কোনো চলচ্চিত্রের গল্প বলার জন্য মূলগতভাবে যে দুই ধরনের কাঠামো বা বিন্যাস অনুসরণ করা হয়, তার একটি হলো ওপেন ফর্ম, যার সাথে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়ার নাম সংশ্লিষ্ট রাখা হয়। দ্বিতীয়টি হলো ক্লোজড ফর্ম, যার সাথে যুক্ত আছে জার্মান নির্মাতা ফ্রিৎজ লাং এর নাম। এই দুই কাঠামো থেকেই ওপেন ফ্রেমিং আর ক্লোজড ফ্রেমিং-এর উৎপত্তি। আমরা নিম্নোক্ত আলোচনায় এই দুইয়ের জন্য চলনসই পরিভাষা গ্রহণ করব - মুক্ত ফ্রেমিং আর আবদ্ধ ফ্রেমিং।
মুক্ত ফ্রেমিং
চিলড্রেন অব মেন (২০০৬) |
যে ফ্রেমিং পদ্ধতি দর্শককে ছবির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা সম্বন্ধে পূর্ণ ধারণা দেয় না তাকে বলে মুক্ত বা বিস্তীর্ণ ফ্রেমিং।
মুক্ত ফ্রেমিং-এ ছবিতে যা কিছু ঘটছে অথবা ছবিতে যা কিছু অবস্থান করছে তার ব্যাপারে দর্শক পুরোপুরি অবগত থাকে না। কেউ কেউ সহজেই বলে ফেলে যে, ক্লোজআপ হলো মুক্ত ফ্রেমিং এর যোগ্যতম উদাহরণ। আবার কেউ কেউ উল্টোটা বলে যে, আবদ্ধ ফ্রেমিং-এর আদর্শ উদাহরণ হলো ক্লোজ-আপ। আদতে এটি অতিসরলীকরণ। একটি ফ্রেম মুক্ত না আবদ্ধ তা নির্ভর করছে কতটুকু তথ্য সে দর্শককে সরবরাহ করছে তার ওপর। মুক্ত ফ্রেম সবসময় কিছু তথ্য (বলা যায়, বেশিরভাগ তথ্য) দর্শকের কাছ থেকে আড়ালে রাখে। যদি একটি ক্লোজ আপ দেখানোর সময় সমান্তরালভাবে ফ্রেমের বাইরে অন্য কোনো ঘটনা/চরিত্র/বস্তু থাকে যা আমাদের অজানা, তাহলে এটি একটি মুক্ত ফ্রেম। তবে, যদি পূর্ববর্তী শটে পুরো রহস্য দর্শকের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেই ক্লোজআপটিকে আর মুক্ত ফ্রেম বলা যাবে না।
এ ধরনের ফ্রেমিং আমাদের চেনা বাস্তবতার অনুভূতি দেয়। কেননা বাস্তবে আমাদের চোখ যা দেখে তার বাইরেও আমাদের চতুর্দিকে একইসাথে অনেককিছু ঘটে চলে। এই বাস্তবমুখিতার জন্য মুক্ত ফ্রেম দেখার সময় দর্শক নিজেকে ছবির অংশ ভাবতে পারে। ছবির গল্প দর্শকের সঙ্গে একই সাথে পরিচালকের সামনেও উন্মোচিত হয়। সাধারণত পার্টি দৃশ্যে মুক্ত ফ্রেমিং দেখা যায়। এই ধরনের ফ্রেমিং-এ ফোকাস বারবার বদলাতে পারে। শট সাধারণত স্থির থাকে না। ফ্রেমে দেখানো চরিত্র বা অ্যাকশন ফ্রেমের ধার ঘেঁষে কাটাও পড়তে পারে। এক টেকে ধারণ করা তথ্যচিত্রের দৃশ্যগুলিতে মুক্ত ফ্রেমিং-এর ভালো উদাহরণ পাওয়া যায়। এরকম ক্ষেত্রে ফ্রেমে যা দেখা যায় তার প্রায় পুরোটাই অপরিকল্পিত থাকে। আবার, ‘প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটি’ ফ্র্যাঞ্চাইজির মতো চলচ্চিত্রগুলিতে সচেতনভাবে মুক্ত ফ্রেমিং ব্যবহার করা হয়।
পরিশেষে, আমরা এভাবে ভাবতে পারি, যখন ছবির দৃশ্য সম্বন্ধে দর্শকের নিজস্ব অনুমান, ভাবনা, বিবেচনার জায়গা উন্মুক্ত থাকে তাকে মুক্ত ফ্রেমিং বলে।
আবদ্ধ ফ্রেমিং
আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস (১৯৩২) |
যখন ছবির ফ্রেমিং চলচ্চিত্রের জগৎ সম্বন্ধে দর্শককে একটি আপাত পরিপূর্ণ ধারণা দেয় তাকে আবদ্ধ ফ্রেমিং বলে।
আবদ্ধ ফ্রেমিং-এর ক্ষেত্রে, ছবিতে যা ঘটছে বা যা কিছু অবস্থান করছে তার সম্বন্ধে দর্শককে একটা সামগ্রিক ধারণা দেয়া হয়। সাধারণত এস্টাবলিশমেন্ট শটগুলি আবদ্ধ ফ্রেমে ধারণ করা হয়ে থাকে। এস্টাবলিশমেন্ট শটে সবকিছু দেখানোর পর যদি নির্দিষ্ট একটি চরিত্র বা বস্তুকে ক্লোজ শটে দেখানো হয়, তাহলে সেটাও আবদ্ধ ফ্রেম। আবদ্ধ ফ্রেমে সচরাচর ফোকাস নির্দিষ্ট থাকে।
এক্ষেত্রে, দর্শককে ফ্রেমের বাইরের জগৎ সম্বন্ধে অন্ধকারে রাখা হয় না। দর্শক এখানে নিজেকে সর্বদ্রষ্টার ভূমিকায় ভাবতে পারে। কারণ ফ্রেমে যা দেখানো হচ্ছে তার বাইরে বিক্ষিপ্তভাবে আর কোনো কিছুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই। থাকলেও তা পূর্ববর্তী কোনো শটে বিবৃত হয়ে গেছে। এই কৃত্রিম উপস্থাপন আমাদের সচেতন করে যে, আমরা একটি সুপরিকল্পিত ও সুসজ্জিত চলচ্চিত্র দেখছি। আমরা একটি বিস্তৃত বাস্তবতার অংশবিশেষ ফ্রেমে দেখছি না, বরং ফ্রেমে যা দেখছি সেটিই আমাদের একমাত্র বাস্তবতা। সবকিছুই ফ্রেমের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। ফোকাস করা কোনো চরিত্র হঠাৎ ফ্রেমের বাইরে চলে যাবার কোনো সম্ভাবনা নাই। চরিত্রটি যদি গতিশীল হয় তাহলে শটটি এমনভাবে গতিশীল হবে যাতে আমাদের চোখ সবসময়ই তাকে অনুসরণ করতে পারে।
মুক্ত ফ্রেমিং-এর ধারণার বিপরীতে বলা যায়, যখন চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্য সম্বন্ধে আমাদের নিজস্ব অনুমান, ভাবনা বা বিবেচনার জায়গা বন্ধ থাকে তাকে আবদ্ধ ফ্রেমিং বলে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন