সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলায় ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বিবর্তনের সংক্ষিপ্তসার

হিমালয় পর্বত উঠে এসেছে টেথিস সাগরের বুক থেকে। হিমালয় ও বিন্ধ্যের গঠনের সময় ওরোজেনিক/টেকটনিক আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন প্লেট উৎপন্ন হয়। তার একটি সাবপ্লেট হলো বঙ্গ। এরপর বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বঙ্গভূমি গিয়েছে।

            বঙ্গের ভূমি প্রাকৃতিকভাবে ভিন্ন। এর তিনদিকে পাহাড় ও নিম্নে জল। বঙ্গভূমির সাথে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিল নাই। এর রয়েছে প্রাকৃতিক বেষ্টনী। তাই বলা যায়, বাংলার সীমানা দুইটি - একটি রাজনৈতিক বাংলা এবং একটি ভৌগোলিক বাংলা। আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গের পুরোটা, মেঘালয় প্রায় পুরোটা, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, বিহারের অর্ধেকটা নিয়ে প্রকৃতি প্রদত্ত প্রাচীর ঘেরা বাংলার ভৌগোলিক সীমা। এই ভূমির পশ্চিমে গৌড়ীয় সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্যের প্রাধান্য ছিল। পূর্বে প্রাধান্য ছিল বঙ্গের। বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক এলাকা। আর সাংস্কৃতিক এলাকা বলতে বোঝায় যত জায়গায় বাংলা সংস্কৃতির চর্চা রয়েছে।

এ অঞ্চলে ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত সক্রিয় ও সদা পরিবর্তনশীল। একইভাবে এর সমাজও পরিবর্তনশীল ও সক্রিয়। কারণ, প্রাকৃতিক পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়া হলো মানব চরিত্র। এরূপ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার স্থানীয়রা অস্থির প্রকৃতির।

মহাভারতে বঙ্গ ও পুণ্ড্রের নাম আছে। এই দুই রাজ্যের রাজা যথাক্রমে চন্দ্রসেন ও বাসুদেব। সেখানে গৌড়ের নাম নাই। ৭ম শতকে শশাঙ্কের গৌড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৪ শতকে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের নথিতে ‘বাঙালি’ নামের ব্যবহার প্রথমবারের মতো পাওয়া যায়। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, এ অঞ্চলের নামকরণে ‘বাঙ্গালাহ’ নামটি ইলিয়াস শাহ কেন নিলেন? এর পেছনে দুই ধরনের কারণ থাকতে পারে। 

এক, বঙ্গ শব্দটি প্রচলিত ছিল। ‘অং’ হলো চীনা ভাষায় পানি। যেমন, তাদের নদী হোয়াংহো, ইয়াংসিকিয়াং প্রভৃতি। সেই অনুসারে বঙ্গ অর্থ জলাভূমি। আবার বঙ্গ হলো বস্ত্র।

দুই, ভাষা হিসাবে বাংলা উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ করেছিল। 

মধ্যযুগে প্রশাসনিকভাবে গৌড় নামটি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ভাষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল। গঙ্গার মূল স্রোত ভাগীরথী ও পদ্মা নামে বিভক্ত হয়ে পদ্মা চলে এসেছে বাংলাদেশে। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী, পদ্মাই গঙ্গা নদীর আসল অংশ এবং ভাগীরথী তার একটি শাখা। ব্রহ্মপুত্র চীন হয়ে ঘুরে বাংলাদেশে এসেছে। 

বেঙ্গল হলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূমি সেতু।

(১) মৃতপ্রায় বদ্বীপ, (২) পরিপক্ব বদ্বীপ, (৩) সক্রিয় বদ্বীপ, (৪) স্রোত সক্রিয় বদ্বীপ

পুরাতন পাললিক ভূমি উঁচু, নতুন পাললিক ভূমি হাওড়-বাওড় সমৃদ্ধ। 

প্রোটো অস্ট্রালয়েড, নিগ্রোয়েড, মঙ্গলয়েড, আলপাইন, অস্ট্রালয়েড। প্রোটো অস্ট্রালয়েড ৫ ক্যাটাগরির।

গর্ডন চাইল্ডের মতে, ইতিহাসে দুইটি বৃহৎ বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে নাগরিক বিপ্লব ও নব্য প্রস্তর বিপ্লব। বাংলায় নগর সভ্যতার নিদর্শন অজয় নদীর তীরে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে।

ধর্মীয় চারটি বড় স্রোত এসেছে। 

ব্রাহ্মণ্যবাদ/ব্রাহ্মণ্যকরণ 

আর্যভাষীরা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষকে অধিগ্রহণ করে। এই উপমহাদেশে লম্বা সময় থাকার কারণে বহিরাগতরাও এক সময় স্থানীয় হয়ে যায়। সংস্কৃতির দুইটি রীতি: অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত। দু’টো বিপরীত সংস্কৃতির মধ্যে প্রথমে সংঘাত ও তারপর সমন্বয় হয়। মার্ক্সের ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ দিয়ে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায়। যেখানে রয়েছে থিসিস (thesis; অভ্যন্তরীণ চলক/ ছোট ঐতিহ্য/ স্থানীয় সংস্কৃতি) ও অ্যান্টিথিসিস (antithesis; বহির্চলক/ বড় ঐতিহ্য/ বহিরাগত সংস্কৃতি)। থিসিস ও অ্যান্টিথিসিসের দ্বন্দ্ব থেকে জন্ম নেয় সিনথেসিস (synthesis; সংশ্লেষ)। সিনথেসিসও এক পর্যায়ে প্রথমে থিসিস হয়, তারপর অ্যান্টিথিসিসে পরিণত হয়।

ভূমধ্যসাগর পার করে পশ্চিম থেকে আর্যভাষীরা হরিয়ানা, জম্মু, কাশ্মীর অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের সীমান্তে আগমন করে। তারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, বই (চতুর্বেদ)-এর মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রচার করে। ব্রাহ্মণ্যবাদ স্থানীয় ধর্ম সংস্কৃতির সাথে সংঘাতের পর আপোষ করে ও তার থেকে কিছু গ্রহণ করে। ইংরেজিতে একে বলে confrontation and accomodation. 

আর্যকরণ > স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে আপোষ > অগ্রগমন

বিন্ধ্য পর্বতের কারণে পাঞ্জাব পর্যন্তই তাদের অগ্রযাত্রা সীমিত থাকে। এজন্য কাশ্মীরসহ উত্তর ভারতে আলপাইন ফিগার দেখা গেলেও তা দক্ষিণে নাই। আর্যভাষীদের এই বিস্তারকে বলে পূর্বাভিমুখী সম্প্রসারণ। এর উদ্দেশ্য: (১) সভ্যতার বিস্তার/ প্রতিষ্ঠা (২) বৈদিক ধর্মে দীক্ষাদান।

দ্বিতীয় পূর্বাভিমুখী সম্প্রসারণ হয় বিহার পর্যন্ত। যেহেতু ল্যান্ডস্কেপে মিল রয়েছে। এখানে এসে মগধ, পাটালিপুত্র ও নালন্দা স্থাপন করে। আরেকটু পূর্বে অস্পৃশ্য, অসভ্য, বর্বর, কাদামাটি, মশার উল্লেখ রয়েছে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও ঐতরেয় আরণ্যকে। প্রাক-বৈদিক, অনার্য, অব্রাহ্মণদের প্রথম স্থাপত্য অজয় নদের তীরে অবস্থিত পাণ্ডু রাজার ঢিবি। বেঙ্গল পর্যন্ত আসতে ব্রাহ্মণ্যবাদের এক হাজার বছর লাগে। এরকম সময়ে বেঙ্গলের নিজস্ব প্রচেষ্টা, সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

বেঙ্গলে আসতে আসতে বহুবার আপোষ করে আর্যভাষীদের নিজস্বতা দুর্বল হয়ে যায়। এইজন্য বেঙ্গলের ব্রাহ্মণ্যবাদকে বলা যায় আপোষকৃত ব্রাহ্মণ্যবাদ। এটি মৌলিক নয় এবং বেঙ্গলে বড় আকারের প্রভাব ফেলেনি। প্রথমে বৈদিকরা বেঙ্গলে প্রবেশ করতে চায়নি মশা ও সাপের কারণে। পরবর্তীতে তারা আবিষ্কার করে যে এখানে খাদ্যের প্রাচুর্য রয়েছে। চ্যালেঞ্জ ও প্রাচুর্য উভয়ই। 

বেঙ্গলের মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো তারা সব ধরনের নতুনত্ব গ্রহণ করে কিন্ত নিজের স্বাতন্ত্র্য ত্যাগ করে না। ব্রাহ্মণ্যকরণ হয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির, আর্যকরণ হয়েছে ভাষা সংস্কৃতির। 

বৈষ্ণবকরণ

মথুরা ও আগ্রায় উৎপত্তি হয়। নিচু স্তরের শুদ্ররা বিষ্ণুর উপাসনা করে। বৃন্দাবনের অবস্থান  মথুরায় হলেও সেখানে বিষ্ণুবাদ জনপ্রিয়তা পেতে ব্যর্থ হয়। এই ধর্ম জনপ্রিয়তা পায় বেঙ্গলে। এ অঞ্চলের প্রশাসকরা নিজেরা বৌদ্ধ হলেও বেঙ্গলের মুদ্রা ও দলিলে বিষ্ণুর উপস্থিতি পাওয়া যায়। বেঙ্গলের বেশিরভাগ ভাস্কর্যেও বিষ্ণুই উপজীব্য। সম্ভবত, ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠোরতা বেঙ্গল নেয়নি। তার তুলনায় বিষ্ণুবাদ অনেক সহনশীল। 

বৌদ্ধকরণ

বুদ্ধবাদও বেঙ্গলে পরিবর্তিত হয়ে প্রবেশ করেছে। বস্তুত, এটিই সবচেয়ে বেশি পরিবর্তিত ধর্ম বা মতবাদ। বৈষ্ণব ধর্মের মতোই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করে এটি বেঙ্গলে জনপ্রিয়তা পায়। এর উৎপত্তি বিহারে। বুদ্ধ স্বয়ং মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন অথচ বেঙ্গলে বুদ্ধেরই মূর্তিপূজা শুরু হয়। কারণ এখানকার লোকধর্মে বিভিন্ন ধরনের মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল। বুদ্ধবাদের একটি শাখা মহাজান বুদ্ধবাদের উৎপত্তি বেঙ্গলে। এটি বুদ্ধবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের সংমিশ্রণ। আরেক শাখা তন্ত্রজান বুদ্ধবাদের উৎপত্তি বেঙ্গল ও কামরূপে। বাংলায় মহাজান বুদ্ধবাদের প্রচারক অতীশ দীপঙ্কর। বেঙ্গল থেকে বৌদ্ধ ধর্ম (তন্ত্রজান, মহাজান, বজ্রজান) রূপান্তরিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্বে থাইল্যান্ড, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে গমন করে। বৈষ্ণব ও বৌদ্ধ উদার থাকায় উভয়ই বেঙ্গলে সহাবস্থান করে। 

ইসলামিকরণ

পূর্ববর্তী ধর্ম ও মতবাদের ন্যায় ইসলামও একইভাবে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আসে। শাসকগণ মুসলিম হয়েও উত্তরে মুসলিমের আধিক্য নাই যতটা আধিক্য রয়েছে বেঙ্গলে। ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে ধরা পড়ে বেঙ্গলে মুসলিম সবচেয়ে বেশি। এর ব্যাখ্যা হিসেবে অনেকগুলো অনুমান রয়েছে। তার মধ্যে চারটি তত্ত্ব আলোচনা করা হলো:

(১) তরবারি তত্ত্ব: অর্থাৎ, শক্তি প্রয়োগ করে ধর্ম প্রচার। এটি বিশেষ করে বেঙ্গলের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার কোনো কারণ নাই। এটি যদি কারণ হতো তাহলে সারা ভারতেই মুসলিমের সংখ্যা বেশি হতো। কারণ সমগ্র ভারতেই মুসলিম সেনানায়কদের আধিপত্য ছিল।

(২) রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা তত্ত্ব: এই তত্ত্বমতে, বেঙ্গলে ইসলাম ধর্মের প্রসারে রাজনৈতিকভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু বিশেষ করে ইসলামের প্রতি রাষ্ট্রের আনুকূল্যের কোনো প্রমাণ বেঙ্গলে পাওয়া যায়নি।

(৩) সামাজিক মুক্তি তত্ত্ব: বলা হয়, ব্রাহ্মণ্যবাদের কাঠিন্য, বর্ণবৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে বেঙ্গলে নিম্নশ্রেণীর (কামার, মুচি, তাঁতি, জেলে) লোকদের মধ্যে ব্যাপক ধর্মান্তর সংঘটিত হয়। এ কথা যৌক্তিক হলেও মানুষ তো সর্বত্রই মুক্তিকামী। তাই সব অঞ্চলেই একইভাবে ধর্মান্তর ঘটার কথা। তাই বলা যায়, তত্ত্বটি আংশিক ব্যাখ্যা প্রদান করে।

(৪) প্ররোচনা তত্ত্ব: ইসলামের সমতা ও সাম্যের কথায় মানুষ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। ইসলামের হাত থেকে সনাতন ধর্মকে রক্ষা করতে শ্রীচৈতন্যদেবও একই ধরনের কথা বলেছেন।

এক সময় বেঙ্গলের ইসলামি স্কলাররা নিজেদের মহানবী (স)-এর বংশধর বলে দাবি করেন। তারা চণ্ডালদের থেকে ধর্মান্তরিত নন। এভাবে তারা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আশরাফ ও আতরাফ এই দুই ভাগে ভাগ করে নিজেদের আশরাফ (শ্রেষ্ঠ) বলে দাবি করতে থাকে। পরবর্তীতে আশরাফদের বহিরাগত বলা হলে এই সংক্রান্ত গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়।

নিচে বেঙ্গলে ইসলামের প্রসার নিয়ে তিনজন মনীষীর প্রাসঙ্গিক তত্ত্ব আলোচনা করা হলো:

(১) অসীম রায়

'ইসলামিক সিনক্রেটিস্টিক ট্র্যাডিশন ইন বেঙ্গল' বইয়ে অসীম রায় 'সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারী তত্ত্ব' উপস্থাপন করেন। এখানে বলা হয়েছে, মূলত বাংলার স্থানীয়রা সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারীদের দ্বারা ধর্মান্তরিত হয়েছে। এই 'মধ্যস্থতাকারী' উনি বলছেন সুফি, পীর, দরবেশ, কবি ও সাহিত্যিকদের। পারস্য থেকে তাদের আনীত ভাষা, ধর্ম, জীবনব্যবস্থা, পুস্তকের মাধ্যমেই বাংলায় 'বড় ঐতিহ্য' প্রবেশ করে। লায়লী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ, আরব্য-রজনী এইসব মধ্যস্থতাকারীরা প্রচার করেন। ধর্মের বিভিন্ন তত্ত্ব সিনক্রেটিজম বা সংশ্লেষণ ঘটিয়ে তারা পরিবর্তনও করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আরবের উপাখ্যানকে স্থানীয় রীতিতে উপস্থাপন, সেখানে বৃন্দাবন, বিদ্যাধরী, দ্রোণাচার্য প্রমুখের উল্লেখ।

(২) রিচার্ড এম ইটন

'দি রাইজ অব ইসলাম এন্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার' গ্রন্থে রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন 'সীমান্ত তত্ত্ব' প্রবর্তন করেন। রাজনৈতিক, আর্থনৈতিক, কৃষিভিত্তিক, সাংস্কৃতিক - নানারকম সীমানা হয়ে থাকে। সুলতানি আমলে বাংলার সীমানায় পরিবর্তনের সূচনা হয়। মোগলরা সুফি, পীর, দরবেশকে নিষ্কর জমিদান করতেন। 'জমি বর্ধিতকরণ নীতি' অনুযায়ী তারা জঙ্গল সাফ করে ফসলি জমি বৃদ্ধি করত। নবসৃষ্ট ওইসব কৃষি অঞ্চল ঘিরে মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে।

(৩) আকবর আলি খান

তাঁর 'ডিসকভারি অব বাংলাদেশ' গ্রন্থে আকবর আলি খান ইসলামীকরণের নেপথ্যে 'খোলা গ্রাম তত্ত্ব' প্রদান করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণমতে, যূথবদ্ধ গ্রামের (পঞ্চায়েত, কাঠামো, জাতপ্রথা যেখানে প্রবল) তুলনায় খোলা গ্রামে (পূর্বোক্তের বিপরীত) ইসলামের বেশি প্রচার ঘটেছে। অর্থাৎ, গ্রাম প্রশাসন যেখানে দুর্বল সেখানে ইসলাম সহজে বেশি জায়গা করে নিতে পেরেছে। খোলা গ্রামগুলোতে পানির প্রাচুর্য থাকায় সেখানে মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ। যে কারণে সেচের জন্য তাদের সমিতি-পঞ্চায়েতের প্রয়োজন পড়ে না। অপরদিকে যেখানে পানির সঙ্কট সেখানে মানুষ সমিতির ওপর নির্ভরশীল। এ কারণেই সেসব অঞ্চলের মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদ মেনে নিয়েছে। খোলা গ্রামে পীরদের প্রবেশকে মানুষ যেভাবে স্বাগত জানিয়েছে যূথবদ্ধ গ্রামে তা পারেনি। পশ্চিম বাংলায় বেশিরভাগ গ্রাম ব্রাহ্মণ দ্বারা পরিচালিত ছিল। পূর্বে পানির প্রাচুর্যের কারণে এসব গ্রামে সেচ সহজ তাই এখানকার মানুষের মধ্যে উদারতা বেশি, আইনও এসব অঞ্চলে যথেষ্ট শিথিল। দেখা গেছে, পূর্ব বাংলায় তাই মুসলিমের সংখ্যা বেশি।

মধ্যযুগে বাংলায় ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

বাংলায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের পরিবর্তনকালকে বলে প্রাক-মধ্যযুগ (৯ম ও ১০ম শতক)। ১২০৪ সাল থেকে মধ্যযুগ ধরা হয়। অর্থাৎ, ইখতিয়ার মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির নদীয়ায় আগমনের সময় থেকে। মধ্যযুগ থেকে বাংলায় রাজনৈতিক ইসলামীকরণ শুরু হয়। প্রাক-মধ্যযুগে ব্যবসায়ী-পীর-সুফী-ধর্মপ্রচারক দ্বারা ইসলাম প্রচার হতো। যাকে বলা যায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইসলাম।

আরব বণিক সুলায়মানের লেখা 'সিলসিলা-তুত-তাওয়ারিক' গ্রন্থে দহুমের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই দহুম হলেন পাল বংশের রাজা ধর্মপাল। সুলায়মান যতদূর জাহাজে চলাচল করা সম্ভব ততদূর পর্যন্ত বেঙ্গলের উপকূল এলাকা ঘুরে গেছেন। সমুদ্রে আরব ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া ব্যবসা হওয়ায় এই পথ তাদের ভালোভাবে চেনা ছিল। ৮ম শতকে আরবরা সমুদ্রপথে ভারতে আসে। তাদের পথ ছিল এরকম - আরব সাগর ভারত মহাসাগর গুজরাটের পর থেকে মুম্বাই কেরালা, মাদ্রাজ, উড়িষ্যা বঙ্গোপসাগরের 'সামান্দার' বন্দর। এটিই বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর। ৯ম শতকে এই বন্দরের উদ্বোধন হয়। আল মাসুদী, আল ইবনিসির বর্ণনায় পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম এলাকায় মুসলমানদের বিধর্মী 'মুর' বলা হত। সুলায়মান বস্ত্র ও কৃষির বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে বেঙ্গলের মসিলন, মসলা, তেল, সুগন্ধি। এর মধ্যে মূলত বস্ত্র যা অত্যন্ত চমৎকার বলা হয়েছে। মুসলিম আগমনের আরেকটি নিদর্শন হলো ১০ শতকে বিক্রমপুরের বাবা আদম শহীদের মাজার।

১৯ শতক পর্যন্তও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম পৌঁছাতে ব্যর্থ ছিল যদিও অনেকদূরই এর প্রসার ছিল। ১৮৭২ সালের ইংরেজ আদমশুমারিতে কিছু মানুষের ধর্ম উল্লেখ করা ছিল 'কৃষিকাজ'! বাংলায় ইসলাম প্রচারের পিছনে সুলতান, সুফি, আলেম, উলামা, শায়েখের ভূমিকা ছিল। কিন্তু কিছু অঞ্চল দূরবর্তী ও ঝুঁকিপূর্ণ তা ইসলামের আওতার বাইরে রয়ে যায়।

প্রতিক্রিয়া

বেঙ্গলের তৎকালীন সমাজে ইসলাম প্রবেশের প্রতিক্রিয়ায় শ্রীচৈতন্য, নূল পঞ্চানন, রামাই পণ্ডিত, ঘটক দেবীবর প্রমুখেরা 'বৈষ্ণববাদ', 'ভক্তি আন্দোলন', 'সংস্কারবাদী আন্দোলন', 'ধর্মীয় পুনর্গঠন আন্দোলন' প্রভৃতি শুরু করেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ, বৈষ্ণববাদ, সনাতন ধর্ম রক্ষার্থে এসব আন্দোলন শুরু হয়। কারণ সাধারণ মানুষ দলে দলে ইসলামে যোগ দিচ্ছিল। এইসব নতুন আন্দোলনের কথা ছিল: প্রেমই ধর্ম, প্রেমে মুক্তি, সাম্য, সমতা, শ্রেণি বা বর্ণপ্রথার লোপ। এদের মধ্যে বৈষ্ণববাদ বহুদিন টিকে থাকে। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, মুচি একসাথে নাম সংকীর্তন করে। ভক্তি আন্দোলন পুরো ভারত জুড়েই ছিল কিন্তু বৈষ্ণব আন্দোলনের নাম হয় 'গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদ'। মীরাবাঈ ছিলেন ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা। গুরু নানকও ভক্তি আন্দোলন প্রচার করেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। এভাবে চার-পাঁচশ বছর যাবত ইসলামীকরণের প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে।

[সূত্র: বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস, আব্দুল করিম।

বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, মোঃ আব্দুর রহিম]



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

48 LAWS OF POWER by Robert Greene and Joost Elffers

Vladimir Putin The definition of power in 21st century

হারবার্ট স্পেনসারের 'জৈবিক সাদৃশ্যবাদ'

ইংরেজ সমাজতত্ত্ববিদ ও জীববিজ্ঞানী হারবার্ট স্পেনসারকে বলা হয় সমাজবিজ্ঞানের দ্বিতীয় জনক। তিনি 'সামাজিক ডারউইনবাদ'-এর একজন প্রচারক। স্পেনসারের বিখ্যাত 'জৈবিক সাদৃশ্যবাদ' সমাজ ও জীবকে বিশেষ সাদৃশ্যপূর্ণ বলে দাবি করে। হারবার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) ১। সমাজ ও জীব উভয়েই আকারে বৃদ্ধি পায়। মানবশিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়। মহল্লা থেকে মেট্রোপলিটন হয়, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্য তৈরি হয়।   ২। প্রত্যেকে আকারে যত বড় হয় উভয়ের কাঠামো জটিলতর হতে থাকে। ৩। দুই ক্ষেত্রেই, কাঠামোগত পার্থক্যের কারণে কার্যকারিতায় অনুরূপ পার্থক্য দেখা দেয়। ৪। জীবদেহ ও সমাজ উভয়েই ক্ষুদ্রতর একক দ্বারা গঠিত। জীবের যেমন কোষ রয়েছে তেমন সমাজের রয়েছে ব্যক্তি। একাধিক কোষ মিলে যেভাবে বৃহত্তর অঙ্গ গঠন করে, একইভাবে একাধিক ব্যক্তি মিলে সমাজের বিভিন্ন অংশ গঠন করে। ৫। সমাজ ও জীব উভয়ই মূলত তিন ধরনের তন্ত্র বা ব্যবস্থার ওপর টিকে থাকে। এরা হলো - বিপাক তন্ত্র (sustaining system), সংবহন তন্ত্র (distributor or circulatory system), স্নায়ু তন্ত্র (regulatory system). জীবের জন্য খাদ্য হলো এর চালিকা শক্তি, সমাজের ক্ষেত্রে যা হলো কৃ...

আমার লেখা বই

আমার সর্বশেষ বই বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা শাখা: ভাষাশিক্ষা প্রকাশকাল: ২০২৪ প্রচ্ছদ:  বইটি পড়ুন আমার পঞ্চম বই চিত্রনাট্যচিত্রণ: কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখার কলাকৌশল শাখা: চিত্রনাট্য প্রকাশকাল: ২০২৪ প্রচ্ছদ: পার্থপ্রতিম দাস বইটি পড়ুন আমার সর্বশেষ উপন্যাস অধিনায়ক শাখা: উপন্যাস প্রকাশকাল: ২০২০ প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত বইটি পড়ুন আমার প্রথম উপন্যাস রঙবাহার শাখা: উপন্যাস প্রকাশকাল: ২০১৫ প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান বইটি পড়ুন আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ অপরূপকথা শাখা: গল্প সঙ্কলন প্রকাশকাল: ২০১৩ প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান বইটি পড়ুন আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি শাখা: গল্প সঙ্কলন প্রকাশকাল: ২০১২ প্রচ্ছদ: বিক্রমাদিত্য বইটি সম্পর্কে জানুন My books on Goodreads রঙবাহার (avg rating 5.00) অপরূপকথা (avg rating 5.00) অধিনায়ক ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা

48 Laws of Power in Bangla Free PDF Download

বিনামূল্যে ই-বুক পিডিএফ ডাউনলোড করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন সরাসরি পড়তে এখানে ক্লিক করুন বিক্রমাদিত্য's books on Goodreads রঙবাহার reviews: 1 ratings: 2 (avg rating 5.00) অপরূপকথা ratings: 1 (avg rating 5.00) অধিনায়ক ভূতলোজি কিংবা চিত্তশুদ্ধি বাংলায় শিখি ফরাসি ভাষা Goodreads reviews for রঙবাহার Reviews from Goodreads.com রাজাদের রাজ্যে রাষ্ট্ররা by রিফু My rating: 5 of 5 stars ডেস্কে বই জমছেই, ছোটগল্পের বই বাদে, পাই না, লেখে না কেউ—জানি কী লেখে—গাছ মারে শুধু শুধু। রিফুর বই আব্বা অল স্টার রেকমেন্ডেশনসহ দিয়ে গেল। গল্প-কবিতা-ক্যাপশনে ‘রাষ্ট্র’ ‘রাষ্ট্র’ ‘রাষ্ট্র’ লিখতে লিখতে ছাবাছাবা করে ফেলেছে সবাই, তারপরও, এই নামকরণটায় বাড়তি মাথা খাটানোর ইঙ্গিত আছে। এক ঘণ্টায় বইয়ের অর্ধেক পড়েছি, চোখের আন...

TFP 415 WORLD CINEMA : Class Notes

Aug 14, 2023 LECTURE 2 Expressionism Reality is distorted Artist’s personal feeling From Northern Europe How did it begin? Effects of WWI  Foreign film banned Horror, insecurity, and paranoia From German romanticism  ENLIGHTENMENT ROMANTICISM Reason Emotion Progress Common good Individuality Unique potential Science and technology Rational, ordered society Nature and imagination Spontaneous, passionate life Social conventions and institutions  Resistance to social conventions and institutions First appeared in poetry and theater “The world is a laboratory” by Gottfried Benn Characteristics of german expressionist theater Distorted and exaggerated sets, props, and costumes Unease and anxiety Symbolism- character might be represented by an animal or object or a particular color Non-linear plot Confusion and disorientation Fragmented nature of the human experience The threepenny opera (1928) by bertolt brecht Characteristics of german expressionism The subjective view of the...

স্বর্গচূড়া

অবশেষে, একদিন, এতবছরের অপেক্ষার পর ট্রেনটা পেলাম আমি। সঙ্গের পোটলা-পুটলিগুলো প্রথমে কামরার ভেতর ছুঁড়ে দিলাম। তারপর নিজের নাম মুখে নিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠলাম ট্রেনে। গাড়িটা এক মুহূর্ত থামে না প্লাটফর্মে। জোর গতিতে ছুটে চলে। কারো জন্য অপেক্ষা করতে নারাজ। একজনের জীবনে একবার বই দু’বার কখনো আসে না। পাল্লা দিয়ে ছুটে তাকে ধরতে হয়। নইলে নাই। অন্য গাড়ি ধরতে হবে। কিন্তু সে গাড়ি যাবে আরেক গন্তব্যে। ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। প্লাটফর্মে সাথীকে দেখতে পাই। হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে অথচ ঠোঁটে হাসি নাই। শুনতে পেলাম মনে মনে কেবল বলছে, তোমার যাত্রা শুভ হোক। (২) প্রথম কবে সাথীর দেখা পেয়েছিলাম ভালো মনে পড়ে না। মনে পড়ে, মন খারাপ করে প্লাটফর্মে বসে ছিলাম। সাথীকে পেয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। কেন, তা মনে নাই। এরপর কত দিন, কত রাত পাশাপাশি বসে কেটে গেল। আমি আর সাথী। স্টেশন জুড়ে এত এত মুখ। কাউকে মনে ধরে নি। সাথী বাদে। সাথীর স্বজনরা একই স্টেশনে ছিল। তবু ও ছিল একা। কী জানি কেন, কখনো জিগ্যেস করা হয় নি। কিন্তু সাথী অনেক প্রশ্ন করত আমাকে। খুব অবাক হতো যে অন্যদের মতো আমার শরীরে কেন বাঁধন নাই। আমার মা-বাবার কথা জিগ...

THE ART OF SEDUCTION by Robert Greene

রবার্ট গ্রিন এখানে ‘সিডাকশন’ কথাটাকে ব্যবহার করেছেন শুধুমাত্র যৌন প্রলোভন হিসেবে নয়, বরং আরো ব্যাপক অর্থে—রাজনৈতিক, সামাজিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে যেই প্রলোভন প্রযোজ্য। এই প্রলোভনের নীতিগুলো জানলে নিজেকে ও নিজের সম্পর্কগুলোকে আরেকটু ভালোভাবে ঝালাই করা যাবে। সেইসাথে তাদের প্রয়োগ করা যাবে ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনে।    সারকথা প্রলোভন ব্যাপারটাই মনস্তত্ত্বের খেলা, সৌন্দর্যের না। ফলে এই খেলার একজন ওস্তাদ হয়ে ওঠা যেকোন মানুষেরই আয়ত্ত্বে আছে। এমন নয় যে, একজন প্রলোভনকারী তার ক্ষমতাটাকে একবার চালু আর একবার বন্ধ করেন—প্রতিটা সামাজিক ও ব্যক্তিগত লেনদেনই তার কাছে প্রলোভনের একেকটা সুযোগ। সুযোগের একটা মুহূর্তও নষ্ট করার নাই। প্রলোভনকারীরা কখনো আত্মনিমগ্ন থাকে না। তাদের দৃষ্টি থাকে বাইরের দিকে, ভিতরের দিকে নয়।  প্লেজার বা পুলক হলো আমাদেরকে আমাদের সীমার বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি, উদ্বেলিত করে দেওয়ার অনুভূতি—তা হতে পারে মানুষের দ্বারা, বা কোনো ঘটনার দ্বারা।  শেষত, যারা কিনা প্রলোভনকারী, তাদের দুনিয়াদারির সাথে নৈতিকতা ব্যাপারটার সম্পর্ক একদম নাই। প্রতিটা প্রলোভনের দুইটা উপাদান থাকে...

মিডিয়া সাক্ষরতা : আদিপর্ব

মিডিয়া সাক্ষরতা ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় জিজ্ঞাসা - মিডিয়া নিজে যতটা প্রাচীন তার চেয়ে কম পুরনো নয়। বর্তমানে তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা মিডিয়া সাক্ষরতাকে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে সত্য। কিন্তু মিডিয়ার প্রভাব ও মিডিয়া সাক্ষরতার গুরুত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন অনেক অনেক আগে থেকেই আলোচিত হয়ে এসেছে। এটাও লক্ষণীয় যে মিডিয়ার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন বিতর্ক একইসাথে নবাগত প্রযুক্তি, শিল্প (আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয় অর্থে), এমনকি সংস্কৃতির গতিপথকে সময় সময় প্রভাবিত করে এসেছে। তবে ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত পরিভাষা বা গবেষণাক্ষেত্র হিসাবে এর অস্তিত্ব ছিল না। যতদিন না বিষয়টি যোগাযোগ স্কলার ও মিডিয়া প্রফেশনালদের কাজের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তার আগ পর্যন্ত (কিংবা এখনো কিছুসময়) যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট ভাবনাসমূহ পরিচালিত হয়/হয়েছে তাত্ত্বিক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও ভাষাতত্ত্ববিদদের দ্বারা। এ যাবৎ মিডিয়া সাক্ষরতা নিয়ে যত তত্ত্বীয় চিন্তা হয়েছে তাতে --- প্লেটো থেকে ফ্রয়েড, সসার (১) থেকে সিক্সাস (২) --- প্রত্যেকেরই রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। উৎপত্তি ও সংজ্ঞা এই তথ্য মোটেও অভিন...

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি : প্রাচীন অর্বাচীন তর্ক

এই লেখাটা ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় যোসেফাইট কালচারাল ফোরামের বার্ষিক ক্রোড়পত্র ত্রিলয়-এ। আমি তখন সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র প্রাচীন -  ওই অর্বাচীনদের আমি শতবার সতর্ক করেছি, আর যা-ই করো, আত্মপরিচয় কখনো হারাবে না। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি এদের সামনে যেন ঘোর অন্ধকার। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছু ভুলে গিয়ে এরা আজ পাশ্চাত্যের অনুকরণে ব্যস্ত। নিজের চশমার 'স্টাইল'টা যতই বাজে হোক না কেন ওটা পরেই তুমি স্বচ্ছ দেখবে। তা না করে যদি অন্যের চশমা চোখে দাও, তোমাকে মানাবে হয়তো ভালো কিন্তু হোঁচট খেতে হবে পদে পদে। অর্বাচীন - তোমার কথায় কেমন যেন ছাপাখানার গন্ধ। তোমার বয়স হয়েছে। তাই চোখে সমস্যা। চোখের পাতা বন্ধ করে তুমি অতীতটাকে সোনালি রঙের মনে করো। আর চোখ মেলে ভবিষ্যৎ দেখতে গেলেই তোমার মনে হয় সেটা বুঝি অন্ধকার। অর্বাচীনদের যতই গালি দাও।পশ্চিমা চিকিৎসার সাহায্য নিয়েই দেখো না চোখটা ভালো হয় কি না। প্রাচীন - বাবা! আজকালকার ছেলেমেয়েরা এক কথার পিঠে একশ কথাকে চাপায়। আমাদের যুগে বড়রা বলত। ছোটরা শুনত। তার থেকেই শিক্ষা নিত। এখনকার ছেলেমেয়দের কথা ...

ইফরিত

মোহাম্মদপুরের এক ভীষণ ব্যস্ত সড়কের পাশে আমাদের দুই বেড-ড্রয়িং-ডাইনিং এর ভাড়া বাসা। বাসাটা যখন নেয়া হয় তখন আমি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। এই এলাকায় ভাড়া তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সদ্য তোলা বাড়ি আর তমালের অফিসও কাছেই হয় তাই ভাবলাম - এই ভালো। বাসায় উঠে গোছগাছ তখনো সারিনি। এক মাস গেছে কি যায়নি তখন থেকে সমস্যাটার শুরু। তমাল অফিস করে ফিরতে রাত নয়টা দশটা বাজত। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও সময় নিত না। আমি কোনদিন ওর সাথে শুয়ে পড়তাম, কোনদিন গল্পের বই পড়তাম অথবা ডায়েরি লিখতাম। এক রাতে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে কিছু একটা পড়ছি হঠাৎ দরজায় টোকা দেয়ার মতো আওয়াজ পেলাম। আমার কান খুব খাড়া। আওয়াজটা বাইরের ঘর থেকে এসেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাত্রি একটার সময় কে বড় দরজায় টোকা দিবে? পড়ায় মন ফিরিয়েছি মিনিটও হয়নি আবার... নক নক। খুব স্পষ্ট আওয়াজ। ভাবলাম সত্যিই বুঝি কেউ এসেছে। রাত হয়েছে বলে কলিং বেল টিপছে না। উঠে গিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রাখলাম। সারারাত বাহিরের আলো জ্বলত। কাউকে দেখলাম না। ঘরে ফিরে আসার কিছক্ষণের মধ্যেই আবার... নক নক। এবার আর দেখতে গেলাম না। দরকার হয় বেল বাজাবে। শীত করছিল। আলো নিভিয়ে তমালকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল...