সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মন

 শুক আমাকে হুঁশিয়ার করেই চলেছে সুবিনয়ের ব্যাপারে। আমি ধৈর্য হারিয়ে ওকে বকা দিলাম। কেন রে বাপু, এতবার বলতে হচ্ছে কেন? আমি নিজে তো চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি এই সুবিনয় আমার আরাধ্য নয়। আরাধ্যের ধারেকাছে কেউ নয়, কিছু নয় সে। না আমি মন্দ বলছি না ছেলেটাকে। সবই ঠিক আছে। সব ঠিকই আছে। তবুও ঠিক আমার সাথে যাচ্ছে না। সবকিছুর পরও আমার আরাধ্য তো সে নয়। তাই না? 

এক যুগ হলো আরাধ্যকে দেখি আমি প্রায় রাতে। ঘুমানর আগে আরশি আমায় দেখাত। তারপর এখন ঘুমিয়ে দেখি স্বপ্নে। দু’জনেরই অভ্যাস হয়ে গেছিল এভাবে দেখা করার। অনেকদিন বাদে আরশিকে আবার দেখাতে বলেছি, সুবিনয় আর আরাধ্যকে পাশাপাশি মেলানর জন্য। আরশি আমাকে আরেকবার আশ্বস্ত করেছে, দুইটা মানুষ কোনো দিক থেকেই এক নয়। তার পরপরই স্বপ্নে একবার ডেকেছি সুবিনয়কে। আরাধ্য রাগ করবে না জানতাম। আরাধ্য সেরকম মানুষ নয়। তাছাড়া একটা রাতের জন্যই তো। সুবিনয় অবশ্য ঘাবড়ে গিয়েছিল। স্বপ্নে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা ছিল না বোধ হয়। আমি দু’জনকেই খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। নাহ, আমার আরাধ্য সব দিক থেকেই অন্যরকম। চলন বলন সব আলাদা। 

অন্যান্য দিন আরাধ্য টাংস্টেনের জাদু আলোতে আরামকেদারায় বসে আলোচনা করত, সে কী পড়ল কী লিখল সেসব নিয়ে। মেঝেয় বসে তার কোলে মাথা রেখে সেসব শুনতাম গভীর মনোযোগে। সম্ভবত তার একমাত্র শ্রোতা। সেই রাতে পড়ালেখার আলাপ ছেড়ে, প্রথম সাক্ষাতে সুবিনয়ের আমাকে বলা একটা কথা নিয়ে আরাধ্যের সাথে ওর দ্বন্দ্ব তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। সুবিনয় কথায় পারলই না তার সাথে। যুক্তি-উদাহরণ দিয়ে মিষ্টি ভাষায় তাকে একরকম ভাসিয়ে দিল আমার আরাধ্য। ছেলেটার গোবেচারা অবস্থা দেখে বাধ্য হলাম আরাধ্যকে থামাতে। যদিও ভেতরে ভেতরে খুশিই হয়েছিলাম। কে জানে কিছুটা হয়তো অহংকার হয়েছিল। সুবিনয় ওকে পছন্দ করেনি মনে হলো। তর্কে না পারলে পছন্দ না করাই স্বাভাবিক। এমনকি আমি যখন ছল করে সুবিনয়ের পক্ষ নিলাম তখনো কি আরাধ্যকেই বেশি আপন দেখাল না আমার?

‘অতএব এই ছেলে কোনদিনও আমার নয়।’ চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে শুককে বলি, তাহলে তিন বেলা এক গীত কেন গাইছিস হতভাগা?’

শুকটা খুব তর্ক শিখেছে, ‘তুমি তো গেল দুই বার আমার নিষেধ মানোনি। পইপই করে বলেছিলাম, যেও না, কষ্ট পাবে। শুনেছিলে? একটা টিকল ছয় বছর। পরেরটা ছয় মাসের মাথায় ভেঙে গেল। টানা ছয় সপ্তাহ মেঘ সরল না মহলের ওপর থেকে। আমি তো ভেবেছিলাম এর কোনো থামাথামি নাই।’  

‘থাম তো তুই। তখন ছেলেমানুষ ছিলাম। আর তাছাড়া ওকে দেখতেও আরাধ্যের মতো ছিল। কী আরশি, তুই বল, ছিল না? সুবিনয় তো সেদিক থেকে একেবারেই বিপরীত।’ 

‘প্রথমজনের কথা বলছ নাহয় আরাধ্যের মতো দেখতে। আর পরের জন? তিন বছরের মাথায় যে আরেকজনের হাত ধরলে? তার তো কোনো মিলই ছিল না। তখনো বলেছিলাম, কানে নেওনি। সে নিয়ে তো আরশিকে দোষ দিতে পারবে না। দুই বর্ষা মুখে দানাপানি তোল নি তারপর। আমার কথা শুনতে যদি…’

‘আচ্ছা বাবা ভুল করেছি। ভুল করেছি শিক্ষাও হয়েছে। হয়নি? তোরাই তো খুশি হয়েছিস সবচেয়ে বেশি।’ আমি চিরুনিটা জলের ওপর ছেড়ে দিলাম, ‘ঘ্যান ঘ্যান করিস না আর।’

শুক দুলতে দুলতে বলল, যাক বুঝেছ তাহলে। আজ চন্দন দিও না। কাল দিও। আর শোনো, সে আসবে একটু পর।

‘কী বলিস? সুবিনয়? আজ?’ 

‘হ্যা। দুপুরবেলা। বারান্দার নিচে দাঁড়াবে। হাতে থাকবে দোলনচাঁপা।’

মনটা হঠাৎ দমে গেল সুবিনয়ের জন্য। আহারে বেচারা। ওকে বোধ হয় আমার সবকিছু বুঝিয়ে বলা উচিৎ। এভাবে কতদিন? আজই বলব। আসলে বিষয়টা ভালো লাগছিল না একদমই। কষ্টও পাচ্ছিলাম একটু একটু। আমি যদি সরাসরি নিষেধ না করি তাহলে সে আসতেই থাকবে। সেটা ভালো হবে না। আমাদের কারো জন্যই ভালো হবে না।

‘উঁহু উঁহু। আজ তুমি ওর সামনে যেও না। সমীরণকে দিয়ে চিঠি ধরিয়ে দিও। লিখো যে তুমি ঘরে নাই।’

‘বেশ-’

শুক বলেছিল আজ উত্তর মহলে না যেতে। আমি এদিকটাতেই খাওয়ার আয়োজন সারলাম। পিঁপড়ার সারি ফিরে গেলে সব ধুয়ে মুছে আলসে ভঙ্গিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। রোদটাকে মৃদু করে মনের ভেতর থেকে আমার আঁকা আরাধ্যের ছবিটা বের করে একমনে দেখতে লাগলাম। ধীর আঙুল বোলাতে বোলাতে অভিমান ভরে বললাম, ‘কত জনা এসে বন্ধ দুয়ার পেয়ে ফিরে গেল। তুমি আসবে কবে আরাধ্য?’ এ ঘরে অন্য কেউ থাকলে লজ্জা পেতাম এভাবে কথা বলতে। সমীরণটা সবসময়ই ঝুঁকে থাকে আমার ওপর। কিন্তু ওকে লজ্জা করে না। কথা বলতে পারে না তো, তাই বোধ হয়। সে যে আছে, মনেই থাকে না। ওর সাথেও কথা বলি মাঝে মাঝে। একমনে বলতে পারি কতকিছু উত্তরের আশ ছাড়াই।

‘আমার তোমাকেই চাই। তুমি আসো না। বারো বর্ষা গেল প্রথম তোমাকে দেখার। কত খুঁজলাম তোমাকে। তুমি সামনে এলে না একদিনও। কোথায় খুঁজতে বাকি রেখেছি বলো। শুধু কি স্বপ্নেই আসবে এক-দুই পক্ষ পরপর? আচ্ছা তাও এসো। সামনেও এসো যখন ইচ্ছা হবে। আমি অপেক্ষা করব আরাধ্য। তোমাকে চিনেছি বলে আর সবাইকে আমার অচেনা লাগে এখন।’ 

কথার মধ্যে সমীরণ দোয়াত কলম ঠেলে দিল। ওহ, আমি ভুলে গেছিলাম চিঠির কথা। লিখলাম, 'বাড়ি নাই। কবে আসব জানি না। ইতি আমি।'

বলে দিলাম নিচ থেকে দোরঘণ্টি বাজালেই যেন এটা দিয়ে আসা হয়। আরাধ্যকে ঢুকিয়ে রাখলাম। দুপুর গড়াতে চলল। ছাদে যাব ঝাড়গুলো দেখতে। সুবিনয় ছেলেটা এখনো এল না তো। তবে আসবে নির্ঘাত। আমার শুক ভুল বলে না কখনো। মিথ্যা চিঠিটা কি দিব সুবিনয়কে? বোধ হয় আরেকটু খোলাসা করেই বলা উচিৎ ছিল যে, সে আমার জন্য নয়। সে নিজেও সুখী হবে না কখনো। আমার সাথে আর কেউ সুখী হবে না কখনো। কিন্তু শুক এসব কথা পরে বলতে বলেছে। তাছাড়া আমারও সমস্ত ইন্দ্রিয় নিষেধ করছিল ওর সাথে আজ দেখা করতে।  

সর্বনাশের দোরঘণ্টি বাজল তখনি। সমীরণ টের পেল কিনা কে জানে। আমি কী ভেবে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝালরের আড়াল থেকে চাইলাম। রোদ পড়ে গেছে আজ তাড়াতাড়ি। সবুজ পাঞ্জাবি গায়ে চোখ মুখ কুঁচকে সুবিনয় ওপর দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে ধরা দোলনচাঁপা। আমার আরাধ্য সে না। আমি বুঝতে পারছি আমার আরাধ্য সে নয়। নাহ আজ তাকে কিছু বলব না। মন জানে আজ আমাদের কথা হওয়াটা বিশাল ভুল হবে। সমীরণ চিঠিটা দিল ওর হাতে। সুবিনয় পড়ল। আরেকটাবার ওপর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নামিয়ে উল্টো পথে পা বাড়াল। চলে যাক। এই মঙ্গল। আমার বুকের ভেতর কোনো এক অজানা কারণে হু হু করছিল। কিন্তু আমি জানি এটা সাময়িক। আজ দুপুরে এই মুহূর্তের কষ্টকে প্রশ্রয় দিলে এরকম আরো সহস্রদিনের কষ্ট সহস্র রাতের কান্নাকে বরণ করতে হবে। না আমি যাব না।

আরশি খসে পড়েছিল সিঁড়ির ওপর। মন বারণ করছিল। শুক ডানা ঝটপটিয়ে চিৎকার করছিল। বোবা সমীরণ জোরাল অশনি সংকেত জানানর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। 

আমি শত প্রহরী ঠেলে সরিয়ে পথে নামলাম, ‘দাঁড়াও সুবিনয়!’



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

48 LAWS OF POWER by Robert Greene and Joost Elffers

Vladimir Putin The definition of power in 21st century

হারবার্ট স্পেনসারের 'জৈবিক সাদৃশ্যবাদ'

ইংরেজ সমাজতত্ত্ববিদ ও জীববিজ্ঞানী হারবার্ট স্পেনসারকে বলা হয় সমাজবিজ্ঞানের দ্বিতীয় জনক। তিনি 'সামাজিক ডারউইনবাদ'-এর একজন প্রচারক। স্পেনসারের বিখ্যাত 'জৈবিক সাদৃশ্যবাদ' সমাজ ও জীবকে বিশেষ সাদৃশ্যপূর্ণ বলে দাবি করে। হারবার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) ১। সমাজ ও জীব উভয়েই আকারে বৃদ্ধি পায়। মানবশিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়। মহল্লা থেকে মেট্রোপলিটন হয়, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্য তৈরি হয়।   ২। প্রত্যেকে আকারে যত বড় হয় উভয়ের কাঠামো জটিলতর হতে থাকে। ৩। দুই ক্ষেত্রেই, কাঠামোগত পার্থক্যের কারণে কার্যকারিতায় অনুরূপ পার্থক্য দেখা দেয়। ৪। জীবদেহ ও সমাজ উভয়েই ক্ষুদ্রতর একক দ্বারা গঠিত। জীবের যেমন কোষ রয়েছে তেমন সমাজের রয়েছে ব্যক্তি। একাধিক কোষ মিলে যেভাবে বৃহত্তর অঙ্গ গঠন করে, একইভাবে একাধিক ব্যক্তি মিলে সমাজের বিভিন্ন অংশ গঠন করে। ৫। সমাজ ও জীব উভয়ই মূলত তিন ধরনের তন্ত্র বা ব্যবস্থার ওপর টিকে থাকে। এরা হলো - বিপাক তন্ত্র (sustaining system), সংবহন তন্ত্র (distributor or circulatory system), স্নায়ু তন্ত্র (regulatory system). জীবের জন্য খাদ্য হলো এর চালিকা শক্তি, সমাজের ক্ষেত্রে যা হলো কৃ...

আমার লেখা বই

আমার সর্বশেষ বই বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা শাখা: ভাষাশিক্ষা প্রকাশকাল: ২০২৪ প্রচ্ছদ:  বইটি পড়ুন আমার পঞ্চম বই চিত্রনাট্যচিত্রণ: কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখার কলাকৌশল শাখা: চিত্রনাট্য প্রকাশকাল: ২০২৪ প্রচ্ছদ: পার্থপ্রতিম দাস বইটি পড়ুন আমার সর্বশেষ উপন্যাস অধিনায়ক শাখা: উপন্যাস প্রকাশকাল: ২০২০ প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত বইটি পড়ুন আমার প্রথম উপন্যাস রঙবাহার শাখা: উপন্যাস প্রকাশকাল: ২০১৫ প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান বইটি পড়ুন আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ অপরূপকথা শাখা: গল্প সঙ্কলন প্রকাশকাল: ২০১৩ প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান বইটি পড়ুন আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি শাখা: গল্প সঙ্কলন প্রকাশকাল: ২০১২ প্রচ্ছদ: বিক্রমাদিত্য বইটি সম্পর্কে জানুন My books on Goodreads রঙবাহার (avg rating 5.00) অপরূপকথা (avg rating 5.00) অধিনায়ক ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা

48 Laws of Power in Bangla Free PDF Download

বিনামূল্যে ই-বুক পিডিএফ ডাউনলোড করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন সরাসরি পড়তে এখানে ক্লিক করুন বিক্রমাদিত্য's books on Goodreads রঙবাহার reviews: 1 ratings: 2 (avg rating 5.00) অপরূপকথা ratings: 1 (avg rating 5.00) অধিনায়ক ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা Goodreads reviews for রঙবাহার Reviews from Goodreads.com রাজাদের রাজ্যে রাষ্ট্ররা by রিফু My rating: 5 of 5 stars ডেস্কে বই জমছেই, ছোটগল্পের বই বাদে, পাই না, লেখে না কেউ—জানি কী লেখে—গাছ মারে শুধু শুধু। রিফুর বই আব্বা অল স্টার রেকমেন্ডেশনসহ দিয়ে গেল। গল্প-কবিতা-ক্যাপশনে ‘রাষ্ট্র’ ‘রাষ্ট্র’ ‘রাষ্ট্র’ লিখতে লিখতে ছাবাছাবা করে ফেলেছে সবাই, তারপরও, এই নামকরণটায় বাড়তি মাথা খাটানোর ইঙ্গিত আছে। এক ঘণ্টায় বইয়ের অর্ধেক পড়েছি, চোখের আন...

TFP 415 WORLD CINEMA : Class Notes

Aug 14, 2023 LECTURE 2 Expressionism Reality is distorted Artist’s personal feeling From Northern Europe How did it begin? Effects of WWI  Foreign film banned Horror, insecurity, and paranoia From German romanticism  ENLIGHTENMENT ROMANTICISM Reason Emotion Progress Common good Individuality Unique potential Science and technology Rational, ordered society Nature and imagination Spontaneous, passionate life Social conventions and institutions  Resistance to social conventions and institutions First appeared in poetry and theater “The world is a laboratory” by Gottfried Benn Characteristics of german expressionist theater Distorted and exaggerated sets, props, and costumes Unease and anxiety Symbolism- character might be represented by an animal or object or a particular color Non-linear plot Confusion and disorientation Fragmented nature of the human experience The threepenny opera (1928) by bertolt brecht Characteristics of german expressionism The subjective view of the...

THE ART OF SEDUCTION by Robert Greene

রবার্ট গ্রিন এখানে ‘সিডাকশন’ কথাটাকে ব্যবহার করেছেন শুধুমাত্র যৌন প্রলোভন হিসেবে নয়, বরং আরো ব্যাপক অর্থে—রাজনৈতিক, সামাজিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে যেই প্রলোভন প্রযোজ্য। এই প্রলোভনের নীতিগুলো জানলে নিজেকে ও নিজের সম্পর্কগুলোকে আরেকটু ভালোভাবে ঝালাই করা যাবে। সেইসাথে তাদের প্রয়োগ করা যাবে ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনে।    সারকথা প্রলোভন ব্যাপারটাই মনস্তত্ত্বের খেলা, সৌন্দর্যের না। ফলে এই খেলার একজন ওস্তাদ হয়ে ওঠা যেকোন মানুষেরই আয়ত্ত্বে আছে। এমন নয় যে, একজন প্রলোভনকারী তার ক্ষমতাটাকে একবার চালু আর একবার বন্ধ করেন—প্রতিটা সামাজিক ও ব্যক্তিগত লেনদেনই তার কাছে প্রলোভনের একেকটা সুযোগ। সুযোগের একটা মুহূর্তও নষ্ট করার নাই। প্রলোভনকারীরা কখনো আত্মনিমগ্ন থাকে না। তাদের দৃষ্টি থাকে বাইরের দিকে, ভিতরের দিকে নয়।  প্লেজার বা পুলক হলো আমাদেরকে আমাদের সীমার বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি, উদ্বেলিত করে দেওয়ার অনুভূতি—তা হতে পারে মানুষের দ্বারা, বা কোনো ঘটনার দ্বারা।  শেষত, যারা কিনা প্রলোভনকারী, তাদের দুনিয়াদারির সাথে নৈতিকতা ব্যাপারটার সম্পর্ক একদম নাই। প্রতিটা প্রলোভনের দুইটা উপাদান থাকে...

স্বর্গচূড়া

অবশেষে, একদিন, এতবছরের অপেক্ষার পর ট্রেনটা পেলাম আমি। সঙ্গের পোটলা-পুটলিগুলো প্রথমে কামরার ভেতর ছুঁড়ে দিলাম। তারপর নিজের নাম মুখে নিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠলাম ট্রেনে। গাড়িটা এক মুহূর্ত থামে না প্লাটফর্মে। জোর গতিতে ছুটে চলে। কারো জন্য অপেক্ষা করতে নারাজ। একজনের জীবনে একবার বই দু’বার কখনো আসে না। পাল্লা দিয়ে ছুটে তাকে ধরতে হয়। নইলে নাই। অন্য গাড়ি ধরতে হবে। কিন্তু সে গাড়ি যাবে আরেক গন্তব্যে। ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। প্লাটফর্মে সাথীকে দেখতে পাই। হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে অথচ ঠোঁটে হাসি নাই। শুনতে পেলাম মনে মনে কেবল বলছে, তোমার যাত্রা শুভ হোক। (২) প্রথম কবে সাথীর দেখা পেয়েছিলাম ভালো মনে পড়ে না। মনে পড়ে, মন খারাপ করে প্লাটফর্মে বসে ছিলাম। সাথীকে পেয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। কেন, তা মনে নাই। এরপর কত দিন, কত রাত পাশাপাশি বসে কেটে গেল। আমি আর সাথী। স্টেশন জুড়ে এত এত মুখ। কাউকে মনে ধরে নি। সাথী বাদে। সাথীর স্বজনরা একই স্টেশনে ছিল। তবু ও ছিল একা। কী জানি কেন, কখনো জিগ্যেস করা হয় নি। কিন্তু সাথী অনেক প্রশ্ন করত আমাকে। খুব অবাক হতো যে অন্যদের মতো আমার শরীরে কেন বাঁধন নাই। আমার মা-বাবার কথা জিগ...

মিডিয়া সাক্ষরতা : আদিপর্ব

মিডিয়া সাক্ষরতা ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় জিজ্ঞাসা - মিডিয়া নিজে যতটা প্রাচীন তার চেয়ে কম পুরনো নয়। বর্তমানে তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা মিডিয়া সাক্ষরতাকে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে সত্য। কিন্তু মিডিয়ার প্রভাব ও মিডিয়া সাক্ষরতার গুরুত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন অনেক অনেক আগে থেকেই আলোচিত হয়ে এসেছে। এটাও লক্ষণীয় যে মিডিয়ার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন বিতর্ক একইসাথে নবাগত প্রযুক্তি, শিল্প (আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয় অর্থে), এমনকি সংস্কৃতির গতিপথকে সময় সময় প্রভাবিত করে এসেছে। তবে ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত পরিভাষা বা গবেষণাক্ষেত্র হিসাবে এর অস্তিত্ব ছিল না। যতদিন না বিষয়টি যোগাযোগ স্কলার ও মিডিয়া প্রফেশনালদের কাজের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তার আগ পর্যন্ত (কিংবা এখনো কিছুসময়) যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট ভাবনাসমূহ পরিচালিত হয়/হয়েছে তাত্ত্বিক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও ভাষাতত্ত্ববিদদের দ্বারা। এ যাবৎ মিডিয়া সাক্ষরতা নিয়ে যত তত্ত্বীয় চিন্তা হয়েছে তাতে --- প্লেটো থেকে ফ্রয়েড, সসার (১) থেকে সিক্সাস (২) --- প্রত্যেকেরই রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। উৎপত্তি ও সংজ্ঞা এই তথ্য মোটেও অভিন...

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি : প্রাচীন অর্বাচীন তর্ক

এই লেখাটা ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় যোসেফাইট কালচারাল ফোরামের বার্ষিক ক্রোড়পত্র ত্রিলয়-এ। আমি তখন সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র প্রাচীন -  ওই অর্বাচীনদের আমি শতবার সতর্ক করেছি, আর যা-ই করো, আত্মপরিচয় কখনো হারাবে না। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি এদের সামনে যেন ঘোর অন্ধকার। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছু ভুলে গিয়ে এরা আজ পাশ্চাত্যের অনুকরণে ব্যস্ত। নিজের চশমার 'স্টাইল'টা যতই বাজে হোক না কেন ওটা পরেই তুমি স্বচ্ছ দেখবে। তা না করে যদি অন্যের চশমা চোখে দাও, তোমাকে মানাবে হয়তো ভালো কিন্তু হোঁচট খেতে হবে পদে পদে। অর্বাচীন - তোমার কথায় কেমন যেন ছাপাখানার গন্ধ। তোমার বয়স হয়েছে। তাই চোখে সমস্যা। চোখের পাতা বন্ধ করে তুমি অতীতটাকে সোনালি রঙের মনে করো। আর চোখ মেলে ভবিষ্যৎ দেখতে গেলেই তোমার মনে হয় সেটা বুঝি অন্ধকার। অর্বাচীনদের যতই গালি দাও।পশ্চিমা চিকিৎসার সাহায্য নিয়েই দেখো না চোখটা ভালো হয় কি না। প্রাচীন - বাবা! আজকালকার ছেলেমেয়েরা এক কথার পিঠে একশ কথাকে চাপায়। আমাদের যুগে বড়রা বলত। ছোটরা শুনত। তার থেকেই শিক্ষা নিত। এখনকার ছেলেমেয়দের কথা ...

ইফরিত

মোহাম্মদপুরের এক ভীষণ ব্যস্ত সড়কের পাশে আমাদের দুই বেড-ড্রয়িং-ডাইনিং এর ভাড়া বাসা। বাসাটা যখন নেয়া হয় তখন আমি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। এই এলাকায় ভাড়া তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সদ্য তোলা বাড়ি আর তমালের অফিসও কাছেই হয় তাই ভাবলাম - এই ভালো। বাসায় উঠে গোছগাছ তখনো সারিনি। এক মাস গেছে কি যায়নি তখন থেকে সমস্যাটার শুরু। তমাল অফিস করে ফিরতে রাত নয়টা দশটা বাজত। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও সময় নিত না। আমি কোনদিন ওর সাথে শুয়ে পড়তাম, কোনদিন গল্পের বই পড়তাম অথবা ডায়েরি লিখতাম। এক রাতে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে কিছু একটা পড়ছি হঠাৎ দরজায় টোকা দেয়ার মতো আওয়াজ পেলাম। আমার কান খুব খাড়া। আওয়াজটা বাইরের ঘর থেকে এসেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাত্রি একটার সময় কে বড় দরজায় টোকা দিবে? পড়ায় মন ফিরিয়েছি মিনিটও হয়নি আবার... নক নক। খুব স্পষ্ট আওয়াজ। ভাবলাম সত্যিই বুঝি কেউ এসেছে। রাত হয়েছে বলে কলিং বেল টিপছে না। উঠে গিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রাখলাম। সারারাত বাহিরের আলো জ্বলত। কাউকে দেখলাম না। ঘরে ফিরে আসার কিছক্ষণের মধ্যেই আবার... নক নক। এবার আর দেখতে গেলাম না। দরকার হয় বেল বাজাবে। শীত করছিল। আলো নিভিয়ে তমালকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল...