
My rating: 5 of 5 stars
ডেস্কে বই জমছেই, ছোটগল্পের বই বাদে, পাই না, লেখে না কেউ—জানি কী লেখে—গাছ মারে শুধু শুধু। রিফুর বই আব্বা অল স্টার রেকমেন্ডেশনসহ দিয়ে গেল। গল্প-কবিতা-ক্যাপশনে ‘রাষ্ট্র’ ‘রাষ্ট্র’ ‘রাষ্ট্র’ লিখতে লিখতে ছাবাছাবা করে ফেলেছে সবাই, তারপরও, এই নামকরণটায় বাড়তি মাথা খাটানোর ইঙ্গিত আছে। এক ঘণ্টায় বইয়ের অর্ধেক পড়েছি, চোখের আন্দাজে অর্ধেক, যে অর্ধেক বাকি সেটুক এটা লেখার পর পড়ব। সম্ভাব্য পাঠকের কষ্ট কমাতে আগেই বলে নিচ্ছি: গল্পগুলো সময়কে উশুল করে। এখনই বলতে পারছি কারণ ভাল কিছু পড়লে সেটা নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করে, সবসময় পারিনা যেহেতু আমার সৃজনশীলতা ভোঁতা হতে হতে হাওয়া হওয়ার উপক্রম। অর্ধেকটার নির্যাস থাকতে থাকতেই পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখছি কারণ এতক্ষণ ওনার সব গল্প একই কথা বলল। একটা গল্পের প্রেক্ষাপটে অন্য গল্পের এক-দুই-তিনজন চরিত্র পিছন দিয়ে হেঁটে চলে গেল, বারান্দা দিয়ে দেখল, দূরে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট কথা বলল নিজেদের মধ্যে। সবাই রেগে যাচ্ছে, গালি দিচ্ছে, ভয় পাচ্ছে… অনেকক্ষণ চুপ থেকে অন্য একটা কথা বলছে। এগুলো করোনার পর থেকে গণহত্যা অবধি মানুষদের গল্প, লেখার ক্রমানুসারে ছাপানো না—তাতে কিছু যায়ও আসে না—যেমনটা বললাম, কে কোন্ গল্পের মানুষ সেটা নিয়ে রিফুর জোরাজুরি দেখিনি। বাইডেন-মোদি-হাসিনার পৃথিবী সরাসরি কিংবা কিছুটা দূর দিয়ে তাদের সবার জীবনকে অন্যরকম করে দিয়েছে। অনেকেই শ্রেণীচ্যুত, হারিয়ে যাওয়া, উন্মাদ বনে যাওয়া, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং প্রায় সকলেই থ্যানাটোসে ভোগা, দমিত কাম; যারা খুব পরিচিত দুরুক্তি, কানে-লেগে-থাকা ডায়ালেক্ট, এমনকি কই-যেন-শোনা-শোনা এরকম আস্ত এক-দুইটা বাক্য পর্যন্ত ছাপার অক্ষরে ডেলিভার করছে। এই পাগল, ডান্ডিখোর, মাইক্রো, বরিশাইল্যা, দীর্ঘশ্বাস আমার কাছে এত আনক্যানি-অস্বস্তিদায়ক পর্যায়ের জীবন্ত তার মানে নিশ্চয়ই অনেকের কাছেই তা-ই লাগবে, লেগেছে।
রিফু মোটামুটি একটা মীমাংসা দেখাচ্ছেন ওই প্রশ্নটার, সামাজিক দায়বদ্ধতা নাকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য—কোনটাকে সম্মান দিয়ে গল্প বলব? রিফুর ব্যক্তিগত সুতীব্র রাগ-ক্ষোভ-হতাশা নিয়ে জোরে জোরে টাইপ করা একেকটা শব্দ কোনো না কোনভাবে একটা বিশ্রী সময়ে বেঁচে থাকা আমাদের সবার, বেশিরভাগের, গলার কাছে এসে থাকা কথাগুলোকে ভাষা দিয়েছে। ওনার গল্প বলায় কোনো রাখঢাক নাই, নৈর্ব্যক্তিক-অরাজনৈতিক হওয়ার সামান্য চেষ্টা নাই, আবার রিয়ালিস্ট জনরায় সেঁটে থাকার জেদ নাই। সবগুলো গল্পকে একই তারিফ করা যায় না, করার কথাও না; একই কথা বললেও একই ধরনে কথা বলেননি রিফু, ধরন বদলে বদলে দেখেছেন। বইয়ের মুখবন্ধে ওনার লেখা নিয়ে আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট, পড়তে গিয়ে বুঝলাম সত্যিই গল্পগুলো বারবার পড়লে ক্লান্তি আসবে না। তবে, পাঠক হিসেবে আমি—হয়তো আমি একাই—ওনার থেকে এরকম গল্পেরও অপেক্ষা করব যেটা একবার পড়তেই ক্লান্তি আসবে, মাথা ধরবে, কিছুক্ষণ রেখে দিয়ে আবার ধরতে হবে।
যদি একদিন আমাদের প্রিয় শহর দুম্পটাশ হয়ে যায় তাহলে রাজাদের রাজ্যে রাষ্ট্ররা সাক্ষ্য রেখে যাবে কী দুর্ব্যক্ত ডিস্টোপিয়ায় কয়েক কোটি লোক কোনমতে বেঁচে ছিলাম।
View all my reviews

My rating: 5 of 5 stars
আমার প্রজন্মে নিজেকে কমলকুমার মজুমদারের অনুরাগী পাঠক বললে প্রায় সব জটলাতেই “ব্যাটা প্রিটেনশাস” এমন একটা কটাক্ষ নিশ্চিত বরাদ্দ। আমি মহাশয়ের সব লেখা পড়ে ফেলিনি তবে প্রথম পাঠই (উইয়ে কাটা 'গোলাপসুন্দরী') আমাকে বিস্ময়ে, উচ্ছ্বাসে, শ্রদ্ধায় হতবিহ্বল করেছিল। 'ধুলায় অমৃতপ্রাণ' বইটা যখন হাতে তুলেছিলাম তখনো কমলকুমারের অনেককিছুই পড়া বাকি। ভেবেছিলাম, বইটা হবে কমলমধু অন্বেষণ-আস্বাদনে আমার সঙ্গী/গাইড। হয়েছেও তাই, মস্তিষ্কে শৃঙ্গার দেয়া কিছু একটা পড়ে ফেলার পর কারো সাথে আলাপের ছটফটানিটুকুকে সফলভাবে নিবৃত্তি দিয়েছে ‘ধুলায় অমৃতপ্রাণ’।
নবযুগের স্টলের সামনে দাঁড়াতেই ‘কমলকুমারের কথাসাহিত্য’ শিরোনামটা আমার নজরে আসে। পরে খেয়াল করলাম ধ্রুব এষ প্রচ্ছদপটে মিশিয়ে রেখেছেন—সহজে চোখে পড়ে না এমনভাবে—‘ধুলায় অমৃতপ্রাণ’ কথাটা। কমলকুমারের লেখাকে এর চেয়ে সার্থক নাম আর কী দেয়া যেত।
এই বই কেনার আগে যে কয়টা গল্প পড়া ছিল তার মধ্যে ‘লাল জুুতাে’ আমার সবচেয়ে প্রিয়। প্রসঙ্গকথা ও ফ্ল্যাপের লেখা পড়ে মূল বইয়ের পাঠ-উদ্বোধন করলাম ওই গল্প আলোচিত যে অধ্যায়ে সেখান থেকে; যার নাম ‘লাল জুতাে: বিকল্প নন্দন কিংবা মাতৃপ্রতিমা’। একটা ছোট অধ্যায় কিন্তু শিরোনামে শ্লেষালঙ্কার হিসেবে নন্দনের ব্যবহার আমাকে ভাবাল। উপসংহারে এসে ইউরোপীয় বনাম দেশজ সংস্কৃতিতে নারীর দুই সত্তার উল্লেখ—এমন কোনো উদ্ঘাটন নয়—তবে আমার ওই গল্পপাঠপ্রতিক্রিয়ার সমান্তরাল বলে আরো ভালো লাগল।
এরপর পড়লাম ‘গোলাপসুন্দরী: শবযাত্রায় জীবনের মায়াস্বর’। আমি মূল উপন্যাসের একটা বাক্যাংশ উল্লেখ করি—গবেষক যেটার অনুচ্ছেদসুদ্ধ উদ্ধার করেছেন বিলাসের “উজ্জ্বল জীবনস্পর্শী রূপ” দেখাতে—অপরিচিত পাঠক বুঝবেন কী আগ্রাসী ভাষা কমলকুমারের: “...দূর কোন হরিত ক্ষেত্রের হেমন্তের অপরাহ্ণ মন্থনকারী রাখালের বাঁশরীর শুদ্ধ নিখাদে দেহ ধারণ করত সুডৌল দ্যুতিসম্পন্ন বুদ্বুদগুলি ইদানীং উঠানামা করে, এগুলি সুন্দর, উজ্জ্বল, বাবু, অভিমানী আশ্চর্য্য।” এই পড়ার পর থেকে আর সবার বাক্যগঠন আমার শুকনা শুকনা লাগে, সত্যি। এই অধ্যায়ের আলোচনাও আমাকে তৃপ্ত করেছে। যেমন, বইয়ের অনেক জায়গাতেই বিশেষ করে মনে হয়েছে—হ্যাঁ, কমলকুমারের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়েছে।
গল্পসমগ্র থেকে ‘মল্লিকা বাহার’ গল্পটা আমি পড়ি ‘ধুলায় অমৃতপ্রাণ’ কেনার পর। চমকে উঠেছিলাম পড়ে। চমক টাটকা থাকতেই আলোচ্য বইয়ের সূচিতে যেয়ে দেখি এই গল্প নিয়ে একটা অধ্যায় আছে—’মল্লিকা বাহার: অপরাহ্ণে ফোটা ফুল’। সেখান থেকে জানলাম ‘মল্লিকা বাহার’ সমকাম নিয়ে লেখা বাংলা সাহিত্যের প্রথম গল্প, যদিও “সমকামের গল্প” এটি নয়—গ্রন্থকারের এই মত।
বইয়ের আর একটা অধ্যায় নিয়ে বলে ক্ষান্ত হব। কী চমৎকার অনুপ্রাস সেই অধ্যায়ের শিরোনামে: ‘প্রেম ও স্বপ্নের ধূসর গোধূলি’। একটি নয়, কয়েকটি গল্প আলোচিত হয়েছে এখানে। পড়তে যেয়ে—বিশেষত ‘মধু’ গল্পের সমালোচনা যে অংশে—জোরালোভাবে অনুভব করলাম, গ্রন্থকার খোদ একজন সাহিত্যিক বটেন। সুনির্দিষ্টভাবে কোনো গল্প-উপন্যাসের আধেয় পর্যালোচনাকৃত অধ্যায়গুলো ছাড়াও ‘কমলকুমারের শিল্পিমানস ও ভাষারীতি’ প্রভৃতি অধ্যায় শিল্পী কমলকুমারকে নিয়ে আমার উছলে ওঠা আগ্রহের কিছুটা প্রশমন ঘটিয়েছে।
আরো কিছু গল্প নিয়ে পড়ার আগ্রহ ছিল—এক বইয়ে আর কত পাব। বইটার ‘সার্বিক পাঠকপ্রিয়তা’ কামনা করি এই গতানুগতিক কথা দিয়ে শেষ করতে পারছি না যেহেতু সেই অসম্ভব ঘটনা ঘটলে আর আয়রনিটা থাকে না। আয়রনি এখানেই যে, এটা কমলকুমার মজুমদারের কথাসাহিত্য নিয়ে লেখা বই: কমলকুমারের কথাসাহিত্য ধুলায় অমৃত প্রাণ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন