ছেলে চাকরি জুটিয়েছে। এই বেলা বউও জুটিয়ে ফেলা চাই। পাত্রী ফাহাদের নিজের পছন্দ করা। আর আঙ্কেল-আন্টিও চাচ্ছেন ছেলে বিয়ে-থা করে সংসার পাতুক। বিপত্তি কেবল এক জায়গাতেই। পাত্রীকে ফাহাদ এখনো নিজের পছন্দের কথা বলে উঠতে পারেনি। পছন্দের কথা কেন, কোনো ধরনের কোনো কথা বলার সুযোগই বেচারার কাছে এখনো আসেনি। অতঃপর ছেলে আমার শরণাপন্ন হলো। আলাপ করিয়ে দিতে হবে দুজনার।
এইবার আমার ইতিহাস বলি। ইতিহাস অতি সংক্ষিপ্ত। আমি মোড়ের কোচিং সেন্টারে ইতিহাস পড়াই। কোচিং সেন্টারের পরিচালক আমাদের স্কুল বেলাকার শিক্ষক মীরজাফর স্যার। ছাত্রদের ওপর রাগলে উনি নির্বাক হয়ে তার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে থাকতেন। কদাচিৎ ডান কবজির ওপর বাম হাত রেখে জবাই করার ভঙ্গি করতেন। সেই হতে তার অপর নাম কসাই স্যার। রিটায়ারমেন্টের আর বাকি পাঁচ বছর। অবসর জীবনটাও পড়িয়ে পার করবেন বলে এখানে ‘বিজ্ঞান ইনস্টিটিউশন’ নামের কোচিং সেন্টার খুলেছেন। যেখানে “বিজ্ঞানসহ সকল বিষয় যত্নসহকারে"পড়ান হয়। অঙ্ক-বিজ্ঞান স্যার নিজে পড়ান। বাকিটা সময় প্রবেশদ্বারে ধামড়া ডেস্কটায় বসে থাকেন। যদিও এখন এক অর্থে আমি ওনার সহকর্মী, তবু ওই অবস্থায় ওনাকে দেখলে আজও গা কেমন ছমছম করে ওঠে। সম্ভবত স্কুল জীবনে শিকড় গেড়ে বসা সেই আতঙ্ক। চেহারাখানা দেখলেই কোনো এক অসমাপ্ত বাড়ির কাজের কথা মনে পড়ে আর আপনাআপনি গলার কাছটায় হাত চলে যায়।
স্যারের মেয়ে অহনা। বাবার কোচিংয়ে ইংরেজি পড়ায়। সেই ছোটবেলা থেকে তাকে আমরা চিনি। স্যারের কাছে দল বেঁধে যখন পড়তে আসতাম, কলা বেচার চেয়ে রথ দেখার উদ্দেশ্যই ছিল মুখ্য। কিন্তু ওইটুকুই। স্বয়ং মীর জাফর যার পিতা তার সাথে কি যেচে কথা বলা যায়! অহনাও সাক্ষাৎ ঝাঁসির রানী। বিজ্ঞান ইনস্টিটিউশনের বাঁদরগুলো মাঝে মধ্যে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অহনা হয়তো পাশের ঘরে ক্লাস নিচ্ছে। আমার ঘরে দুমদাম ঢুকে ‘সাইলেন্ট’ বলে একটা হুংকার ছাড়ে। অমনি ক্লাস ঠাণ্ডা। নিজের ঘরে ফেরার সময় এমন একটা চাহনি সে প্রতিবার উপহার দেয় যেন বাঁদরগুলোর বাঁদরামিতে আমার কোনো প্রচ্ছন্ন ইন্ধন আছে।
যাই হোক, আমার উপর একটা দায়িত্ব পড়েছে। শুধুমাত্র প্রতিদিন মুফতে বিরিয়ানি খাবার সৌজন্যে নয়; ফাহাদকে সাহায্য করছি কারণ আমি মন থেকেও চাই ফাহাদ এবার গাটছড়া বাঁধুক। কারো সাথে কেন যে ছেলেটার সম্পর্ক টেকে না কে জানে। ওর স্বভাব কিছুটা স্বেচ্ছাচারি মানলাম। একজনের সাথে সম্পর্ক করার তিন মাসের মাথায় অন্য মেয়েকে প্রেম নিবেদন করে বসে মানলাম। তা ওর মতো সুদর্শন, পয়সাওয়ালা, চটপটে ছেলে কিছুটা ছটফটে তো হবেই। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবারের সম্পর্কটা স্থায়ী হতে বাধ্য।
কেননা অহনাকে ও ছোটবেলা থেকে পছন্দ করত জানি। কে-না করত মহল্লার মধ্যে আর স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে! আমিও চাই অহনা ফাহাদের মতো যোগ্য কারো হাতে পড়ুক। ছেলেটার চালও ভালো, চুলোও শুনেছি বাসায় দুই-দুইটা। উভয়েই সুখী হবে।
(২)
মীর জাফরের ডেস্ক ফাঁকা। ডান দিকে ক্লাস ফাইভের মডেল টেস্ট চলছে। ডে-শিফটের ছাত্রহীন ঘরটায় উঁকি মারলাম।
‘আব্বু বাসায় চলে গেছেন। নামাজের পর আসবেন।’ খাতায় লাল কলম চালাতে চালাতে একবারও মুখ না তুলেই কথাটা বলে অহনা।
‘না মানে... আপনার সাথে একটু কথা– ’
‘হ্যা, বলেন কী দরকার– ' তবু মুখ তুলল না।
‘একটু বসি?’
এইবার অহনা তাকাল। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে টেবিলে রাখল, ‘আপনার বেতন তো গত সপ্তাহে দিয়ে দেয়ার কথা।’
কিন্তু দেয়া হয় নি। যাক গে, আমি বেতন-ভাতার দাবি নিয়ে এখানে আসি নাই। বেশ কয়েকবার আমতা আমতা করে ঘটনাটা বললাম। অহনার কোনো ছেলেবন্ধু নাই সে খবর আমার জানা। এক-দুই বছরের মধ্যে বিয়ে করবে না তাও জানতাম। আমিও তো আর আজই কবুল বলতে বলছি না। আমি তো দুজনে একবার দেখা করিয়ে দিতে চাই। ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার সময় পিছন থেকে ধাক্কা দেয়ার ব্যাপারটা আর কি। তারপর ওরা নাহয় দুই-এক বছর প্রেম করে নিবে। আপাতত ডেট চলুক। আমি জানি ফাহাদকে ওর পছন্দ না হয়ে যাবেই না। আলাপটা হয়ে যাওয়া চাই তো!
‘তাহলে, আপনি আপনার ফ্রেন্ডের হয়ে আমাকে প্রপোজ করছেন?’
‘অ্যাঁ? হ্যা তাই বটে – না না তা কেন হবে। আমি তো শুধু... ফাহাদ তো শুধু একবার দেখা করার সুযোগ চায় আপনার সাথে। আমার কাজ পোস্টম্যানের।’
‘দেখা করতে চায় তো সে কথা আপনার বন্ধু নিজে এসে বলছেন না কেন? আপনাকে ঘটকালি করতে হচ্ছে কেন?’
কারণ মীর জাফর। কথাটা মুখ ফসকে বলতে গিয়েও চেপে গেলাম। ছানাবড়া চোখ করে অহনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ধারণা ছিল প্রস্তাবটা পাওয়া মাত্র ‘দূত অবধ্য’ প্রথা না মেনেই অহনা আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। উনি যে তা করছেন না তাতেই আমি সন্তুষ্ট।
‘আমি পরশু ফ্রি আছি। কোথায় দেখা করতে হবে বলুন। আর হ্যা-' অহনা বলল, ডেটিংয়ের দিনে সে নিজেই যেন আসে। তার হয়ে আপনাকে যেন না পাঠিয়ে দেয়।
(৩)
অহনা রেস্টুরেন্টে বসেই বলল, সরি, লেট হয়ে গেল। ভালো কথা, আপনি আজকেও ওনাকে এনেছেন কেন?’
ওনাকে অর্থাৎ আমি! আমি মূলত এসেছি খাব বলে। ঘটকালির পুরস্কার স্বরূপ আমার খাওয়া পাওনা আছে। ফাহাদের আজ দুজনকে একসাথে খাওয়ানর কথা। খেয়েই আমি সরে পড়ব।
‘আসলে আপনি যদি আবার আমাকে চিনতে না পারেন সেজন্যই ওকে ...’ পুরো কথা শেষ করল না ফাহাদ। আমি এদিকে বুঝতে পারছি না, আমার কি চলে যাওয়া উচিৎ?
‘আপনাকে না চেনার কী আছে? আপনাকে ভালো করেই চিনি।’
ফাহাদ একটু হাসল। অত চমৎকার করে আমি জীবনেও হাসতে পারব না। ‘অহনা,’ গম্ভীর হয়ে ও বলে, যেন ও নিপুনভাবে জানে কখন হাসতে হবে আর কখন থামতে হবে, ‘সত্যি কথাটা বলেই ফেলি। তোমাকে কেন আজ দেখা করতে বলেছি। আমি আসলে... ছোটবেলা থেকে তোমাকে ভালোবাসি। বলব বলব করে কথাটা কোনদিন বলা হয় নাই। শেষমেশ আমার এই বন্ধুটির মাধ্যমেই তোমাকে মনের কথা বলার সুযোগ পেলাম। আসলে, তুমি ব্যাপারটা কীভাবে নাও তাই ভেবে বলি বলি করেও বলে উঠতে পারি নি।’
‘আচ্ছা? আমার তো মনে হয় আপনি একটা ভীতুর ডিম। আর সুবিধাবাদী।' অহনা খাবার অর্ডার করল।
‘এক্সকিউজ মি!’
‘আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন আমার বাবা কেমন মানুষ। তাই নিজে ঝুকি না নিয়ে এই আব্দুলকে পাঠিয়েছেন বিপদের মধ্যে। আর আব্দুলটাও বন্ধুর জন্য নিবেদিত প্রাণ। সে গেছে বন্ধুর হয়ে ঘটকালি করতে!’
এক মিনিট, আব্দুলটা আবার কে? অহনা কি আব্দুল বলতে আমাকে বোঝাচ্ছে? ফাহাদ দেখি ঘামছে। খাবার আসতে কতক্ষণ লাগে কে জানে আমার পেট এদিকে চোঁ চোঁ করছে।
‘তুমি কী করে ভাবতে পারলে যে একদিন খাইয়েই আমাকে পটিয়ে ফেলতে পারবে? তোমার বড় গাড়ি আর দামী ঘড়ি দেখিয়ে দুনিয়ার সব মেয়েকে বাগে আনতে পারবে এমন ভাবার কোনো কারণ নাই। আমি তোমার কয় নম্বর, হ্যা?’
‘মানে?’ ফাহাদ ঢোক গেলে।
‘তুমি এর আগে আমার বান্ধবী টিনার সাথে ডেট করতা না? ওর কাছে তোমার সব কেচ্ছা শুনেছি। বলব সবার সামনে? বাদ দাও সে কথা। আমার আগে বারো জন গার্লফ্রেন্ড ছিল না তোমার? তাহলে আমি তোমার তের নম্বর হওয়ার কথা। আনলাকি থার্টিন।’
ফাহাদ কটমট করে আমার দিকে তাকাল। আমি ওকে ইশারা করে জানালাম, আমি সত্যিই এসব কিছু জানি না। তবু ফাহাদ চোখ পাকাচ্ছে দেখে বুঝলাম ও চাচ্ছে আমি যেন ওর সমর্থনে কিছু বলি। আমি কেবল মুখ খুলেছি, ‘দেখুন মিস অহনা- '
‘তুমি চুপ থাক!’
অহনা দেখি আমাকেও তুমি করে বলতে আরম্ভ করেছে। এরপর ফাহাদকে লক্ষ্য করে যা-তা বলতে লাগল। ‘মেয়েরা কি সস্তা?’ ‘আমাকে চেন না তোমার এত্ত বড় সাহস!’ ‘তোমার মতো ছেলেদেরকে...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ফাহাদ অনেকক্ষণ ধরে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করে শেষমেশ না পারতে উঠে দাঁড়াল। হায় সর্বনাশ! আমার কপালে আজ বোধহয় আর খাওয়া নাই। বুয়াও নির্ঘাত এতক্ষণে চলে গেছে। এ মাসের শেষ সম্বল আর খরচ না করে বরং দুপুরটা না খেয়ে কাটানই ভালো। তবে এর চেয়েও দুঃখজনক কথা, আমার জীবনের প্রথম ঘটকালিটা এভাবে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হলো! আমাকে দিয়ে সত্যিই কিছু হবে না। শোকে শোকাতুর হয়ে উঠলাম। কী ঘটল কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এটুকু কেবল আন্দাজ করলাম আমার গুণধর বন্ধুর কোনো ভয়াবহ গুণ অহনার সামনে এসেছে। তাতেই সব ভরাডুবি।
অহনা দণ্ডায়মান ফাহাদকে ধমকাল, ‘হা করে দেখছিস কী, ভাগ!’ এক-দুজন লোক এদিকে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ হঠাৎ আমাকে ছাড়াই সবেগে বেরিয়ে গেল রেস্তোরা থেকে। এই সেরেছে, আমাকে যে ওর গাড়ি করে ঝিগাতলা পৌঁছে দেয়ার কথা – ভুলে গেল নাকি? বন্ধুকে রেখে বন্ধু এভাবে পালায় কখনো? আমিও মানে মানে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কী বলে বিদায় সম্ভাষণ জানাব মাথায় আসছে না। এসব কথা মীর জাফরের কানে গেলে চাকরিটা থাকে কিনা সন্দেহ।
‘অ্যাই, তুমি আবার দাঁড়ালে কেন? হ্যা হ্যা, পিছে তাকিয়ে লাভ নাই, তোমাকেই বলছি। আর কাকে বলব? বসো এখানে।’
ঘটনা কী! আমি ভয়ে ভয়ে বসলাম। এক দফা মোকদ্দমা তো হলো, আবার কেন? অহনা বলল, আমি তো ফাহাদের কথায় আসিনি এখানে। আমাকে তো ডেকেছিলে তুমি।’
বাহ, অর্থাৎ এখন সব দোষ আমি নন্দ ঘোষ ওরফে আব্দুলের।
‘ফাহাদের সাথে অতটা বাজে ব্যবহার না করলেও পারতাম। কী করব। ওকে তাড়ানর আর কোনো উপায় ছিল না। সরি।’
‘আ-আমাকে সরি বলছেন কেন?’
‘উফ- অহনা চারদিকে একবার দেখে নিল, ‘তুমি দেখি আসলেই একটা আব্দুল। বুঝতে পার না যে কেন আমি...। আচ্ছা, আরেকজনের হাতেই আমাকে গছিয়ে দিচ্ছ যখন তাহলে লাট্টুর মতো আমার বাসার চারপাশে চক্কর দিতে কেন? আর তুমি যে অন্য জায়গায় চাকরি পেয়েছ তা কি আমি জানি না? আর সেখানে যে বেতন বকেয়া রাখে না এও জানি। শোনো, এই কোচিংয়ের চাকরিটা তোমাকে ছেড়ে দিতে হবে। নইলে খাব কী দু'জন?’
এতক্ষণে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আজকে ডেটিংটা ভণ্ডুল করার পরিকল্পনা নিয়েও অহনা যে এত সময় লাগিয়ে এত সুন্দর করে সেজেছে সে তো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নির্বুদ্ধি হতে পারি। নির্বোধ তো নই। ‘কিন্তু মীর জাফর-' বলেই মুখে হাত চাপা দিলাম।
‘বাবা কার? সুতরাং টেনশনটাও তাকেই করতে দাও। তুমি তোমার কাজ কর। চাকরিটা আসছে মাস থেকেই শুরু করে দাও, বুঝলা? আপাতত খিদে পেয়েছে।’
ফাহাদের অর্ডার বাতিল করা হয় নি। ওয়েটার টেবিলে খাবার লাগাল। আসছে মাস থেকে আর টাকা-পয়সার টানাটানি থাকবে না।
আজ একটু ভালোমন্দ খাওয়া তো চলেই।
মানে বোঝাতে চাইছি গল্পটা যখন লেখা সেই ২০১৬ সালে দেখতেও এমনই স্টুপিড ছিলাম |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন