ফরাসি চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক আঁদ্রে বাজাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো: “সিনেমা এখনো উদ্ভাবিত হতে বাকি।” এর উৎস বাজাঁর রচনা সংকলন ‘সিনেমা কী’ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মিথ অব টোটাল সিনেমা’ (১৯৪৬)। যা আদতে ওই সালেই প্রকাশিত জর্জ সাদুলের “সিনেমার প্রাকৃত ইতিহাস” বইটির পর্যালোচনা।
মঁসিও সাদুল ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী। সেহেতু চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে উনি দেখতে চেয়েছেন মার্ক্সীয় বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মোতাবেক, প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথেই ধাপে ধাপে বিকাশ ঘটেছে চলচ্চিত্রের৷ যেমনটা প্রযোজ্য সভ্যতার তাবৎ নিদর্শনের ক্ষেত্রে। প্রথমে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ এবং তার হাত ধরে নব উদ্ভাবন। কিন্তু বাজাঁ যেটি করলেন, তিনি সাদুলের বিবৃত ইতিহাস ধরেই দেখালেন যে, সিনেমা ধারণাটি বরং এক প্লেটোনিক স্বর্গ। প্লেটোনিক বলতে বস্তুবাদী দর্শনের বিপরীত, অনেক বেশি ভাববাদী।
বাজাঁর মতে, টোটাল সিনেমা বা, পূর্ণ অর্থে সিনেমা বা, চূড়ান্ত সিনেমার ধারণাটি একটি অধরা ভাবনা হয়ে মানবমনে টিকে ছিল হাজার বছর ধরে। কারিগরি সংযোজনের ইতিহাস এই প্রাচীন ভাবনার কাছে ফিকে। এমনকি, সিনেপ্রেমীদের মনে পূর্ণ সিনেমার যে আকাঙ্ক্ষাটি কিংবদন্তী হয়ে বেঁচে ছিল তার তুলনায় প্রযুক্তির দৌড় ছিল অনেক পিছনে। বাজাঁ এই প্রপঞ্চের উপমা দিয়েছেন উড়োজাহাজের সাথে। যেভাবে ইন্টার্নাল কম্বাস্টন ইঞ্জিন আবিষ্কারের বহু বহু যুগ আগে থেকেই মানুষের মনে লালিত ছিল আকাশে ওড়ার বাসনা। তার প্রমাণ ইকারাসের পুরাণ। পাখির ওড়া দেখে আদিম মানুষের মনে আকাশে ডানা মেলার যে সাধ জেগেছিল, তার পরিণতি আসে হাজার হাজার বছর পর। পূর্ণ সিনেমার কিংবদন্তীও এভাবে মানুষের মনে টিকে ছিল যুগের পর যুগ। এমনকি, বাজাঁ তো সাহস করে এও বলে দিচ্ছেন যে, সিনেমা যতই সামনের দিকে এগোবে, সে তার আদিরূপেরই আরো কাছাকাছি ফিরে যাবে।
কী এই আদিরূপ? এই আদিরূপের অবস্থান ছিল মানুষের মননে, যা হবে বাস্তবতার এক পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুলিপি। মানুষ তার অভিজ্ঞতাকে, একেকটি মুহূর্তকে রঙ-রূপ-রস সমেত ধারণ করে রাখতে চেয়েছে। বাজাঁর মতো বাস্তববাদী চিন্তকের কাছে তাই চলচ্চিত্রে শব্দ ও রঙের সংযুক্তি একে পরিপূর্ণতা অর্জনের পথে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু সেই ১৯৪৬ সালেও চলচ্চিত্র উদ্ভাবিত হয়নি। আজকের থ্রিডি ছবি (৬০-এর দশকের বলতে পারেন), কিংবা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, কিংবা কম্পিউটারে তৈরি চিত্র বরং সেই টোটাল সিনেমার আদিরূপের কিছুটা নিকটবর্তী।
বাজাঁ বলছেন, বিজ্ঞানের কাছে চলচ্চিত্রের কোনো ঋণ নাই। ওই যে মনীষী এডিসন কিংবা লুমিয়ের যাঁরা প্রথম চলচ্চিত্রের দৃশ্য ও শব্দ ধারণ করেছিলেন তাঁরা কেউই টোটাল সিনেমার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন না। চলচ্চিত্র উদ্ভাবনে তাঁদের কৃতিত্ব ততটুকুই, যতটুকু অবদান কিছু সৌভাগ্যজনক দুর্ঘটনার। এইসব প্রযুক্তি কার হাত ধরে এসেছে বাজাঁর কাছে তার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো পূর্ণ সিনেমার স্বপ্ন কার চোখে কতটা ধরা পড়েছে। কারণ টেকনিকালার আসার কয়েক দশক আগেই মেলিয়ে রঙিন চলচ্চিত্রকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। এই চেষ্টাটিই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’ (১৯২৭) মুক্তি পাওয়ার অনেক আগে থেকেই, প্রায় চলচ্চিত্র উদ্ভাবনের গোড়া থেকেই, প্রত্যেকেই চেষ্টা করে এসেছেন ছবির সাথে শব্দকে জুড়ে দেওয়ার। আর এই চেষ্টার মধ্যেই নিহিত ছিল বাস্তবতাকে কব্জা করার সেই পৌরাণিক ইচ্ছা। যে ইচ্ছা কখনোই পুরণ হবার নয়।
আন্দ্রে বাজাঁ (১৮ এপ্রিল ১৯১৮–১১ নভেম্বর ১৯৫৮) |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন