সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তেঁতুল বনসাই

মনেও থাকে না যে রমজান মাস চলে। চারদিকে কেউ-না কেউ কিছু-না কিছু খাচ্ছে। পথের ধারে কয়েকজন মিলে টেবিল বসিয়ে লেমনেড বিক্রি করে টাকা তুলছে। সম্ভবত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেক আগত শরণার্থীর জন্য। টেবিলে একটা সাদা ডেস্ক ক্যালেন্ডারের আকৃতিতে কাগজের জিনিসটা রাখা, ফোল্ডেড প্ল্যাকার্ড? তাতে কী লেখা দূর থেকে পড়া যায় না। লেখার নিচে কিউ-আর কোড। যে ক্যাম্পাসেই যাই সেখানেই এখন এটা একটা পরিচিত দৃশ্য, টাকা তোলার দৃশ্যটা। চাঁদা আদায়কারী চেয়ার থেকে ঝুঁকে এগিয়ে হাতে লিফলেট ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এখানে তিনজন অবশ্য অনেকটা ঝিমাচ্ছে। সচরাচর ইমিগ্রান্টরা এসব দান-খয়রাতে উৎসুক হয়ে অংশ নেয়। আমি যেটা করি সেটা হলো পাশ কাটিয়ে চলে যাই। অত্যুৎসাহী কেউ কথা বলার জন্য থামাতে চাইলে ব্যস্ততার দোহাই দেই। এখানকার ছাত্রছাত্রী অনেক ভদ্র। অনেক ক্যাম্পাসে আমি শুনতে পাই পিছনে গালি দিচ্ছে।  

শীত সদ্য বিদায় নিয়েছে। ঘাসের ওপর ফ্রিসবি খেলছে তরুণ-তরুণীরা। কয়েকজন দূরে দূরে রোদে বসে গিটার বাজাচ্ছে। তাদেরকে ঘিরে আরো ছেলেমেয়ে। একজন ছাত্রী চিত হয়ে শুয়ে বই পড়ছে গাছের ছায়ায়। পায়ের ওপর পা তোলা। দৃশ্যটা অনেকটা ছায়াছবির মতো। কিছুটা দূরে আরেকটা নিরীহ চেহারার ছেলে হাতে বই নিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে পাঠরতা মেয়েটার ফ্রকের ভেতর। আমি ক্যাফেটেরিয়া থেকে ঠাণ্ডা কফির টাম্বলার নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে আবার অফিসের উদ্দেশ্যে ফিরছি। ক্যাফে থেকে বের হওয়ার সময় আমার চেহারা স্ক্যান করে অটো বিল করে নিয়েছে কম্পিউটার সাহেব। রশিদ চলে এসেছে আমার আইফোনে। চীনের বহুল চর্চিত এই প্রযুক্তি এখন এখানেও দস্তুর হয়ে উঠেছে। এটা নিয়ে কিছু বলা যায় ক্লাসে। আমার কানের পাশ দিয়ে একটা মৌমাছি উড়ে গেল ভনভন করতে করতে।   

ক্লাস শেষ করার তাড়া ছিল আজকে। এমনিতেও আমার এই লেকচারের পর কেউ কোনো প্রশ্ন-টশ্ন করে না। তাছাড়া আজকে বড়দিনের ছুটির আগে শেষ ক্লাস। উপস্থিত ছিল মাত্র তিনজন। আমি এই ছুটিতে একটা পেপার লেখার কাজ দিয়ে ক্লাস খতম করে দিয়েছি। ক্লাস না-করেও এই কোর্সে দিব্যি এ গ্রেড বাগিয়ে নেয়া যায়। ঘরে বসে বা চাকরির ফাঁকে ফাঁকে কিছু সিনেমা দেখবে আর তার ওপর কয়েকশ’ শব্দ লিখে জমা দিবে, ব্যাস। এমন মজা আর হয় না। হাজিরা পাতার কোনো এক জায়গায় কারো নামোল্লেখ থাকলেই ওনার ক্রেডিট পূরণ করে দেই। প্রতি সেমিস্টারে একজন হয়তো পাই যার অরিয়েন্টাল সিনেমা নিয়ে সত্যি খানিকটা আগ্রহ আছে। এই ছাত্রগুলো বছর বছর আশাহত হয়। এরাই আমার নামে নেগটিভ ফিডব্যাক দেয়। তাতে আপাতত কিছু যায় আসে না কেননা এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই তল্লাটে এই কোর্স নেবার একটিমাত্র লোক হলাম শ্রীমান। নম্বর দেই হাত খুলে যে কারণে কোর্সটা অন্তত সচল রাখার মতো যথেষ্ট পরিমাণ দরখাস্ত জমা হয় প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে। 

অন্য যে দুইটা কোর্স নিচ্ছি সেগুলোতে ছাত্র উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। তবে একদম নতুন নতুন তো: কিছুদিনের মধ্যে আমার উদারতার সাথে পরিচিত হয়ে গেলে তারাও আর কষ্ট করে ক্লাসে আসবে না। ডিজিটাল কলোনিয়ালিজমের ক্লাসে আপাতত ইউটিউব ভিডিও দেখিয়ে দু’একজনের মতামত শুনে বিদায় করে দেই। ক্লাসে মানুষ বেশি হলে সাবমিশন বেশি থাকে। সেগুলো পড়তে হয়। আমার নিজের রিসার্চ আছে, এন্তার পড়ালেখা, এনাদের অখাদ্য যত কম গিলতে হয় ততই ভালো। 

   অফিসে চাবি দিয়ে একাডেমিক ভবন থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরচ্ছিলাম এমন সময় খাঁটি বাংলা উচ্চারণে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। তাকিয়ে দেখি পুষ্প। এখানে আমাকে ডাকবার মতো কেউ নাই। কলিগদের সাথে ভালোমত পরিচয় নাই। অফিসে বসি কম। ক্লাসে আসি, লাইব্রেরিতে যাই, ক্যাফেটেরিয়া থেকে খাবার নিয়ে ডর্মে যাই, লেখাপড়া করি, তারপর ঘুম। আর ছাত্রদের তো ক্লাস আওয়ারেই কিছু বলার থাকে না, বাহিরে কী বলবে।  

‘আমি একটু ব্যস্ত,’ হাঁটা থামিয়ে বললাম। 

‘ক্লাস তো শেষ না? আপনি যেন থাকেন কোথায়?’

‘রেসিডেন্সিয়াল এ ব্লক, আপ সাউথ।’

‘নাইস। ইয়ে— সাইকেল দেখছি না আজকে।’

‘আজকে এক জায়গায় যেতে হবে। পাতাল রেলে চড়ে যাব।’ আমি কথা বলতে বলতে হাঁটা ধরলাম।

পুষ্প আমার সাথে পা মেলায়, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’

‘ম্যাপে দেখতে হবে, ডক ইয়ার্ডের কাছাকাছি। শন অ্যান্ড সামথিং?’

‘ওহ, ডেলিভারি এসছে বুঝি? আপনি আমার গাড়িতে চলেন। আমি ওখানে পেটি টেবিলে টেবিল সার্ভ করি। জাস্ট মিনিট দশেক হাঁটবেন সেখান থেকে।’ 

‘সেত লা পতিতাব্‌ল!’

‘পারডন মোনসিও।’ 

‘আমি দুঃখিত পণ্ডিতি করার জন্য। কোনো ঝামেলার দরকার নাই। আমি চলে যাব সাবওয়েতে।’

‘এই যে আমার গাড়ি,’ পার্কিং লটের প্রথম গাড়িটার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে পুষ্প। আমি একটা উপযুক্ত বাহানা খুঁজতে লাগলাম। পুষ্প ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে দরজা ধরে দাঁড়ায়, ‘ভাবছেনটা কী। আমি ডক্টরাল প্রোগ্রামের ছাত্রী, তাও আপনার ছাত্রী নই, সুতরাং কোনরকম আদিখ্যেতার কোনো প্রয়োজন নাই। উঠে পড়েন। নাকি আপনার উনি রাগ করবেন?’ 

আমার উনি পুষ্পকে একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু সেটা পুষ্পর কাছে প্রকাশ করি তাও চায় না। ভবিষ্যতে বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানলে সে আমাকে চোদ্দ রকম অজুহাতের ডেমো দিতে পারবে যেগুলো এই সময় উপস্থাপন করতে পারতাম। কিন্তু এই সকল মেয়েমানুষি ভাবনাচিন্তার জন্য আমার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বিশেষ বরাদ্দ নাই। আমি নিষ্ফল যুদ্ধ দ্বারা ব্যাপারটাকে উৎকট না-বানিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। এটা কী গাড়ি? আমি চিনি না। খুব দামী না, আবার খুব কম দামী বলেও মনে হচ্ছে না। গাড়ির ভেতর মেয়ে-মেয়ে একটা বাস।

‘সীটবেল্ট—’ পুষ্প গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে। 

বাঁধলাম। ওকে অনেক বেশি চটপটে মনে হচ্ছে আগের চেয়ে—লিঙ্গগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে যতটা বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া যায় কথায় কাজে। অবশ্য আমি যদ্দিন ওকে ভালোমত চিনতাম, সেই বছর পনের আগে তো ও সার্বিক অর্থে শিশু ছিল। বাক্যের আসত্তি থাকত না প্রায়ই। চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বললে চোখ নামিয়ে ফেলত। ওকে কখনো গাড়ি চালাতে দেখব ভাবিনি। কোনো কিছু চালানোর সাথে একটা কেমন যেন সাংঘর্ষিক ব্যাপার আছে। গাড়ি ক্যাম্পাস ছাড়তে ছাড়তে ক্যাম্পাসের ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহার করে ম্যাপটা লোড করে নিলাম। গাড়িতে উঠেই ফোন বের করাটা সুজনের আচরণ না। কিন্তু জানি সেদিকে থোড়াই ভ্রূক্ষেপ পুষ্পর, বলে, ‘আমি যেখানে জ্বালানি পোড়াচ্ছিই তাহলে খামোখা আর আলাদা কেন যাবেন। ফেরার সময় সাবওয়েতে ফিরবেন। দেশি মানুষ দেশি মানুষকে সাহায্য করতে হবে যাতে বিদেশে টাকা বেশি খরচ না-হয়।’ 

‘বটেই।’ 

‘ওহ আপনার সেই সার্কাস্টিক হাসি। কতদিন পর শুনলাম। আর “বটে”। আপনি ১৬ ডিসেম্বরের প্রোগ্রামে আসেননি কেন?’ পুষ্প বামে মোড় নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল। 

‘আমার ধর্মীয় পরিচয় এই মুহূর্তে দোদুল্যমান। ফলে প্রবাসী বাঙালি সমাজ কর্তৃক একঘরে করে রাখা হয়েছে আমাকে।’ 

‘এ তো হওয়ারই ছিল,’ পুষ্পর স্বগতোক্তি। 

‘জি?’ 

‘না, বলছি যে আপনাকে এত বছর পর দেখে কী যে ভালো লাগল। সেদিন সন্ধ্যায় ওয়াইনের গ্লাস হাতে না-নিয়ে কেমন চেহারা করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধর্ম সংশয় নিয়েও হালাল-হারাম আজকাল ভালোই মানছেন তাহলে। আচ্ছা ইয়ে আপনি কতক্ষণ থাকবেন ওখানে? আমি তো ফেরার সময়ও আপনাকে লিফট দিতে পারি তাই ভাবছি। আচ্ছা আমার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা রাখুন তো—’ পুষ্প গাড়ি চালাতে চালাতে ওর নম্বর বলে। আমি ফোনে টুকে নিলাম। 

‘রিং মি। আমি পরে সেভ করে নিব।’

আমার ব্যালান্সও নাই, সেলুলার ডাটাও নাই। সে কথা শুনে পুষ্প চোখের কোণা দিয়ে আমাকে জাজ করার ভঙ্গি করল। এরকম বুদ্ধিদীপ্ত মুখভঙ্গিও ওর সাথে যায় না। বয়সের সাথে সাথে মানুষের বুদ্ধি বাড়ে নাকি?

‘আমার হটস্পট দিব? ওহ হ্যাঁ আপনার নাম্বার নিশ্চয়ই ডট এডু ওয়েবসাইটে আছে। হেহে, আমি খুঁজে নিব, সেটাই ভালো, আপনার ওপর আর ভরসা করতে হবে না তাহলে!’ ও এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে প্রসঙ্গ বদলে বাম হাতের অনামিকা দেখিয়ে বলল, ‘ইয়ে— আমি এখন বিবাহিত।’

‘আই অ্যাম সো স্যরি টু হিয়ার দ্যাট,’ শুকনো কণ্ঠে বললাম। বিয়ের প্রসঙ্গটা এখন কেন আসলো কে জানে। বেশি বেশি যে আগ্রহ দেখাচ্ছে আমার প্রতি সেটাকে নরমালাইজ করল? বিয়ে হয়ে গেছে বলে ওর আমাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখাতে বাধা নাই? হয়তো অবচেতনে এটা নিয়ে ভেবে বিয়ের কথাটা বলেছে, সচেতনভাবে বলেনি। আমরা যে সংস্কৃতি থেকে এসেছি সেখানে অবিবাহিত অনাত্মীয় নারীপুরুষ পরস্পরকে নিয়ে এত অস্থিরতা দেখায় না। বিশেষ করে পুষ্প যেরকম লাজুক ছিল। ও ভাবছে বিয়ের দরুন আর আমাকে নিয়ে সংকোচ দেখানর কিছু নাই। এমন না যে আমাদের কোনকালে প্রেম ছিল। আমার হাসি পেল। ও নিশ্চয়ই এখন বলবে যে ওর স্বামী আমাকে চেনে।  

‘ডিনের ডিনারে ছিল। ও আসার আগে আপনি বেরিয়ে গেছিলেন। ও স্টেটসে কাজ করে একটা নিউজ এজেন্সিতে আর এখানে পিএইচডি করছে আপনার বন্ধু প্রফেসর থামানের সুপারভিশনে।’ 

‘আমি জানতাম না।’ 

‘জানলেও আপনার মনে রাখার কোনো কারণ নাই। জানেন, আপনার লেখা ওকে জোর করে পড়িয়েছি। ও এমনিতে বাংলা ফিকশন পড়ে না। প্রথম উপন্যাসটা পড়ে বলেছে নাকি বাচ্চাদের বই, আমার যেটা সবচেয়ে পছন্দের, কেমন লাগে বলেন তো, মেজাজ খারাপ হয় না? ডিভোর্স দিতাম। কিন্তু পরের উপন্যাসটা পড়ে খুব ভালো বলেছে। ওর মুখেই শুনবেন। ইয়ে ওর নানা ছিলেন ফ্রিডম ফাইটার। আপনাকে একদিন ধরে নিয়ে যাব আমাদের ফ্ল্যাটে; ওরও সামনাসামনি খুব দেখার ইচ্ছা আপনাকে।।’ 

‘দেখলে হতাশ হবেন।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ আপনার সেই তত্ত্ব। মনে আছে। পুরো আজগুবি। আমি আপনাকে দেখার আগে আপনার বই পড়েছিলাম না? ভেবেছিলাম আঁতেল একজন, দেখলাম মারাত্মক ডায়নামিক একটা ছেলে। আমার একটা বান্ধবী ছিল মনে আছে, একা? আপনার অটোগ্রাফের জন্য আমাকে জ্বালাত যে? ওর বিয়ে হয়ে গেছে জানেন?’ 

আমি বলতে চাচ্ছিলাম, একা তবে আর একা নাই। কিন্তু এরকম প্রকট শব্দকৌতুক থেকে নিজেকে এই মুহূর্তে সংযত রাখতে পারা উচিৎ। মুখে কিছু না-বলে শুধু চোখ বড় বড় করে অবাক হওয়ার ভান করলাম। 

‘কী? আপনার মনে নাই ওর কথা যা বুঝছি। ধুর আমি একাই কথা বলছি। অবশ্য আপনাকে লিফট দিয়েছি কথা বলার লোভে। আমি অনেকদিন ধরেই আপনাকে খেয়াল করি। সাইকেল চালান তাই এপ্রোচ করতে পারি না। ইয়ে— আপনার সাবজেক্ট কী যেন বললেন।’

‘পুরুষ প্রোটাগনিস্টের বিপরীতে নারী এন্টাগনিস্ট।’

‘অ্যা?’ পুষ্প জোরে জোরে দুইবার হর্ন বাজায় সামনের পিকআপের থেকে সাইড চেয়ে, ‘সিরিয়াস? মানে সিনেমায়? না মানে এমন সিনেমা আছে কি?’

‘কিছু আছে।’

‘মানে কি ওই নারী ভিলেনের ফ্রেমিং?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার আসলে আপনাদের ফিল্ডের পোস্ট ডক সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নাই।’

‘আমারও নাই।’    

পুষ্প কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। তারপর অনেকক্ষণ নীরব। সূর্য ঢলে পড়ছে। বিলবোর্ড আর সড়কবাতিগুলো জ্বলে উঠছে। ও বোধ হয় রোজা রাখে নি। ইফতারের তো সময় হয়ে যাওয়ার কথা। এত বকবক আমার ভালো লাগে না। রোজ রোজ নারী কণ্ঠের বকবক শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। 

‘আচ্ছা ইয়ে— আপনার লেখালেখির কী খবর? আপনার বইগুলো আমি ফেলে এসেছি জানেন। আসার আগেও পড়েছি। কেন যে আনলাম না। এবার গেলে নিয়ে আসব। ভেবেছিলাম পড়ার সময় পাব না। কিন্তু এখন মিস করি মাঝে মাঝেই। নতুন কী লিখেছেন জানিয়েন তো!’ 

‘কিছুই না। রাইটার্স ব্লক চলছে।’

‘মানে কী, তাই বলে… মানে কী, কতদিন ধরে?’

‘এই ১০-১২ বছর হবে।’ আমার পরিকল্পনা ছিল রেলগাড়িতে বসে ইমেইলগুলো চেক করব আর অফলাইনে খসড়া উত্তরগুলো লিখে রাখব। এখন তো আর সেটা হচ্ছে না। ফেরার সময় কালকের রুটিন সাজানোর কথা। সেটাই বরং এখন মনে মনে সাজানোর চেষ্টা করি। আর ফেরার সময় ইমেইল দেখব। ফিরতি পথে ওর গাড়িতে চড়া যাবে না। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। আজকাল আমি রুটিনের বাইরে কিছুতেই কাজ করতে পারি না।

‘আপনি তার মানে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছেন?’ পুষ্পর স্বর হঠাৎ কেমন বদলে গেল। কঠিন শোনাচ্ছে, ‘কারণটা কী?  

ওহো, ড্রাগন লেডি। আমি একেক জনকে একেক উত্তর দেই। কোনটাই ভুল উত্তর না। তবে একটার সাথে আরেকটার তেমন সম্পর্ক নাই। সাতপাঁচ না-ভেবে উত্তরমালার থেকে একটা উত্তর বের করে ওর সামনে রাখলাম, ‘আমার জন্য এটা একটা তপস্যা। গত ১০ বছরে এই তপস্যা করার মতো মানসিক-সাময়িক ফুরসত মেলে নি।’

‘এটা কোনো কথা হতে পারে? বুঝলাম না, আপনি করেনটা কী তাহলে?’

‘সাহিত্যচর্চার জন্য প্রচুর অনুপ্রেরণা দরকার। আপনি বাদে তো আমার পাঠক তেমন নাই,’ এই শেষ বাক্যটা ইম্প্রোভাইজ করলাম। আগে কাউকে বলতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক হয়নি এই কথা। 

‘কী বলেন না-বলেন।’

‘আমার শেষ বইয়ের কয়েকশ কপি প্রকাশনীর গোডাউনে পড়ে আছে অনেক বছর। এতদিনে পুড়িয়ে ফেলেছে কিনা কে জানে। ওনারা বলেছিলেন বাজারে এখন থ্রিলারের চাহিদা, সেটা আমি দেশে ছিলাম যখন তখনকার কথা। আমি ঠিক করেছিলাম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী লেখার আগে লেখালেখি ছেড়ে দিব। ছেড়ে দিলাম। কারো কোনো ক্ষতি হলো না। কাগজ আর কালি বেঁচে গেল।’ এই কথাগুলো আমার গুছিয়ে রাখা ছিল। কাউকে বলা হয়নি কারণ কেউ এক-দুই কথার বেশি টানে না বিষয়টা নিয়ে। কেউ হয়তো কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে আর লিখি না কেন। কিছু একটা বলি যেটা মিথ্যা না। তারপর মানুষ অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।   

পুষ্প হঠাৎ দমে গেল আমার কথায়, ‘সেজন্য আপনি লেখা ছেড়ে দিয়েছেন? পাঠক নাই বলে? আপনার অভিমান হয়েছে?’ পুষ্প রাস্তা ছেড়ে আমার দিকে তাকায়, ‘আপনি কি শিশু? আপনার লজ্জা করল না এসব বলতে?’

‘সামনে দেখুন—’ বলতে বলতে বিপরীত দিক থেকে আসা একটা লরি একেবেঁকে কোনমতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পুষ্প শাপ দিয়ে উঠে ব্রেক কষল। রাস্তার একজোড়া ক্যামেরা আমাদের দিকে তাকিয়ে জুম করে। আর সাথে সাথে পুষ্পর ফোনে ক্ষুদে বার্তার ঘণ্টা বেজে উঠল। জরিমানা হয়েছে নির্ঘাত। ওর সেদিকে পাত্তাই নাই, দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আচ্ছা… আপনি এখানে কী করছেন?’ 

‘একটা কোলাবরেশনে…’ 

‘উঁহু, এটা তো সেদিনই বললেন। আমি জানতে চাচ্ছি এখানে কেন? না, মানে, কেন করছেন এইসব?’

‘ঠিক যে কারণে আপনি করছেন।’

‘আমি তো দেশে ফিরে যাব। স্বদেশের পুষ্টিবিজ্ঞান চর্চায় ভূমিকা রাখাটা উদ্দেশ্য। আপনি, ডোন্ট মাইন্ড, মহিলাদের ফ্রেমিং নিয়ে একের পর এক ডিগ্রি নিচ্ছেন কেন? আপনার উদ্দেশ্য কী?’

‘এটা তো ঠিক ডিগ্রি না… ’

পুষ্প হঠাৎ বিরক্ত হয়ে গেল, ‘আরে আমি কী বলতে চাইছি সেটা আপনি জানেন। আপনার মাতৃভূমিতে আপনার এইসব গবেষণার ভূমিকা কী?’ 

মনে হচ্ছে আমার পিতাঠাকুরের পাশে বসেছি। উত্তর না-পেয়ে ও আমার দিকে তাকাল। আমি আগে থেকেই চেয়ে আছি ওর দিকে। ও যেন ভ্রূ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা। আমিও চেষ্টা করছি তবে চেহারায় কোনো ছাপ না-রেখে। কেন এইসব প্রসঙ্গে যাচ্ছে। ওহ আচ্ছা… আমি সম্ভবত ওকে বা ওর পরিচিত কাউকে এসব প্রশ্ন করে উত্ত্যক্ত করেছি কোনো এক সময়। ও কি তার মানে পূর্বের  প্রতিশোধ নিচ্ছে? হঠাতই আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করল। কোনো কথা নাই। কিছুদূর চলার পর ছোট টেবিল রেস্তোরাঁর কাছে এসে থেমে গেলাম আমরা। আমার ডাউনলোডেড মানচিত্র বলছে এখান থেকে ৭ মিনিট হাঁটতে হবে লোকেশনে যেতে চাইলে। পুষ্প গাড়ি চালিয়ে পার্কিং লটে রাখল। শান্ত নিখুঁত পার্কিং। কিছুক্ষণ বসে থাকল স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে। দরজার লক খোলেনি। সম্মুখে অনির্দিষ্টে চেয়ে থাকতে থাকতে ওর ঠোঁট নড়ে উঠল, ‘আপনাকে আমি চিনতে পারছি না বিক্রম।’ 

আমি কী জবাব দিব বুঝে ওঠার আগেই ও আবার শুরু করল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এই আপনি প্রতিটা গল্প লিখতে গিয়ে নিজের কলিজাটা ছিঁড়ে বের করে আনতেন লেখার টেবিলে। আপনার লেখা পড়তে গেলে রক্তের দাগ দেখা যেত। আপনি ঈশ্বরের এত বড় আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। এত সহজে তাকে পায়ে ঠেললেন? এত সহজ?’    

এবার আমি বেশ হকচকিয়ে গেলাম। এতক্ষণ হালকা মেজাজে ছিলাম। মিস এডয়ার্ড নর্টন এতটা আবেগপ্রবণ কেন হয়ে উঠলেন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার লেখা নিয়ে কারো সাথে এখন কথা হয় না। সম্ভবত ঘনিষ্ঠ কারোও মনে নাই যে আমি সৃজনশীল সাহিত্যের চর্চা করেছি এক সময়। আমি তো নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ নিজেই ভুলে গেছি এখন। আমি যতদূর অবধি কথোপকথন কল্পনা করে ব্যাখ্যা তৈরি করে রেখেছিলাম ততদূর পর্যন্ত আজকের আগে কথা আগায়নি। কেউ এর পরেও কথা টেনে নিয়ে যাবে আমার লেখালেখি নিয়ে সেটাই আমি ভাবিনি। ওর এইসব প্রশ্ন আমার কাছে অতি আকস্মিক। আর আগে থেকে ভেবে না-রাখলে আমি কোনো উত্তরই দিতে পারি না এখন। নিজের জীবন নিয়ে তো নয়ই। পুষ্প কি আমার লেখা খুব পছন্দ করত? অনেকেই তো করত। তাদের মধ্যে কি ও সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত? এরকম সিরিয়াস হওয়ার মতো? আমার শ্লাঘা অনুভব করা উচিৎ নাকি হা-হুতাশ করা উচিৎ বুঝতে পারছি না। আসলে নিজেকে নিয়ে না-ভেবে ওর দিকে ফোকাস করা উচিৎ, ‘আমি কি আপনাকে কোনো দুঃখ দিলাম?’ 

পুষ্প এবার আমার দিকে তাকাল। ওর চোখে নেতিবাচক কোনো অনুভূতির ছায়া, ‘লুক অ্যাট ইউ। আমি এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আপনাকে সেই আগের চোখ দিয়েই দেখছিলাম। আমি বুঝিনি কীসে পরিণত হয়েছেন আপনি।’

আমি সামনের আয়না ঘুরিয়ে নিজেকে দেখে নিলাম। পুষ্প হাসে না, ‘আপনাকে দেখার আগে আপনার লেখার, আর দেখার পর আপনার ক্যারিশমার প্রেমে পড়ে গেছিলাম আমি। কী ছিলেন। সেই আপনি এখন ঘাড় হেঁট করে একাকী সাইকেল চালিয়ে আসেন আর যান। ধুর, আপনাকে এত কথা কী বলছি।’

খটাশ খটাশ করে লক খুলে দিল পুষ্প। কী বলে বিদায় নিব ভাবছি। ওর দেখাদেখি আমিও বের হলাম গাড়ি থেকে। পুষ্প ঠাশ করে দরজা আটকে গাড়ির ওপাশ থেকে বলল, ‘ঠিকই বলেছেন, আপনাকে দেখলে আমার হাজবেন্ড হতাশ হবে। আর হ্যাঁ, আমার নম্বরটা ডিলিট দিবেন কাইন্ডলি।’ 

পুষ্প আমাকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ না-দিয়ে গটগট করে হেঁটে গেল। যেতে যেতে কাঁধের কাছে চাবিটা তুলে লক করে দিল গাড়ি। আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে। 


আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমি দাঁড়িয়ে আছি রোদের মধ্যে। আমার বিকল্প বাস্তবতায়। আরেক সমান্তরাল জীবনে যেই জীবনে আমি এখানে না। আমি দুয়ারীপাড়া বস্তির একটা সিমুলেশনে দাঁড়িয়ে আছি। পরিচিত দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা দেয় আমার নাকে। আমার চারপাশের দালানগুলো ঝুরঝুর করে ঝরে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে ভূমির সাথে। মাটি থেকে গজাচ্ছে বিভিন্ন টিনের ঘর। আমি ঘামছি দরদর করে। সূর্য ঝটাশ একবার অস্ত যেয়ে পুনরায় চলে এসেছে আমার মাথার ওপর। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় তাপ ছড়াচ্ছে চারদিকে। আমার পরনে একটা হাতা গোটানো ফুল শার্ট। আমার বুকের বোতাম খোলা। ভিতরে স্যান্ডো গেঞ্জি ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে। 

কেউ আসেনি। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমি প্রকৃত বাস্তবতা ছেড়ে এসেছি। এখানে বেশিক্ষণ থাকি না আমি। এ আমার স্মৃতি না, দুঃস্বপ্ন না। এই অভিজ্ঞতা ছন্নছাড়া না, নিষাদের মতো অসংলগ্নও না, দুই বাস্তবতায় যাতায়াত আমার নিয়ন্ত্রণাধীন। আমি মাল্টিভার্স ট্র্যাভেলার নই কারণ ব্যতিক্রমহীনভাবে আমার আসা-যাওয়া সীমাবদ্ধ দুই সমান্তরাল জীবনের মধ্যে। আসল বিষয় হলো, আমার মধ্যে কোনো সময় কোনো সংশয় কাজ করে না: আমি সবসময় জানি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে এটা আমার চির সত্য জীবনের অংশ না, কোনো অযাপিত জীবনের খণ্ডাংশ। 

আমার হাতে খচখচ করছে এগুলো কী। লিফলেট। কয়টা বাজে? আমার লম্বাটে আইফোন নাই পকেটে। আমার বাম হাতে ঘড়ি পরা। এটা আমার দাদুভাইয়ের ঘড়ি। ঘাম লেগে স্টিলের রঙ উঠে গেছে।  

মোজাফফর আসলো, ‘আপনি শুধু? কেউ আসেনি?’ 

আমি মাথা নাড়লাম। 

‘এতবার করে বলার পরও কেউ আসলো না! দিদি অবশ্য বলছিলেন এটা খুব অসময় হয়ে যায়। দাঁড়ান আমি আমাদের ছেলেদের ফোন দিচ্ছি। ওদের তো আসার কথা। ধুর—’         

আমার মধ্যে কোনো অস্থিরতা নাই। আমি একটা ইয়াবড় সুয়ারেজ পাইপের ওপর অন্যমনস্ক বসতে গেলাম। বাবারে, রোদে তেতে আছে। তৎক্ষণাৎ আবার দাঁড়িয়ে গেলাম। কেউ না-আসাই স্বাভাবিক। আমি লাল সাদা লিফলেটটা দেখছি নেড়েচেড়ে। লিফলেটের টাকা এখনো প্রেসে দেয়া হয়নি। ফোন দিয়ে অস্থির করবে। 

গণেশদা এলেন। সাথে তিনজন মহিলা যাদের আগে দেখিনি। গণেশদার সাদা পাঞ্জাবির ভেতর দিয়ে কালো শরীরটার অবয়ব দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। মাথার চুল বেশি পেকেছে মনে হচ্ছে হঠাৎ। গণেশদা এসে আমার পিঠে একটা জোরে বাড়ি দিলেন, মুখে সবসময় ছড়ানো হাসি, ‘কীরে? ক্লান্ত নাকি? ডেকোরেটরের ভ্যান রাস্তায় কী একটা ঝামেলায় পড়েছিল। তুই নাকি ফোন ধরিস নি। আসছে তোর চেয়ার, একটু অপেক্ষা করতে বলেছে। এই ছোলা মাখানো ছেলেটা যে দাঁড়ায় সে কই রে?’

গণেশদাকে দেখলেই সবসময় নিজেকে কেমন নির্ভার লাগে। মোজাফফরও ফোন নামিয়ে হাসিমুখে কাছে এসে দাঁড়াল, যেন হাঁফ ছেড়েছে, ‘১০-১২ জন আসবে। খাওয়া হয়নি ওদের সবার তাই দেরি।’ 

‘এই ম্যালা এই ম্যালা,’ গণেশদা দুই হাত ছড়িয়ে বললেন, নিজে থেকে কম লোক আসলে বুঝবি কাজের কাজ করছিস। আর লোকের ঠেলাঠেলি পড়লে নিজের কাজকে সন্দেহ করবি, ঠিক করছিস তো? নাকি? কী বলিস পাগলিরা? এই তোদের পরিচয় করিয়ে দেই…’ 

কোথাও সাইরেন বেজে উঠল। বড় রাস্তা থেকে এদিকে আগিয়ে আসছে শব্দটা। পুলিশের গাড়ি? গণেশদার নামে তো ওয়ারেন্ট আছে। গণেশদার সাথে একজন মহিলার হাতে কালো কাপড় ভাঁজ করা ছিল আগে খেয়াল করিনি। উনি সেটা মেলতে মেলতে গণেশদার হাতে তাড়াতাড়ি ধরিয়ে দিলেন, বুঝলাম বোরকা। বোরকা হাতে নিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে তাকিয়ে ভেংচি কাটতে কাটতে গণেশদা দোড়ালেন বস্তির গলির ভেতরে। 

এখন দুইটা আলাদা সাইরেন আসছে একই জায়গা থেকে।   


জাহাজের সাইরেন। ম্যাপ দেখাচ্ছে আমি আমার গন্তব্যের সামনে। ইটের দেয়ালে কাঠের সাইনবোর্ডে খোদাই করে লেখা: শন অ্যান্ড মার্লো। নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লেখা, ১৮১১ হইতে। তুলনামূলক ছোটই বলা চলে এমন মাপের দরজা দিয়ে ঢুকলে ভিতরে বিশাল একটা হলঘরের মতো। তার চার সীমানা ঘেঁষে বিভিন্ন আকৃতির ছোটবড় বস্তা। বাঁয়ে বড় একটা কাঠের ডেস্কের দুই প্রান্তে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে দুইজন মহিলা অপারেটর। ঘরময় নানা লোকের পায়চারি। বুঝলাম আমি পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছি। আমার বিপরীত দিকে প্রধান ফটকের কাঠের পাল্লা হাট করে খোলা। বাইরে কন্টেইনারবাহী একটা ট্রাক এসে দাঁড়াল। কিছু লোক মালপত্র নিয়ে আসছে ঘরের ভেতর। ডেস্কটার পিছনে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। হলঘরের ডানে মেঝে থেকে ছাদ অবধি উঁচু উঁচু তিনটা জানালা।   

 আমি ডেস্কের কাছে গিয়ে বললাম, আমার ডেলিভারি এসেছে।

একজন অপারেটর মাথা না-তুলেই বলল, ‘ক্যামেরার দিকে তাকাবেন, প্লিজ।’ হাত দিয়ে একটা ক্যামেরা দেখিয়ে দিল। ডেস্কের এক পাশে ছোট লম্বা কালো স্টিকের ওপর একটা কালো গোলক। আমি সেটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। 

‘স্বাগতম মিস্টার… মিস্টার…’ আমার নামের একটা বিদঘুটে উচ্চারণ করে বলল, ‘একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে প্লিজ।’ পাশে রাখা কলিং বেল চেপে সে একটা ছোট স্লিপ প্রিন্ট দিল। লম্বা দাড়িওয়ালা একজন লোক এসে দাঁড়ালে তার হাতে স্লিপটা ধরিয়ে দিল। স্লিপ নিয়ে দাড়িওয়ালা ওপরতলায় উঠে গেল। মহিলা কম্পিউটারের পর্দা থেকে কিছু পড়ে আমার দিকে হাসিমুখে তাকায়, ‘আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে স্যার, শুভ জন্মদিন!’ 

‘ধন্যবাদ।’

‘এটা আমাদের জন্য আনন্দের,’ ডেস্কটপে কল বেজে উঠতেই সে কানে হেডফোন দিয়ে আমাকে সোফা দেখিয়ে দিল, ‘বসুন প্লিজ। বিল করব?’

আমি ঘাড় নেড়ে ডেস্ক থেকে কিছুটা সামনে কোনাকুনি করে রাখা কালো সোফায় বসলাম।

‘শন অ্যান্ড মার্লো থেকে বলছি, শুভ বিকাল…’ 

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার ফোন বেজে উঠল। কলে থাকতেই থাকতেই মহিলা বিল পাঠিয়ে দিয়েছে। কত ক্রেডিট রাখল কে জানে। সারপ্রাইজ থাকুক, পরে দেখব। দাড়িওয়ালা নেমে এল দুই হাতে একটা ছাদখোলা স্বচ্ছ কন্টেইনার ধরে। কন্টেইনারের ভেতর টবসহ গাছ। অসাধারণ। আমি উঠে গিয়ে সরাসরি লোকটার হাত থেকেই দুই হাতে নিয়ে নিলাম জিনিসটা। অপারেটর আর স্টাফ যতক্ষণ পেছন থেকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে থাকে আমি সোজা তাকিয়ে দুই হাতে কন্টেইনার ধরে হাঁটা দিলাম। যেদিক দিয়ে এসেছিলাম সেদিক দিয়েই বের হলাম। 

ইটের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক ব্লক পরে পাতাল রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে নেমে গেলাম। মাত্র দুইজন প্লাটফর্মে। একজন কোরীয় মেয়ে আর একজন স্যুটেড সাহেব। মেয়েটা লেবেনচুষ চাবাতে চাবাতে আমাকে অবাক হয়ে দেখে। লোকটার কোনো নজর নাই এদিকে। এক হাতে ফোন চালাচ্ছে, আরেক হাতে স্যুটকেস ধরা। 

গাড়িতে বসার জায়গা পেলাম। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় একজন মেয়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল পাত্রটা ধরার জন্য। হাসিমুখে বলেছি, লাগবে না। পাত্রটা কোলে নিয়েই বসলাম। ভিতরে একটা ছোট তেঁতুল গাছ, ছোট বলতে, বনসাই। হঠাৎ কেমন যেন উদাস উদাস লাগল। গাছটাকে আমি চিনি। ওর বয়স আমার প্রায় সমান। এক মহান্তের দেয়া বীজ থেকে উঠেছিল। এই টবটা অপরিচিত। কিন্তু সুন্দর। আগে যে টবে ছিল সেটা সুন্দর ছিল না। হাতবদল করা মাটির টব, টবের ওপর প্লাস্টিক রঙ, সেটার চলটা ওঠা, ধারে ফুল-ফুল নকশা, কানি ভাঙা। এই টবটা রুচিশীল, মসৃণ, এক রঙের অনেকটা অফ হোয়াইট টেক্সচার, সিরামিক, কিন্তু পুরু না, সেজন্য ভারী না। জাহাজে করে গাছ পাঠানো যায় আমার জানা ছিল না। অনেক কায়দা করে পাঠাতে হয়েছে নিশ্চয়ই। এই অভিনব চিন্তাটা মাথায় আনাই অনেক সময় সাপেক্ষ। আরও সময় নিয়ে উপযুক্ত পণ্যদূত খুঁজতে হয়েছে। আমার জন্মদিনের উপহার, এর পেছনে অনেক মানসিক শ্রম ব্যয় করা হয়েছে, এই অনুগ্রহের শোধ দিতে হবে অবশ্যই, সমান অথবা বেশি শ্রম ব্যয় করতে হবে। বেশি, নয়তো সমান। 

আমি গাছটার দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনলাম। কাণ্ডটা দুই আঙুল সমান মোটা। বয়স্ক তেঁতুল গাছের মতো বাকল। কালচে খয়েরি কাণ্ড আর ডাল। হালকা সবুজ চিরল চিরল পাতা স্বাভাবিক গাছের তুলনায়  ছোট, তাই থেকে বোঝা যায় বনসাই। নতুন ডালের মাথায় ফুলের মতো দেখতে লাল লাল কচি পাতা। দক্ষ হাতে ডাল ছেঁটে গাছটাকে অতি সম্প্রতি সুন্দর আকৃতি দেয়া হয়েছে। আমার যখনকার কথা মনে পড়ে তখন ডালপালা ছাঁটা হোত না। পাতাগুলো জোড়া জোড়া হয়ে বুজে আছে। আমি আশেপাশে তাকিয়ে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে চট করে মুখে দিলাম। যতদূর সম্ভব মুখ না-নাড়িয়ে দুই পাটি দাঁতের মাঝে রেখে চাপ দিলাম। গাছটা কষ্ট পেল কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। একবার তেঁতুলের মাটিতে জল বেশি জমেছিল। গাছের কোনো যত্ন নিতে জানতাম না জল দেয়া আর মাঝে মাঝে উপরিতলে নিড়ানি দেয়া ছাড়া। ওর শিকড়ে কোথাও পচন ধরেছিল। ভেবেছিলাম মারা যাবে। কত রকম চেষ্টা করেছিলাম দ্রুত মাটি শুকানোর। মনে পড়ে আম্মা আয়াতুল কুরসী পড়ে ওর গায়ে ফুঁ দিয়েছিল। কীভাবে কীভাবে যেন বেঁচে গেল তারপর।  

আমার একটা হাত চলে গেল টবের মাটিতে। গাছটাকে খুব সাবধানী হাতে নতুন মাটি দিয়ে রিপটিং করা হয়েছে বুঝতে পারছি। সেটা ওর জন্মের পর প্রথম মাটিবদল। আগে এত উন্নতমানের মাটিতে ছিল না। এই মাটি কালচে লাল, ঝুরঝুরে, বালিমিশ্রিত। আমি একটা ছোট্ট দলা দুই আঙুলে চাপ দিতেই ঝুরঝুর করে ভেঙে আমার আঙুলের ডগায় মিশে গেল। আমি এবার সরাসরি হাত রাখলাম মাটির ওপর।  

যখন চোখ মেললাম তখন দেখি সহায়তাপ্রবণ মেয়েটা চোখ সরিয়ে নিল আমার থেকে। বৃদ্ধ লোকটাও জানালার বাইরে তাকাল। 

যখন নামলাম তখন প্লাটফর্মের ঘড়িতে রাত আটটা বেজে তিন মিনিট। আমার এক হাতে মাটি লেগে আছে। 

 

(চলবে…)   




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

48 LAWS OF POWER by Robert Greene and Joost Elffers

Vladimir Putin The definition of power in 21st century

হারবার্ট স্পেনসারের 'জৈবিক সাদৃশ্যবাদ'

ইংরেজ সমাজতত্ত্ববিদ ও জীববিজ্ঞানী হারবার্ট স্পেনসারকে বলা হয় সমাজবিজ্ঞানের দ্বিতীয় জনক। তিনি 'সামাজিক ডারউইনবাদ'-এর একজন প্রচারক। স্পেনসারের বিখ্যাত 'জৈবিক সাদৃশ্যবাদ' সমাজ ও জীবকে বিশেষ সাদৃশ্যপূর্ণ বলে দাবি করে। হারবার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) ১। সমাজ ও জীব উভয়েই আকারে বৃদ্ধি পায়। মানবশিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়। মহল্লা থেকে মেট্রোপলিটন হয়, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্য তৈরি হয়।   ২। প্রত্যেকে আকারে যত বড় হয় উভয়ের কাঠামো জটিলতর হতে থাকে। ৩। দুই ক্ষেত্রেই, কাঠামোগত পার্থক্যের কারণে কার্যকারিতায় অনুরূপ পার্থক্য দেখা দেয়। ৪। জীবদেহ ও সমাজ উভয়েই ক্ষুদ্রতর একক দ্বারা গঠিত। জীবের যেমন কোষ রয়েছে তেমন সমাজের রয়েছে ব্যক্তি। একাধিক কোষ মিলে যেভাবে বৃহত্তর অঙ্গ গঠন করে, একইভাবে একাধিক ব্যক্তি মিলে সমাজের বিভিন্ন অংশ গঠন করে। ৫। সমাজ ও জীব উভয়ই মূলত তিন ধরনের তন্ত্র বা ব্যবস্থার ওপর টিকে থাকে। এরা হলো - বিপাক তন্ত্র (sustaining system), সংবহন তন্ত্র (distributor or circulatory system), স্নায়ু তন্ত্র (regulatory system). জীবের জন্য খাদ্য হলো এর চালিকা শক্তি, সমাজের ক্ষেত্রে যা হলো কৃ...

আমার লেখা বই

আমার সর্বশেষ উপন্যাস অধিনায়ক শাখা -  উপন্যাস প্রকাশকাল -  ফেব্রুয়ারি, ২০২০ প্রকাশক -   ভাষাচিত্র প্রচ্ছদ -  রাজীব দত্ত অধিনায়ক পড়ুন আমার প্রথম উপন্যাস রঙবাহার শাখা - উপন্যাস প্রকাশকাল - ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ প্রকাশক - ভাষাচিত্র প্রচ্ছদ -  তৌহিন হাসান রঙবাহার পড়ুন আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ অপরূপকথা শাখা -  ছোটগল্প সংকলন প্রকাশকাল -  ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ প্রকাশক -   ভাষাচিত্র  প্রচ্ছদ - তৌহিন হাসান অপরূপকথা পড়ুন আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি শাখা -  ছোটগল্প সংকলন   প্রকাশকাল -  ফেব্রুয়ারি, ২০১২ প্রকাশক -   ভাষাচিত্র  প্রচ্ছদ -  বিক্রমাদিত্য বইটি সম্পর্কে আরো জানুন বিক্রমাদিত্য's books on Goodreads রঙবাহার reviews: 1 ratings: 1 (avg rating 5.00) অধিনায়ক ...

TFP 415 WORLD CINEMA : Class Notes

Aug 14, 2023 LECTURE 2 Expressionism Reality is distorted Artist’s personal feeling From Northern Europe How did it begin? Effects of WWI  Foreign film banned Horror, insecurity, and paranoia From German romanticism  ENLIGHTENMENT ROMANTICISM Reason Emotion Progress Common good Individuality Unique potential Science and technology Rational, ordered society Nature and imagination Spontaneous, passionate life Social conventions and institutions  Resistance to social conventions and institutions First appeared in poetry and theater “The world is a laboratory” by Gottfried Benn Characteristics of german expressionist theater Distorted and exaggerated sets, props, and costumes Unease and anxiety Symbolism- character might be represented by an animal or object or a particular color Non-linear plot Confusion and disorientation Fragmented nature of the human experience The threepenny opera (1928) by bertolt brecht Characteristics of german expressionism The subjective view of the...

স্বর্গচূড়া

অবশেষে, একদিন, এতবছরের অপেক্ষার পর ট্রেনটা পেলাম আমি। সঙ্গের পোটলা-পুটলিগুলো প্রথমে কামরার ভেতর ছুঁড়ে দিলাম। তারপর নিজের নাম মুখে নিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠলাম ট্রেনে। গাড়িটা এক মুহূর্ত থামে না প্লাটফর্মে। জোর গতিতে ছুটে চলে। কারো জন্য অপেক্ষা করতে নারাজ। একজনের জীবনে একবার বই দু’বার কখনো আসে না। পাল্লা দিয়ে ছুটে তাকে ধরতে হয়। নইলে নাই। অন্য গাড়ি ধরতে হবে। কিন্তু সে গাড়ি যাবে আরেক গন্তব্যে। ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। প্লাটফর্মে সাথীকে দেখতে পাই। হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে অথচ ঠোঁটে হাসি নাই। শুনতে পেলাম মনে মনে কেবল বলছে, তোমার যাত্রা শুভ হোক। (২) প্রথম কবে সাথীর দেখা পেয়েছিলাম ভালো মনে পড়ে না। মনে পড়ে, মন খারাপ করে প্লাটফর্মে বসে ছিলাম। সাথীকে পেয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। কেন, তা মনে নাই। এরপর কত দিন, কত রাত পাশাপাশি বসে কেটে গেল। আমি আর সাথী। স্টেশন জুড়ে এত এত মুখ। কাউকে মনে ধরে নি। সাথী বাদে। সাথীর স্বজনরা একই স্টেশনে ছিল। তবু ও ছিল একা। কী জানি কেন, কখনো জিগ্যেস করা হয় নি। কিন্তু সাথী অনেক প্রশ্ন করত আমাকে। খুব অবাক হতো যে অন্যদের মতো আমার শরীরে কেন বাঁধন নাই। আমার মা-বাবার কথা জিগ...

THE ART OF SEDUCTION by Robert Greene

রবার্ট গ্রিন এখানে ‘সিডাকশন’ কথাটাকে ব্যবহার করেছেন শুধুমাত্র যৌন প্রলোভন হিসেবে নয়, বরং আরো ব্যাপক অর্থে—রাজনৈতিক, সামাজিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে যেই প্রলোভন প্রযোজ্য। এই প্রলোভনের নীতিগুলো জানলে নিজেকে ও নিজের সম্পর্কগুলোকে আরেকটু ভালোভাবে ঝালাই করা যাবে। সেইসাথে তাদের প্রয়োগ করা যাবে ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনে।    সারকথা প্রলোভন ব্যাপারটাই মনস্তত্ত্বের খেলা, সৌন্দর্যের না। ফলে এই খেলার একজন ওস্তাদ হয়ে ওঠা যেকোন মানুষেরই আয়ত্ত্বে আছে। এমন নয় যে, একজন প্রলোভনকারী তার ক্ষমতাটাকে একবার চালু আর একবার বন্ধ করেন—প্রতিটা সামাজিক ও ব্যক্তিগত লেনদেনই তার কাছে প্রলোভনের একেকটা সুযোগ। সুযোগের একটা মুহূর্তও নষ্ট করার নাই। প্রলোভনকারীরা কখনো আত্মনিমগ্ন থাকে না। তাদের দৃষ্টি থাকে বাইরের দিকে, ভিতরের দিকে নয়।  প্লেজার বা পুলক হলো আমাদেরকে আমাদের সীমার বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি, উদ্বেলিত করে দেওয়ার অনুভূতি—তা হতে পারে মানুষের দ্বারা, বা কোনো ঘটনার দ্বারা।  শেষত, যারা কিনা প্রলোভনকারী, তাদের দুনিয়াদারির সাথে নৈতিকতা ব্যাপারটার সম্পর্ক একদম নাই। প্রতিটা প্রলোভনের দুইটা উপাদান থাকে...

মিডিয়া সাক্ষরতা : আদিপর্ব

মিডিয়া সাক্ষরতা ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় জিজ্ঞাসা - মিডিয়া নিজে যতটা প্রাচীন তার চেয়ে কম পুরনো নয়। বর্তমানে তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা মিডিয়া সাক্ষরতাকে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে সত্য। কিন্তু মিডিয়ার প্রভাব ও মিডিয়া সাক্ষরতার গুরুত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন অনেক অনেক আগে থেকেই আলোচিত হয়ে এসেছে। এটাও লক্ষণীয় যে মিডিয়ার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন বিতর্ক একইসাথে নবাগত প্রযুক্তি, শিল্প (আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয় অর্থে), এমনকি সংস্কৃতির গতিপথকে সময় সময় প্রভাবিত করে এসেছে। তবে ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত পরিভাষা বা গবেষণাক্ষেত্র হিসাবে এর অস্তিত্ব ছিল না। যতদিন না বিষয়টি যোগাযোগ স্কলার ও মিডিয়া প্রফেশনালদের কাজের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তার আগ পর্যন্ত (কিংবা এখনো কিছুসময়) যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট ভাবনাসমূহ পরিচালিত হয়/হয়েছে তাত্ত্বিক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও ভাষাতত্ত্ববিদদের দ্বারা। এ যাবৎ মিডিয়া সাক্ষরতা নিয়ে যত তত্ত্বীয় চিন্তা হয়েছে তাতে --- প্লেটো থেকে ফ্রয়েড, সসার (১) থেকে সিক্সাস (২) --- প্রত্যেকেরই রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। উৎপত্তি ও সংজ্ঞা এই তথ্য মোটেও অভিন...

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি : প্রাচীন অর্বাচীন তর্ক

এই লেখাটা ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় যোসেফাইট কালচারাল ফোরামের বার্ষিক ক্রোড়পত্র ত্রিলয়-এ। আমি তখন সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র প্রাচীন -  ওই অর্বাচীনদের আমি শতবার সতর্ক করেছি, আর যা-ই করো, আত্মপরিচয় কখনো হারাবে না। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি এদের সামনে যেন ঘোর অন্ধকার। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছু ভুলে গিয়ে এরা আজ পাশ্চাত্যের অনুকরণে ব্যস্ত। নিজের চশমার 'স্টাইল'টা যতই বাজে হোক না কেন ওটা পরেই তুমি স্বচ্ছ দেখবে। তা না করে যদি অন্যের চশমা চোখে দাও, তোমাকে মানাবে হয়তো ভালো কিন্তু হোঁচট খেতে হবে পদে পদে। অর্বাচীন - তোমার কথায় কেমন যেন ছাপাখানার গন্ধ। তোমার বয়স হয়েছে। তাই চোখে সমস্যা। চোখের পাতা বন্ধ করে তুমি অতীতটাকে সোনালি রঙের মনে করো। আর চোখ মেলে ভবিষ্যৎ দেখতে গেলেই তোমার মনে হয় সেটা বুঝি অন্ধকার। অর্বাচীনদের যতই গালি দাও।পশ্চিমা চিকিৎসার সাহায্য নিয়েই দেখো না চোখটা ভালো হয় কি না। প্রাচীন - বাবা! আজকালকার ছেলেমেয়েরা এক কথার পিঠে একশ কথাকে চাপায়। আমাদের যুগে বড়রা বলত। ছোটরা শুনত। তার থেকেই শিক্ষা নিত। এখনকার ছেলেমেয়দের কথা ...

ইফরিত

মোহাম্মদপুরের এক ভীষণ ব্যস্ত সড়কের পাশে আমাদের দুই বেড-ড্রয়িং-ডাইনিং এর ভাড়া বাসা। বাসাটা যখন নেয়া হয় তখন আমি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। এই এলাকায় ভাড়া তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সদ্য তোলা বাড়ি আর তমালের অফিসও কাছেই হয় তাই ভাবলাম - এই ভালো। বাসায় উঠে গোছগাছ তখনো সারিনি। এক মাস গেছে কি যায়নি তখন থেকে সমস্যাটার শুরু। তমাল অফিস করে ফিরতে রাত নয়টা দশটা বাজত। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও সময় নিত না। আমি কোনদিন ওর সাথে শুয়ে পড়তাম, কোনদিন গল্পের বই পড়তাম অথবা ডায়েরি লিখতাম। এক রাতে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে কিছু একটা পড়ছি হঠাৎ দরজায় টোকা দেয়ার মতো আওয়াজ পেলাম। আমার কান খুব খাড়া। আওয়াজটা বাইরের ঘর থেকে এসেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাত্রি একটার সময় কে বড় দরজায় টোকা দিবে? পড়ায় মন ফিরিয়েছি মিনিটও হয়নি আবার... নক নক। খুব স্পষ্ট আওয়াজ। ভাবলাম সত্যিই বুঝি কেউ এসেছে। রাত হয়েছে বলে কলিং বেল টিপছে না। উঠে গিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রাখলাম। সারারাত বাহিরের আলো জ্বলত। কাউকে দেখলাম না। ঘরে ফিরে আসার কিছক্ষণের মধ্যেই আবার... নক নক। এবার আর দেখতে গেলাম না। দরকার হয় বেল বাজাবে। শীত করছিল। আলো নিভিয়ে তমালকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল...

TFP 207 Personal Note : SET DESIGN AND ART DIRECTION

FILM AS A GRAPHICO-NARRATIVE STRUCTURE How is film different from other art media? → Every art form has its basic element. For literature, it is the word. For painting, it is paper. While sculptures and architecture are both material arts, the biggest difference between sculpture and architecture is that, unlike the latter, sculptures don’t necessarily require an interior. Theatre is basically about the performance. All these elements are present in the film. However, moving space is the basic element of the film. Space is the predominating feature in a film e.g. the EST shots. Temporality is like music duration that theatre hasn’t. That’s why the film has a leitmotif e.g. the camera in ‘Rear Window’.  The film is a unique art form in the sense that, visual against a specific time is the only prerequisite in film.  Theatre needs casts though it’s not essential for film. A true film should be the one that is difficult to transform in any other media. Although literature and the...