বইয়ের বাইরেও যে সত্য আছে বিলক্ষণ জানতাম। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বইয়ের ভিতরেই তাকে পাওয়া যায়। আলজেবরা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না এমন কিছুর অস্তিত্ব মানতে পারতাম না। সাহিত্যের দিকে ঝোঁক ছিল। অন্যের সৃষ্টিতে মুগ্ধ হতাম আর নিজেও সাহিত্যসৃজনের অনুরুপ চেষ্টা চালাতাম। এই সাহিত্যচর্চা করতে গিয়েই প্রথম একদিন ধন্ধে পড়েছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে। আচ্ছা মুসিবত, 'কে-কী-কেন' এই প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছিলাম না। তারপর একদিন... বইয়ের ফাঁকে, নিজের লেখার ভিতর মাঝে মধ্যেই যাকে খুঁজেছি বিনা বলে-কয়ে সেই ব্যাখ্যাতীত সত্যটাই এসে হাজির হলো। অনভ্যস্ত হাতে শাড়ি পরে, চুড়ির রিন ঝিন শব্দ তুলে, একেবারে আমার লেখার টেবিলের সামনে।
ভাগ্য বিধাতার অগ্র-পশ্চাৎহীন বিবেচনায় (বরাবরই বিধি আমার সাথে এরকম
আমোদে মাতেন) তার আসাটা আমি সেভাবে টেরই পেয়েছিলাম না অথচ চলে যাওয়াটা খুব বেশি করে
নজরে এল। দেবীকে সাক্ষাৎ পেয়েও আমি উজবুক মঙ্গলকাব্যে মুখ ডুবিয়ে বসেছিলাম। অবহেলায় দেবী যখন ফিরে গেল তখন মুখ তুলে চাইলাম। দূরে যাওয়াতে বাঁধনে টান পড়ল আর সেই প্রথম টের পেলাম যে অজান্তে কবে বাঁধা পড়েছিলাম। জন্ম লাজুক- তাই 'ফিরে এস, আমারই ভুল'
বলে চিৎকার করতে পারলাম না। ভেতরে ভেতরে হাহাকার উঠল 'গেল গেল' বলে। সত্যই
চলে গেল জীবন থেকে! তারাশঙ্কর তাকের ওপর তোলা রইল। অসমাপ্ত গল্পগুলো রোজ
কেয়ামতের নামে অসমাপ্তই রয়ে গেল।
যে গেছে সে আর ফিরল না।
রবি বাবু
impersonal love বলে একটা কথা বলেছিলেন একদা। ওনার চাইতেও ঢের কম বয়সে আমি
টের পেলাম- হ্যা, ওরকম কিছু আছে বটে। দেবী তো অধরা, কে জানে হয়তো ফাঁকি!
আমি মনে মনে যাকে পুজো দিচ্ছি এতকাল, সে তো আমারই গড়া প্রতিমা। এতদিনে
বুঝলাম তার আসাটা যেমন জরুরি ছিল তেমন জরুরি ছিল তার চলে যাওয়াটাও। হৃদয়ের চার প্রকোষ্ঠের ভিতর এত যে মালমশলা ঠাসা ছিল জানতামই তো না। তার সর্বনাশা আঘাতে হৃদয়ের সব ক'টা
দ্বার অবারিত হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে আজতক হৃদয় খনির অফুরান যোগান পাচ্ছি। পেয়েই যাচ্ছি। প্রতিদিন কৃতজ্ঞতা জানাই আর অর্ঘ্য নিবেদন করি - না সেই রক্ত-মাংসের ব্যাক্তিটিকে নয় (সে আজকাল পুরোই বদলে গেছে, পার্লারে গিয়ে রুপচর্চাও করে) - বরং আমার মনের ভেতর গড়া সেই ভাব-প্রতিমাটিকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন