যার ঘন সবুজ দেখা যায়। দুই ধারে বুনো জামের সারি আর লতাপাতা জড়ানো একটা পায়ে চলা রাস্তা মাঝ দিয়ে… যেতে যেতে মিশেছে তালনের ওঝাদের সুরকির রাজপথে। আমার কৌতূহল আমাকে টেনে নিয়ে গেছিল পথের ধারে ওই বাড়িটার কাছে। সোনালী প্রাচীরের ফোঁকর দিয়ে যে বেহেশত দেখা যাচ্ছিল—ফটক পর্যন্ত না যেয়েই শরীরটাকে ফোঁকরে গলিয়ে দিলাম।
না ওই ভাস্কর্য, না ওই রঙের পাতা, না ওই ফুল-ফল-পাখি-প্রজাপতি—কোনোটাই পার্থিব ছিল না। কী সুস্বাদু লাল মরিচের মতো মিষ্টি ফল—রঙ্গনের মতো মধু—আর আমার চোখ যেয়ে আটকেছিল কমলা লেবুর মতো ফলটায়। সূর্যের আলোয় ঝকমক করছিল এক মুঠ গলিত ধাতু। খোসা ছাড়াতেই… ছাড়াতেই কেমন করে হাত থেকে গড়িয়ে পড়ল ঘাসের ওপর… দেখেছিলাম কুঁকড়ে শুয়ে আছে—প্রমাণ আকারের ওই মেয়েটা, হ্যাঁ!
‘প—রী!’ নিজের দিকে আঙুল তুলে বলেছিল—পরে ভাবলাম বনদেবীর মেয়ে—যেমন আমার গায়ে হাত রেখে বলেছিল, ‘মা—নুষ!’ ওই যেভাবে পৃথিবীর গর্ভ থেকে প্রথমে বার কয়েক মৃদু ধাক্কা দিয়ে জল ছিটকে বেরয়; মাটি কাঁপিয়ে ফোয়ারা ছোটানর আগে। ‘গাছ… ফুল… সূর্য…’ যেদিকে তাকায় প্রথম দেখার মুগ্ধ বিস্ময় তার। পিছনে একরাশ চুল—ঘাসের ওপর কালো মেঘ চলে ফিরে বেড়াচ্ছে যেন। আমার সামনে এসে থামে, তখনই, আমার গায়ে হাত রাখে নির্ভয়ে, ‘মা—নুষ!’
প্রথমদিন পরীর ত্বক ছিল কমলাভ। আমি চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম—ঝলসে দিচ্ছিল আমার দৃষ্টি। ওই প্রথম আমার কোনো নির্বাধ রমণীকে দেখা। সঙ্গে সঙ্গেই মাথা থেকে পা অবধি একটা ঝাঁকুনি খাই সজোরে। প্রথম দেখা কচুরিপানার মূলের মতো এক গোছা চুল; তার ত্রিভুজ আড়াল করে ছিল। আমার সামনে যখন সে দাঁড়ায়… ঈশ্বর… তার দুই স্তন—পরে খেয়াল হয়েছিল একদমই এক জোড়া কমলা লেবু—তাকিয়ে ছিল আমার দিকে! এ কী… পুরো নাটোরের রূপ কী করে এক দেহে মিশেছে এসে।
পরদিনই উঠান থেকে দত্তজার শাড়ি চুরি করে আনি। আমিও তাকাতে পারতাম না; তাছাড়া পরীর মধ্যেও লজ্জাভাব চলে আসে দ্বিতীয় সাক্ষাতেই। ক্ষুধাও। নিজেই রান্না করত। বাড়িটা বনদেবীর, ভিতরে নিখুঁত পারিপাট্য, বনদেবী মারা গেছে এটা নিশ্চিত, তারই আসবাব… তাদের যত হারিয়ে ফেলা নকশা। চরকা ছিল, সুতা ছিল—ছিল না কোনো শিল্প যা পরীর অজানা—শাড়ি বুনত বসে।
দ্বিতীয় অধ্যায়
পটল তাহলে এখন মেয়ের বাবা। পাড়ায় সমবয়সী বাকিরাও বিবাহিত। ছোট কুমার গতকালই সস্ত্রীক উঠেছে সার্কিট হাউসে। শুনলাম, শুনে অবাক হলাম, কুমারও আমারই মতো পাক্কা বারো বছর পর নাটোরে।
‘...বড় তরফ ওকে নাটোরছাড়া করে—সে যা কেলেঙ্কারি—কলকাতায় এক সাহেব বন্ধুর বাড়িতে ছিল, পরে আমেরিকা। কপাল দ্যাখ, সেই এস্টেটই আজকে নাই,’ গাড়িতে ছিগড়ু আমার পাশে, ‘এসেছে যে উত্তর বড়গাছায় ওর কিছু ব্যক্তিগত জায়গাজমি ছিল। পাকাপাকি যাওয়ার আগে আম কোম্পানির কাছে বেচে যাবে।’
আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, সব বন্ধুরা যাচ্ছে দেখা করতে, আরো অনেকেই যাচ্ছে। খুব ধীর-স্থির-শান্ত নাটোরই তো এক সময় দূর দূর করেছিল কুমারকে। আর কারণটাও—জানার পর মনে হলো—কেমন যেন, তাই না? আমার চেয়ে বছর চারেকের বড় ছিল। মাথাতেও বড়, বুদ্ধিতেও। ও-ই তো, হ্যাঁ, ও-ই প্রথম সন্দেহ করেছিল, ‘এই তুই রোজ কোথায় পালাস? সাঁকোতে উঠিস না তো?’
নিচা বাজারে এক জায়গায় শালুক নিয়ে বসত নেড়ে ভূত। ছোটবেলায় এত যে ছমছমে কৌতূহল ছিল, ঘুরেফিরে বারবার যেতাম, পাশ দিয়ে দিয়ে, কাছাকাছি না। বসে না এখন। ওরা নাকি জনসম্মুখে আসেই না এখন—ভূতেরা। উপর-বাজারে পৌঁছালে সজনে পাতার শহরটা টমটমের শহরে বদলে যায়। নানাজানের মাদ্রাসাটাকে এখন স্কুল করেছে। ছায়াবাণী হল সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেছে। মহারাজার আমলেও সড়ক বাতি ছিল বটে, এত ছিল না। কয়েক বছরের মধ্যেই পৌরসভা জুড়ে বিজলি সংযোগ চলে আসবে। আগে কিন্তু দেখতাম দুপুরে খেয়ে সবাই বিছানায় গড়িয়ে নিত। স্তব্ধ থাকত সব। বাইরের যারা—এই আলো-হাওয়ায় কয়েক বছর কাটলে এরাও অলস হবে, নয়তো আলো-হাওয়াকে বদলে দিবে, দিচ্ছে, বিল-টিল ভরাট করছে। এত চঞ্চল ছিল না, অথচ এত বিষণ্ণও ছিল না শহরটা।
‘…প্রিন্সেস—নিজ চোখে দেখেছে যারা তারাই কেবল বুঝতে পেরেছে কী সেই…’
আমার কোনো আগ্রহ নাই এসব আলোচনায়। গাড়ি চলে। আমি দেখছি পিছু নেয়া সূর্যটাকে, ক্লান্ত, ‘চোখ রেখো, কখন যে…’
শহরের এই প্রান্তটাকে আর চেনার সাথে মেলানো যায় না। নির্মীয়মাণ পাকা দালান—তাই বলে এত—এক বিঘৎ ছাড় দিবে না! রাজবাড়ি থেকে বেশি দূরে না সার্কিট হাউস। এত মানুষ...
যখন তার চোখমুখ জ্বলে উঠতে দেখেছিলাম, ‘মা—নুষ!’… তার আগে কখনো জানিনি আমার দিকেও বিশেষ করে তাকানোর আছে, আমি যে কেউ একজন, আমি যে… আমি!
প্রথম অধ্যায়
আমার বারো বছরের জীবনটাকে এক মহা প্লাবন এসে ভাসিয়ে দিল ডুবিয়ে দিল। এসে অবধি খেলাধুলা, খানাপিনা, নৌকাবাইচ, মাদার গান, হাজড়া নাচের আসরে যে আমি মত্ত তার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো ওই বাড়ি… ওই… ওই পরী।
যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, লুকাচুরি, সাঁতার, অথবা যেটাই হোক, আমি কোনো এক ফাঁকে পালিয়ে ওই বাড়িতে যাবই, পরীর কাছে যাবই। তখন, এবং আবার, দুপুরে সবাই যার যার বিছানায় গেলে, এমনকি সন্ধ্যাতেও, অনেক ভোরে, বোষ্টমীর করতাল উপেক্ষা করে এখানকার আরামপ্রিয় লোকেরা যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে… নেশা, আমার নেশা। মা-মরা ছেলে কখনো কি ভেবেছি আমার অপেক্ষায় কারো চোখ জলে টলমল করতে পারে। নারদের জলের মতো সেই চোখ, মিশকালো, চাইত বনজুঁইয়ের রেণুর মতো টানা টানা পাপড়ি মেলে।
নানিজানের রসুইখানা থেকে চুরি করে রান্নার জোগাড় দিতাম তাকে। খানচৌধুরীদের ভাঁড়ার যে বিশাল—এখনো কি তাই?—ধরা পড়ার প্রশ্নই ওঠে নি। নিরামিষ রাঁধত সে—বাগান থেকে মশলা সংগ্রহ ক’রে, ছেঁচে, ডলে, পিষে, বেটে—বার বছর গেল ওই স্বাদটার খোঁজে, দেশে-দেশান্তরে। তারপর পলাশ পাতার ছোট্ট বাটিতে নিয়ে যখন পরী আমাকে বলল, ‘খাইয়ে দেই?’ ভেবে পেলাম না খাইয়ে দেয়া সে কোথায় শিখেছে।
একটা একটা বই এনে দিতাম বাসার লাইব্রেরি থেকে। সে নিজে নিজেই পড়া শিখে যায়। আমার অনুপস্থিতিটা তাকে কাটাতে হতো ওভাবে। ফিরলে কখনো ইঁদারায় পিঠ ঠেকিয়ে সেসবই আবার অতি উৎসাহে পড়ে শোনাত… কেচ্ছাকাহিনী না, ওর জর্দা মেশানো গলার স্বরের মধ্যে আমি হারিয়ে যেতাম।
‘পাগলি, বললেই হলো বুঝি—’ বলছিলাম যখন আমার মাথা সযত্নে রাখা তার আঁচল বিছানো কোলের ওপর, আমি খুব কাছ থেকে ওর কিংশুক রাঙা ঠোঁটের নাড়াচাড়া দেখতাম, দেখতাম ওষ্ঠের তুলনায় অধরের পুরুত্ব এত বেশি… ‘বললেই হলো, আমার গায়ে অত জোর কোথায়, বুকে অত সাহস কোথায়—আমার বাপজান হোমিও ডাক্তার…’
‘না, তুই আমার রাজপুত্র, কোটালপুত্র, আমার বীরপুরুষ, আমার…’
‘উ?’
কমলা পরী অন্যদিকে চায়, ‘আমার স্বামী…’
‘আচ্ছা?’
‘হবি?’ আবার মুখ ফেরায়। পরীর কাঁধ বেয়ে নেমে আসা পদ্মার দুই শাখা, আমারই সাথে কোল ভাগাভাগি করে, আমি তার এক গাছি দখলে নিয়ে আঙুল দিয়ে আলাদা আলাদা করি, কাপড় থেকে সুতো আলাদা করার মতো। সেই চুলে মল্লিকহাটি মাঠে সদ্য গজানো ঘাসের সুঘ্রাণ। চোখ-নাক-মুখের ওপর ছড়িয়ে মরার মতো পড়ে থাকি। এর মধ্যে যদি মরতাম… যদি নন্দন কাননও জোটে, এর চেয়ে অন্যরকম কতটুকু হবে।
হাসতে হাসতে উঠে বসলাম, ‘এই… মেয়ে… স্বামী-স্ত্রীর কী বোঝো তুমি…’
কেননা আমারই তো এ জ্ঞান সদ্যলব্ধ। বিয়ের, সংসারের, বর কনের সত্যিকার চুক্তিটা জেনে গেছি। এখানে না। সেই কৃষ্ণনগরে। মিস্ত্রীপাড়ার ছেলেদের কাছে। পরীর হাতটা নিয়ে… মৃদুভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালাম, হাসতে হাসতেই… আমিই বা কোথায় শিখেছিলাম অমন। পাখি ডাকে—বউ কথা কও! পরী বসার ভঙ্গি বদলে হাঁটু আর থুতনি কাছাকাছি আনল। আমার কপাল থেকে একটা ঘাসের কুচি সরাতে যেয়ে… সরাতে যেয়ে আনত মুখে এমনভাবে তাকাল আমার চোখের দিকে—হে ঈশ্বর—তাই তো!
ওই যে চমকেছিলাম, পরেও অনেকবার চমকে উঠেছি—ওই চাহনি মনে করতে যেয়ে। এমনকি… এমনকি এখনো, এক্ষনো, আমার শরীর দুলে ওঠে। আমার জীবনের পরের অঙ্কগুলোয় মনে করার মতো আর কিছু ছিল না, নাই; অথবা ওই চাহনি এমনই রোমাঞ্চকর ছিল যে—ওই আরকি, গত বারো বছরে এত ছোটাছুটি, জোয়ারভাটার সবটাই নিরামিষ মনে হয়। আশ্চর্য। পরী ওভাবেই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। ও জানত। ও বরাবর জানত। জানারই তো কথা।
ওকে প্রথম নজর দেখার মুহূর্তটা—সবচেয়ে টগবগে হতে পারত যে স্মৃতি—ওটাই কেন সবচেয়ে ঝাপসা। ফুলের পাপড়ির মতো চারদিকে বিছিয়ে থাকা খোসার মাঝখানে সে হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে ছিল। এটুকুই। যখন তার শরীরে আবরণ ছিল না তখনো ঠিক সে জানত কোনটা ফুল, কোনটা সূর্য্য, কোনটা আমি মানুষ। ও বনদেবীর মেয়ে না? ও জানত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক—যা বেআব্রু, আদিম, আমি যদ্দুর জানতাম, শরীরের সাথে শরীরের যোগ—হয়তোবা আরো বেশি জানত। তৎক্ষণাৎ এমনভাবে লজ্জা পেল যেন কথাটা ও নিজে বলেনি।
আমি অতিজোর রক্তসঞ্চালন নিজের মধ্যে চেপে রেখে হাসি সহকারে তলিয়ে নিচ্ছিলাম। বিয়ে করতে চায় মানে কী? কতদিন ভেবেছে এসব? আমি তো ভাবিনি—সাহসই ছিল না—বরং ওর এই কথাচ্ছলে মনের ভাবনা বলে দেয়ায়, ও কতটা নিশ্চিত সেকথা জোর দিয়ে বলতে থাকায় আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম ওর থেকে।
‘ভালোবাসিস না?’
আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
‘তাহলে কী সমস্যা?’
অবিশ্বাস্য। আশাতীত। তাই খুশিতে বিহ্বল হওয়ার মতো—পরীর এই বাসনা—অথচ এই সৌভাগ্যকে বরণ করা আমার পক্ষে কি… আমি চিন্তিত হয়ে গেলাম।
‘আজই—’ পরী বলল, ‘আমি মালা গাঁথি তবে, এখনি।’
সময় নিলাম ভাববার। খামোখাই। আমার ওর আবেদন উপেক্ষা করার সামর্থ্য ছিল না, ইচ্ছা ছিল না, আমি পারতাম না। বাপজানের বাপজান তো আমার বয়সেই বিয়ে করেছিল। বাপজান আমাকে নিতে আসবে না যতদিন, পরী থাকবে যেখানে আছে এখন, সবার অগোচরে।
আমি কি ঘোরের মধ্যে আছি? এও কি সম্ভব? আমি হাঁটিনি এরপর একবারের জন্য, ছুটে লাফিয়ে চলেছি সর্বত্র।
দ্বিতীয় অধ্যায়
মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা গোলাকৃতির বৈদ্যুতিক বাতি-প্রজ্বলিত, কার্পেট ঘাসের এদিক-ওদিক ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে থাকা রেস্ট হাউসের লন তখন মানুষজনে গম গম করছিল। পুরাতন খেলার সাথীদের সাথে দেখা হলো। সকলেই মনে রেখেছে আমাকে। ‘কীরে ঘোটি একইরকম আছিস তো!’ বলছে। আমি সেই অভিশপ্ত ছেলেটা।
এখানে দাঙ্গা হয়নি, কী অদ্ভুত। স্বর্ণকার পট্টি অক্ষত। শহরতলীর আদি অংশ কেবল ছেড়ে গেছে জমিদাররা। এজন্যই এত মানুষ। মাথায়-পাগড়ি উর্দিপরা উর্দিভাষীরা চায়ের ট্রে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে জন্য আসা, তপাই ঢাকা গিয়ে বলেছিল, ‘আরেকবার যেও দাদা, মোহভঙ্গ হবে—’, হলো না তো। সত্যিই হলো না। একটুও না। বরং মনে হচ্ছে জরুরি অজুহাতে থেকে যাই বাড়তি। পরে আবার, এখন থেকে বারবার আসব। সে বুঝি আমার কোনো স্বপ্ন, কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেছে, মিশে গেছে, মিশে আছে এই বাতাসে, এখানেই তাকে—তার নির্যাস—বুক ভরে পাই।
কে জানত, যে শহর থেকে পালিয়ে বেড়াই, দড়ি ধরে ঠিক সেখানটায় ফিরে এলেই মুক্তি ছিল ভাগ্যে। মুক্তি কথাটা বুঝি ঠিক হলো না—সাময়িক উপশম। হায় হায় নাটোর, আমার ক্ষতস্থান তুমি ছাড়া তো কেউ চেনেনা, এটুকুই বা কার কাছে পেতাম।
প্রথম অধ্যায়
কথা বলবার সময় পরী ওর নখ বোলাত আমার পিঠময়। আমার চোখের পাতা শান্তিতে জুড়িয়ে আসত। তারপর ঘটনা-অঘটনার স্মৃতি আমি বিস্তর চাপা দিয়েছি। অনুভূতি চাপা দেইনি, পারিনি, তাছাড়া প্রয়োজন ছিল। হোস্টেলের বিছানায় কিংবা জাহাজের কেবিনে— রোমন্থন নয়, গুটিসুটি চোখ বুজলে ফিরে ফিরে আসত তারা, ছাড়া ছাড়া, আকারহীন হয়ে—কী করব, আমার যে মা ছিল না প্রায় কখনোই।
আমি ওকে ‘হ্যাঁ’ বলবই। মনস্থির করার পর অবাক লাগল যে, আমি দ্বিধাও করেছিলাম। তখন অবাক লেগেছিল। আজ মনে হয়, যে-কেউ করত দ্বিধা। এত সুন্দর, এত স্নিগ্ধ, এত মায়াময়—শেষ পর্যন্ত বুঝেছিলাম, বুঝতে হয়েছিল যে, আমার পক্ষে ভারী ছিল সেসব।
কিন্তু তার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, যখন আমি নিশ্চিত তখন থেকেই, অবাধ্য কৌতূহল, থরথর উত্তেজনা—কী হবে আমাদের—বিয়ের জন্য এত যে উদগ্রীব বনের মেয়েটা—তারপর? ভাইবোনদের মাঝখানে শুয়ে আমি চালের দিকে চেয়ে থাকি। আমার বউ… এই কথাটাকে মাথার মধ্যে টানতে পারি না এর বেশি। প্রতিবার শুরু থেকে শুরু করি, পুলকিত অস্থিরতা আমাকে দেয় না অতিক্রম করতে। কমলা পরী… আমার বউ… হে ঈশ্বর, তারপর? আমার একটা বউ… নরম তুলতুলে… বিয়ে করতে চায় মানে কী। মানে নতুন কিছু যোগ করতে চায়—এখন যেমন আছি—এরপর তেমন থাকব না। ও লাজুক হাসে। আমাকে আরো মাতাল করে। একবার যখন বিয়ে হয়ে যাবে… কী আছে সামনে?
ও একটা ফতুয়া বুনে দিল আমাকে। আমাকে বলল তাঁত বোনা শেখাবে। নীলকণ্ঠের রঙ নিয়ে একটা শাড়ি বুনে দিতে হবে ওকে।
‘তুই আমার কে হবি?’
এখন আর বলে না। আমি ওর পেটের দৃশ্যমান অংশটুকু—রাজহাঁসের বুকের মতো—ধরব বলে হাত বাড়াই… ও সরে যায় আজকাল। আমি আরো আরো মাতাল হই। ও এর মাঝে রাণী-কামরার কপাট খুলে, ঝেড়েমুছে, ভূতপ্রেত ঘরের বাইরে তাড়িয়ে দিয়েছে। দেখলাম বাগানের ফুলপাতা নিয়ে ভেতরে যেতে-আসতে, শুকনো সুগন্ধি পোড়ানর মিষ্টি ঘ্রাণ… যখন উঁকি দিতে যাই… ওর নরম হাত আমার বুকে রেখে আলতো ঠেলায় বের করে দেয়, ‘এই—এখন নয়।’ দোর আটকে আমাকে নিয়ে গেল কামরার সামনে থেকে। তারপর কই, আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে চন্দন বাটতে বসে, খুব ব্যস্ত। খুব দূরে দূরে থাকছে আমার মাথাটা খারাপ করে দেয়ার জন্য।
ইশ… আর একটা দিন…
‘শুনে যা… তুই আমার কে হবি?’
বলে না।
ইশ… এ আমার বউ… হবে।
শেষ অধ্যায়
‘কী হলো? বের হয়ে এলি যে—’
‘আমি চলে যাব।’
‘মানে?’
‘আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।’ সত্যিই মাথা ঘুরছিল আমার। মনে হচ্ছিল পথের ওপর বসে পড়ব।
টলতে টলতে টলতে টলতে বাড়ি পৌঁছে হন্তদন্ত হয়ে স্যুটকেস গুছিয়ে নিলাম। কারো কথাই যখন কানে নিচ্ছি না তখন নানিজানকে ডেকে আনা হলো আমাকে বাধা দিতে, ‘শরীর নাকি খারাপ লাগছে তো এ আবার কী জাদু—এই শরীর নিয়ে কীভাবে—’
‘এক মুহূর্ত না… তোমরা বুঝতে কেন পারছ না—তোমাদের কি মনে নাই?’ থেমে সকলের চোখে চোখ রাখলাম। একরকম নিশ্চিতই ছিলাম, ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়া ভেতরকার যে দশা আমার, সেটা চোখের আয়নায় ঝাপসা হলেও কিছুটা দেখা যাচ্ছে, কিছুটা হলেও অন্যদের চোখে পড়ার মতো, ‘বলো?’
নানিজান চুপ। বাকিরা পিছিয়ে এল।
আমি নীরবে বেরিয়ে এলাম। বেদে বুড়িকে দেখিনি স্টেশনে। সে নাই, রাত হয়েছে, অথবা আমার রাস্তা ছাড়া অন্যকিছু দেখার শক্তি ছিল না। আমার প্রচণ্ড ভারী হয়ে আসা স্যুটকেস… সাথে এই যে এই অনুভূতিটা আনকোরা, জানি এও নাছোড়; নাছোড় অথচ অভিযোগ করার নাই। আঙুল… তুলব… সান্তনা… কার দিকে তুলব?
রাজশাহীর রেল ধরলাম আর কখনো না-ফেরার উদ্দেশ্যে।
প্রথম অধ্যায়
আমি কখন ভুল শুনছি আর কখন ঠিক শুনছি সবটাই এলোমেলো। আমার ভালো লাগছে না। জ্বর লাগছে এত। আমি উঠে বসতে পারছি না। মারা যেতে চাচ্ছি—আমার এত ব্যথা। বাপজানের গলা শুনে কখনো অবাক হচ্ছি কখনো অবাক হচ্ছি না।
‘…ও নদের ওপাড়ে গেছিল…’
যারা ডাক্তারি পড়ত তারপর কেউ এখানে থাকত না। পসার নাই, ব্যামোই নাই লোকের, ছাইভাঙার মাটি মাখলেই সেরে যায়। এও অদ্ভুত যে নাটোরের ডাক্তার, নাটোর ছাড়লে নিজেরাই রোগ বাঁধাত, কেন? এই বুঝি শর্ত, সংসারে যত ডাক্তার—নিজেরা একেকজন জটিল রোগগ্রস্ত না? শরীরের বালাইটা আমার শরীরেই খুঁজে গেল ওরা সবাই। মাকে তো বাঁচাতে পেরেছিল কাঁচকলা।
‘…ও নদের ওপাড়ে গেছিল…’
মাঝে মাঝেই সবটা মনে পড়ে উঠে বসতে চাচ্ছিলাম। যদিও উঠে বসার জোর ছিল না। বোধ হয় মাথা পর্যন্ত তুলতে পারছিলাম তখন বড়মামী কিংবা বুবুজান কিংবা মা আমাকে শুইয়ে দিচ্ছিল।
‘…কীসের বনদেবী? কী বলছে?’
‘জ্বরের ঘোরে বকছে…’
যা খাচ্ছিলাম বমি হয়ে যাচ্ছিল। অথবা খাচ্ছিলামই না কিছু। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলাম অথচ আমার কথা কেউ বুঝতে পারছিল না। কখনো চোখ মেলে দেখতাম অনেক ভিড় কখনো শুধু নানিজান, জায়নামাজে বসে ফুঁ দিচ্ছেন আমার গায়ে। বাঁকাচোরা ডাল খুটখুট করে বেদে বুড়ি আসলো, একদিন বাদে অথবা কিছুদিন বাদে, ‘…এখানে থাকলে তো মারা যাবে।’
আমি যাব না কিছুতেই নাটোর ছেড়ে।
বুড়ি আমার দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে বিষকাটালীর রস ঢেলে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ এনে বলল, কেন গেছিলি?
বাপজান আমাকে সেদিনই নিয়ে গেল নাটোর থেকে।
দ্বিতীয় অধ্যায়
ছোটকুমার জড়িয়ে ধরল আমাকে। মার্কিনী হালের হালকা রঙিন স্যুট, ইষৎ মোটা টাই, বাদামি রেট্রো চশমা আর বাদামি উইংটিপ অক্সফোর্ড জুতা—রাজকুমার বটে। খাসা ছেলেটা। সরকারি প্রকল্পটা নিয়ে ওর সাথে কিছু কেজো আলাপ দরকার। বসার জায়গা নাই বলে দাঁড়িয়েই চা খেতে হচ্ছিল। এর মাঝে যখন পুরাতন কথা তুলে খুব হাসাহাসি করলাম আমরা, দেখা গেল নাটোরকে কয়েক মাসের জন্য দেখেছি যে আমি—সেই আমিই মনে রেখেছি সবচেয়ে বেশি।
বৌদি, ছোটকুমারের স্ত্রী, হতে-পারত-যে নাটোরের রাণী, হতে-পারত মা ভবানীর উত্তরসূরি, যখন বেরলেন তখন চাঁদ লজ্জা ভেঙেছে। লোকের গমগম, হাসাহাসি থেমে যাওয়াতে হয়তো লনের ওপর বয়ে যাওয়া মৃদু হাওয়াটা গায়ে টের পেলাম। ছোটকুমার নায়কের মতো উঠে গিয়ে তার হাত ধরে নামিয়ে আনল বারান্দার দু’টি ধাপ। মধুবালা শাড়ি নীলকণ্ঠের মতো নীল… জোছনার রঙের ব্লাউজ… আচ্ছা…
আমার জুতার ওপর কিছুটা চা ছলকে পড়ল। কিন্তু আমি খুব সাবধানেই ঘাসের ওপর কাপটা নামিয়ে রাখলাম। খুব সাবধানেই… সবটাই সাবধানে…। পিছন ফিরে দাঁড়ালাম। আর একবারও তাকাব না। ও তাকিয়েছে। তাই না? এত ভিড়ের মধ্যে।
হাওয়া দিচ্ছে বলেই, কানকথার মতো ছড়িয়ে পড়ছে কী মিষ্টি, মাতাল-করা কমলা লেবুর ঘ্রাণ—যা আমি জানি, চ্যানেল নং ফাইভ নয়। অসম্ভব। না, কেন অসম্ভব। সবাই যে বলল—বয়সে বড় কোন অজাতের মেয়েকে বিয়ে করে ছোটকুমার রাজ্যছাড়া হয়।
‘কী হলো? বের হয়ে এলি যে—’
যে-কেউ দ্বিধা করত না।
‘আমি চলে যাব।’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন