"স্যার, চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে" ছেলেটা এগিয়ে এল।
"কি? ও আচ্ছা।"
মেজর আবার ভাবনায় নিমজ্জিত হলেন। এমন সময় ক্যান্টিনের ভেতর ধুপধাপ শব্দ তুলে দু'জন সশস্ত্র জোয়ান ঢুকল। এরপর মেজর রাশেদের টেবিলের কাছে গিয়ে তাকে স্যালুট করল। মেজর ওদের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালেন। তাদের একজন একধাপ এগিয়ে এসে জানাল:
"স্যার, কমান্ডার সাব আক্কো হেড কোয়ার্টার বুলায়া"
"তুমলোগ যাও। ম্যায় আভি আয়া।"
জোয়ান দু'জন আবার স্যালুট ঠুকে চলে গেল। মেজরের চা খাওয়া হলো না। চিফ তাকে ডেকেছেন। এর কারণ দুটো হতে পারে। এক, হয়তো তিনি মেজরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করবেন, নয়তো, দুই- তিনি মেজরকে অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সকল যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধযানের কাছ থেকে দূরে থাকতে অর্ডার দেবেন। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে তিনি হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা হলেন। ক্যান্টিনের পাশের বিল্ডিংটাই এখানকার আর্মি হেড কোয়ার্টার। কোয়ার্টারের মাথায় একধারে পাকিস্তানের পতাকা আর একধারে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর পতাকা। দেখলেই গর্বে বুক ভরে ওঠে মেজরের। কত বছর ধরে লড়াইয়ের পর ইংরেজদের তারা এদেশ থেকে তাড়িয়েছেন, মুসলমানরা আলাদা একটা রাষ্ট্র পেয়েছে!
"কাম ইন।" দরজায় টোকার শব্দ পেয়ে চিফ বললেন।
মেজর ঘরে ঢুকে স্যালুট দিলেন। প্রত্যুত্তর দিয়ে টেবিল ছেড়ে দাঁড়ালেন চিফ।
“ইয়েস্ মেজর। মেজর রাশেদ-উর-আল্ল্ম, ম্যায় বুলায়া তুমকো। দেখো, এখানে লুকানো চুপানোর কই বাত নাই। তুম্, আই গেস্, অলরেডি এ বেপারে জেনে গেছো। তুম্ জানো আমি কী বোঝাচ্ছে।"
"ইয়েস স্যার।" মেজর রাশেদ বললেন।
"ইউ মে সিট।"
"থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।"
নিজে না বসেই মেজরকে বলতে লাগলেন চিফ, "তুম্ হয়ত এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানাবে। এ্যাম আই রাইট? তুম্ ইয়ে বাত... আই মিন ইউ ডিডন্ট লাইক আওয়ার ডিসিশান।"
"সরি স্যার। আমি বলতে চাচ্ছি, আমি একজন সৈনিক।"
"হোয়াট?” মেজর ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢালছিলেন। হঠাৎ থেমে গেলেন।
"স্যার, আমি একজন সৈনিক। আমার দায়িত্ব দেশের পাশে থাকা। দেশকে দু'খণ্ড করা নয়।"
"এক্সট্র্যাক্টলি, গো অন।"
"স্যার আমি জেনেছি, পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনা মোতায়েন হচ্ছে। এ-ও জানি, কিছু নিমক হারাম, ইররেসপনসিব্ল বাঙালি অফিসার এর বিরোধিতা করে নিজ দেশেরই মিলিটারির সাথে যুদ্ধে নেমে গেছে।"
"তুমি বুঝতেই পারছ, ওরা কত বড় ট্রেইটর। তুমি কি ওদের সাথ দেবে?"
"অফকোর্স নট্, স্যার। ওরা নাফরমান। দেশ স্বাধীনের আগে থেকে আমি সেনাবাহিনীতে আছি। ব্রিটিশদের তাড়িয়েছি। পাকিস্তান আনতে কম কষ্ট করিনি। 'লাহোর প্রস্তাব' উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। এই দেশটা দু'ভাগ করলে আর থাকলো কী?"
"তাহলে তুমি বিদ্রোহীদের সাথ্ দিচ্ছ না? সাবাস্। সাচ্চা সৈনিক। এই দেশের লিয়ে এইসা জোয়ান বহত জরুর আছে। ইউ মে গো।"
"থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আল্লার ওপর ভরসা রাখলে মুসলমানদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। সালাম।"
দরজা ভিড়িয়ে মেজর রাশেদ চলে গেলেন। চিফ কিছুক্ষণ একমনে চিন্তা করে অল্প হাসলেন। যাক্ তাহলে, ২৫ শে মার্চের রাতের ব্যাপারে মেজর কিছু জানতে পারেনি।
***
বাঙালিরা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছে। কালুরঘাট থেকে কালকে সর্বত্র প্রচারণা চলেছে। অদ্ভুত ব্যাপার, জোয়ানদের মধ্যেও বিদ্রোহের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙালি সেনাদের কাছেও আর এ খবর গোপন নেই। অফিসাররা তো ২৫ শে মার্চের আগেই কেউ কেউ জেনে গেছে।
মেজর রাশেদ রাত দু'টা-আড়াইটা নাগাদ এক গোপন জায়গা থেকে কল পেলেন। আর্জেন্ট কল। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ কল করেছে। বলল, দ্রুত সেখানে যেতে। মেজর একটু ভেবে জিপ নিয়ে কোয়ার্টার থেকে বের হলেন। যথাস্থানে গিয়ে দেখলেন, সেখানে একগাদা বাঙালি অফিসার জমায়েত হয়েছেন। বোঝা যায়, গোপন বৈঠক চলছে। এই বাঙালি অফিসারদের একত্রে ডেকেছেন কর্নেল কাসেম।
"শোন সবাই" কর্নেল প্ল্যান বোঝাচ্ছেন, "আমাদের তড়িৎ এ্যাকশনে নামতে হবে, কেউ কিছু বোঝার আগেই। ক্যাপ্টেন আজিজ, আপনি বাঙালি সোলজারদের একত্র করবেন। ক্যাপ্টেন বাশার, আপনি ইসলামাবাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবেন। আর ক্যাপ্টেন মজিদ, ইউ শ্যুড অ্যারেস্ট মেজর রুস্তম এ্যান্ড কর্নেল মীর্জা। মেজর রাশেদ, আপনি সোলজারদের লিড দেবেন। সমস্যা নাই, এখানে বাঙালি জোয়ান বেশি। আপনাদের সহযোগিতা পেলে এখানকার ক্যান্টনমেন্ট দখল হবে। বাংলার জয় হোক।" কর্নেল থামলেন, "আপনাদের কারও দ্বিমত আছে?"
"না।" সবার হয়ে মেজর রাশেদ বললেন।
"ওয়েল দ্যান, অস্ত্রাগার লুট করতে হবে সবার আগে। গেট রেডি।" কর্নেল উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খুলতেই সকলকে চমকে দিয়ে ভেতরে কয়েক জন সশস্ত্র সৈন্য ঢুকে পড়ল। সকলে পজিশন নেওয়ার পর ধীর পায়ে চিফ কমান্ডার ঘরে ঢুকলেন। "ব্রাভো! হোয়াট আন আইডিয়া"! জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললেন চিফ, "আই'ম এফরেইড, সেটা কোনহ কাজে লাগল না। সোলজারস্, অ্যারেস্ট দ্য ট্রেইটরস!"
জোয়ানরা সকলের হাত পিছমোড়া করে বাঁধল।
"ওয়েলডান মেজর রাশেদ। তুম হারা জাওয়াব নাহি।" মেজরের কাঁধে হাত রাখলেন চিফ।
"বিশ্বাসঘাতক!" ক্যাপ্টেন মজিদ চেঁচিয়ে উঠল, "মেজর আপনি জানেন না আপনি কত বড় ভুল করলেন। আপনার মধ্যে কি সামান্য দেশপ্রেমও নেই?" জোয়ানরা গুঁতো দিয়ে ক্যাপ্টেন মজিদের মুখ বন্ধ করাল।
"ননসেন্স!" মেজর রাশেদ ধমকে উঠলেন, "তুমি আমাকে দেশপ্রেম শেখাচ্ছ!! নিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার মধ্যে দেশপ্রেম কোথায়? বাঙালিরা বিদ্রোহ করতে পারে, কিন্তু বেঈমানি নয়!"
মেজরের কথা শেষ না হতেই জোয়ানরা বাঙালি অফিসারদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল।
"ইউ আর রিয়্যাল সোলজার, ম্যান। আই লাইক ইউ। তুম্ যদি আমাদের কল করে কোয়ার্টার থেকে না বের হতে, দেন উই উড বি ডুম্ড। আই স্যালুট ইউ।"
"সবই ওপরওয়ালার দয়া, স্যার।"
নিজের বুদ্ধি ও কর্মের প্রতি প্রসন্ন হয়ে বললেন মেজর রাশেদ। চিফ আর সেনারা চলে গেলে তিনি বাতি নিভিয়ে বিলিয়ার্ড ঘরটা থেকে বের হলেন, যেখানে গোপন ষড়যন্ত্রটা চলছিল।
জিপ নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলেন মেজর। মেজর রাশেদুর আলম। '৪৫-এ তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সে সময় থেকেই তরুণ এই অফিসার স্বপ্ন দেখতেন, মুসলমানদের আলাদা একটা দেশ হবে, আলাদা শাসনতন্ত্র কায়েম হবে। আজকে দেশের এই পরিস্থিতি তাকে সত্যিই চিন্তিত করেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই তিনি তাঁর বাড়ির সামনে জিপ থামালেন।
বাড়িতে ঢুকলেই মোর্শেদ তাঁর সামনে পড়ল। মোর্শেদ তাঁর বড় ছেলে। শখ করে ছেলেকে দামি স্কুলে লেখাপড়া করিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। এ বছর মোর্শেদ নৌবাহিনীতে পরীক্ষা দেবে। ছেলে বড় নেভি। অফিসার হবে। মেজরের মন আনন্দে ভরে ওঠে।
"আব্বা, কোথায় গেছিলেন এত রাতে?" মোর্শেদ জানতে চায়।
"জেগে গেছিস? আমি একটু বাহিরে গেছিলাম। কাজ ছিল।"
"কী কাজ? বিদ্রোহ করা, না দমন করা?"
“ও আচ্ছা" জুতো খুলতে খুলতে বলেন মেজর, "দ্যাট ননসেন্স! হ্যা, তা তুই জানলি কোথেকে?"
কে না জানে আব্বা? সারা পূর্ব-পাকিস্তানে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। লুকিয়ে লুকিয়ে আর্মি ঢোকান হয়েছে। নির্বিচারে হত্যা চলছে..."
"ভুল শুনেছিস" ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে রাশেদ বললেন- "রাজনীতি তোর মাথা খেয়েছে। তোর মতো উল্লুক আর বখাটে ছোকরা আরও আছে এ দেশে। সরকারের কাজে বাধা দিতে গিয়েই তারা দলে দলে মরছে। কী দরকার বাবা? যেমন আছে থাক না! দেশ ভাগাভাগির দরকার কী?"
"এছাড়া যে উপায় নেই আব্বা" মোর্শেদ জগ থেকে পানি ঢেলে বাবাকে দেয়। "শেখ সাহেব তো নির্বাচনে জিতেছেনই। এটা নিয়ে জবরদস্তির কী আছে? ক্ষমতা ছেড়ে দিলেই হয়। তা নয়, উল্টো তারা আলোচনার নামে সেনা পাঠাচ্ছে। ঢাকা ইউনুভার্সিটিতে কালকে রক্তের বন্যা গেছিল।"
"দ্যাখ, তুই এসব বুঝবি না" মেজর তাঁর ক্যাপ ঝুলিয়ে দিলেন, "শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসা মানে, প্রথমেই সে রাজধানী চেঞ্জ করবে। আর চট্ট করে সেটা করার মানে, দেশের ইকোনমিক্যাল প্রবলেমকে কোথায় নেয়া বুঝতে পারছিস? সে ক্ষমতায় গেলেই সমস্ত ইম্পর্ট্যান্ট জিনিসগুলো অদল- বদল হয়ে যাবে। এটাও পরিষ্কার যে, সে ক্ষমতায় আসামাত্র সব জায়গায় বিরাট পলিটিক্যাল চেঞ্জ আনবে। দেশের এই অবস্থায়, সেটা যে ভালো ব্যাপার হবে না তা তুই জানিস। পাকিস্তান সরকার এতকাল যে শাসনব্যবস্থা কায়েম রেখেছে সেটাতে হঠাৎ পরিবর্তন আনলে দেশের পরিস্থিতি তো খারাপ দিকে যাবেই। দেশটাকে মুজিব হয়ত ভাগ করবে, নয়ত ইন্ডিয়ার সাথে হাতমিলায়া পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে সবসময় গণ্ডগোল বাঁধায়া রাখবে। পাকিস্তান সরকার সেটা চাইবে কেন? ওরা এতকাল দেশ শাসন করে এসেছে। বাঙালিরা শাসনের কী জানে?"
"একটা চান্স তো..."
"আবার!" মেজর এতক্ষণ শাটের বোতাম খুলে ফ্যানের তলে সোফা টেনে বসেছিলেন। এখন উঠে ফ্যান বন্ধ করতে করতে বললেন, "মুখে মুখে তর্ক করবি না। সরকারের আরো অনেক সমস্যা আছে। তুই যা, এখন ঘুমাতে যা।"
"ক'জনের মুখ বন্ধ রাখবেন, আব্বা?" নিজের ঘরে ঢুকল মোর্শেদ, "পূর্ব-পাকিস্তান একদিন স্বাধীন হবেই।"
"নাহ!" মেজর হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে ঘরে ঢুকলেন।
***
আবার মেজরের ডাক পড়ল হেড কোয়ার্টারে।
"মেজর" চিফ কমান্ডার নিজের খাতা-কলম একপাশে সরিয়ে মেজর রাশেদকে টেবিলের সামনের চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন, "আই থিঙ্ক ইউ নো, হাম্ আপকো কেনো বুলায়া।"
"আ, ইয়েস স্যার, আই নো।" মেজর চেয়ারে বসে বললেন।
"ওয়েল, আপকা বেটা যা করেছে, দ্যাট ওয়ায আ গ্রেট ক্রাইম। উড ইউ প্লিজ এক্সপ্লেইন মি, আপনার মতো এতো ডিউটিফুল আর্মি অফিসার কা বেটা, এটা করলো কেসে? ঘরসে ভেগে মুক্তিফৌজ কা সাথ দেয়া, ইজ নট আ লিট্ল মিস্টেক!"
"আই নো স্যার, আই অন্ডারস্ট্যন্ড।" মেজর বলেন।
মেজর রাশেদের ছেলে মোর্শেদ কিছুদিন হয় বাড়ি থেকে বাবার রিভলবার (লোকজন অবশ্য বলছে, রাইফেল আর দু'টো শর্টগান) নিয়ে গায়েব হয়ে গেছে। পরে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের রিপোর্ট এসেছে, মোর্শেদ মুক্তিফৌজের ট্রেনিংয়ে গেছে।
"তা বললে তো হবে না, এইসা চিন্তা ও কাঁহাসে পেলো?"
"আমারই ভুল। আমার প্রশ্রয়েই ও এতো আজেবাজে ছেলের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছে। আই এ্যাম সরি, স্যার।"
"আই সি। আপনি কি ওকে সাপোর্ট করেন? ও ফিরে এলে কি ওকে বাড়িতে নেবেন?"
"নেভার, স্যার। ও এরপর আমার সামনে পড়লে আই উইল শ্যুট হিম।"
"আই বিলিভ ইউ। আই ট্রাস্ট ইউ। আপ আমাদের নেক্সট মিশনে থাকবেন। আই মিসেল্ফ উইল ক্যরি কমান্ড। বি প্রিপেয়ার।"
"অফকোর্স" মেজর বেরিয়ে এলেন। ছেলের বোকামিতে তিনি অত্যন্ত অসুন্তুষ্ট। দেশদ্রোহ করবে, মারা তো একদিন পরবেই। তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। মোর্শেদ কিভাবে করল এটা? বাবার কথা একবার ভাবল না? বাবার পজিশানটা দেখল না? না দেখুক। জমশেদ, ওর ছোটভাই কী শিখবে? তিন তিনটা বোন আছে! ভাইয়ের কুকর্মের কথা জানলে ওদের কি এদেশে আর বিয়েশাদি দেওয়া সম্ভব হবে?
***
পূর্ব-পাকিস্তান। নাফরমানদের বিরুদ্ধে আসলেই রীতিমত যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার কাফিররা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে ওদের। অধিকাংশ বখা ছেলেপেলে আর আওয়ামী লীগের সাপোর্টার। ওরাই ফুঁসলিয়ে অন্যান্য গরীব, নিচু শ্রেণীর লোকদের ইন্ডিয়ায় নিয়ে ট্রেনিং দেয়াচ্ছে। নিজ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেখাচ্ছে! নাম দিয়েছে মুক্তিফৌজ!
মেজররা তাদের যার যার কম্পানি নিয়ে প্রস্তুত আছেন। বিশ্বের ওয়ান অব দ্য ওয়েল ট্রেইন্ড এ্যান্ড পাওয়ারফুল বাহিনীর নাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মেজর রাশেদের কম্পানিতে আছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, অটোমেটিক গ্রেনেড লঞ্চার, অটোমেটিক-সেমিঅটোমেটিক মেশিনগান, সাব-মেশিনগান, অত্যাধুনিক ব্যবস্থা আর যুদ্ধ সরঞ্জামসহ দু'টো লঞ্চ। কতকগুলো মিলিটারি জিপ আর সাঁজোয়া যান আছে বহরে।
মেজর রাশেদ যুদ্ধাস্ত্রের রকম দেখে আন্দাজ করলেন যুদ্ধটা বেশ গুরুতর। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? মুক্তিফৌজগুলোর একমাত্র ভরসা ইন্ডিয়া। এছাড়া মান্ধাতার আমলের কিছু বন্দুক! তাহলে সরকার সাধারণ কিছু ছেলে-ছোকড়া আর চাষা-মজুরকে বাগে আনতে এরকম আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র পাঠানর ব্যবস্থা কেন নিয়েছে? মেজর আবছা-আবছা শুনেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যতটা সম্ভব সহায়তা দেওয়া হবে। দেশের কিছু চরমপন্থীকে দমন করতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ থেকে সহায়তা কেন প্রয়োজন?
প্রশ্নের উত্তর মেজর কিছুদিন পরে পেলেন। সেদিন চিফ কমান্ডার, বেরোলেন মেজরের সাথে, এলাকাটা ঘুরে দেখার জন্য। তবে চিফের গাড়িবহর দেখে মেজরের মাথা ঘুরে গেল।
চিফের নিরাপত্তার জন্য সাধারণত দু'জন বডিগার্ড থাকে। চিফের জিপের আসনেই তাদের জায়গা হয়। আর থাকে একজন ড্রাইভার। কিন্তু আজ তাঁর জিপের সামনে ৩টি জিপ। পেছনে ৫টি। প্রত্যেক জিপে ভর্তি হয়ে আছে পুরোদস্তুর পোশাক আর অস্ত্রে ঢাকা সৈন্য। প্রত্যেক জিপের সামনে ভারি মেশিনগান। এলাকা ঘুরে দেখতে এতোগুলো চোখের প্রয়োজন নেই, তা মেজর রাশেদ ভালো করেই জানেন। তাঁর মনে যে সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে তা পরখ করতে চান মেজর। চিফের পাশেই বসবেন তিনি। সাথে বসবেন মেজর মুস্তাক। মেজর রাশেদ এটিও খুব ভালো করেই জানেন যে, মেজর মুস্তাক তাঁকে অপছন্দ করেন। এর কারণও পরিষ্কার। মেজর মুস্তাক, কমান্ডারের ওপরও বিরক্ত, মেজর রাশেদের ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস দেখে। ২৬ শে মার্চের আগে থেকেই মেজর মুস্তাক, চিফকে বলেছিলেন, অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সাথে রাশেদকেও সাসপেন্ড করতে। চিফ পাত্তা দেননি। অতঃপর মেজরের ওপর তাঁর ভরসা আরও বেড়ে যায় যখন মেজর কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন।
জিপগুলো স্টার্ট নিল। কিছুদূর যেতে পথে একটা বাধা পড়ল। বাধাটা হচ্ছে ছোট্ট একটা শিশু। কাঁদছে। বিবস্ত্র শরীর। কোমরে একটা তাবিজ। রাস্তার মাঝখানে বসে দু'পা ছড়িয়ে কাঁদছে। কত বয়স- বড়জোর এক বছর। সামনে জিপের ড্রাইভার তা তোয়াক্কা না করে বাচ্চার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছিল। মেজর রাশেদের দৃষ্টি চারিদিকেই ছিল, তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, "স্টপ দ্য জিপ। গাড়ি রোকো!" আদেশ পালিত হলো। গাড়ি থামল। একটার দেখাদেখি সবগুলো।
পেছনের জিপের অফিসাররা এখনো ব্যাপারটা খেয়াল করেননি।
"কেয়া হুয়া?" শেষ জিপ থেকে লেফটেনেন্ট কর্নেল জুনায়েদ আওয়াজ দিলেন।
"হোয়াট হ্যাপেন্ড মেজর? জিপ থামিয়েছেন কিউ?" চিফ কমান্ডার ধীরে গলা নামিয়ে জানতে চাইলেন।
"ওই দেখুন স্যার, একটা বাচ্চা।"
"তো কেয়া হুয়া? কিল হিম।"
"হোয়াট।" বিস্ফারিত চোখে বললেন মেজর। গাড়ি থেকে ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন। ইউনিফর্মে ধূলো লাগল, "কার বাচ্চা এটা?"
"সামবডি লেফট হিম, ডোন্ট বি এ্যাঙ্কশাস। কিল হিম।" চোখের কালো চশমা খুলে মেজর মুস্তাক বললেন।
"এ কেমন কথা। ও তো একটা ছোট্ট বাচ্চা। এখনো কথাই শেখেনি। ওকে মারব কেন?" মেজর রাশেদ প্রশ্ন রাখেন।
"হোয়াট আ ননসেন্স সেন্টিমেন্ট!" চিফ কড়া গলায় বললেন, "ইয়ে বাঙ্গাল হ্যায়। এর বাপ বাঙ্গালি আছে। বড় হয়ে শয়তান হোবে। ফিনিশ হিম।"
মেজর অগত্যা বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই চিফের ইশারায় দুটো গুলি ছুটে এসে ক্রন্দনরত শিশুটার বুক ফুটো করে দিল।
"লেটস্ গো" চিফ বললেন। তাঁর জিপ স্টার্ট নিল, "কাম অন মেজর। এ দেশে এইসা বাচ্চা এখন হর-হামেশা খুঁজে পাবেন।"
বাচ্চাটা একটা সূচনামাত্র। এরপর যে কত কত মানুষ মারা পড়ল! গাড়ির সামনে চাষা-মজুর-দোকানদার যেই পড়েছে সেই খতম হচ্ছে। এত অস্ত্র নেওয়ার মানে এবার উদ্ধার হলো। মেজরের সন্দেহ ঠিক ছিল, পরিকল্পিত গণহত্যারই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল।
কত্ত দুর্বল বুড়ো মানুষ। কত্ত ভিখারী! ক্ষেত থেকে পটল তুলে নিয়ে যেতে থাকা বালক, আর্মি দেখে ভয় পেয়ে পালাতে থাকা কিশোরী, সবার লাশ পড়ে থাকল রাস্তায়।
মেজর যেন ঘোরের মধ্যে ডুবে রয়েছেন। এ কী দেখছেন তিনি!! মাথা ঘুরে যাচ্ছে। এই তাঁর দেশ? এই তাঁর গর্বের সৈন্যদল? এ-কী করছেন তিনি? এ কার, কাদের সাহায্য করছেন? কেন কর্নেল কাসেমের কথা মানলেন না? কেন ধরিয়ে দিলেন তাঁদের? আজ তাহলে অন্তত এটা দেখতে হতো না। নিজের ওপর ঘৃণা জন্মাল তাঁর।
পরদিন ওরা আবার গ্রাম ঘুরতে বের হলো। যথাযথ যুদ্ধ-প্রস্তুতি নিয়ে। আবার নির্দয়, হিংস্র উল্লাসে মেতে উঠল। ছিন্ন-ভিন্ন করে দিল সকলের দেহ। মেজর রাশেদ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন।
"হোয়াটস্ আপ?" চিফ বেশ উৎফুল্ল, "পাথথোর হয়ে বেঠে আছেন কেনো?"
মেজর মুখ খুললেন না।
"হোয়াটস দ্য ম্যাটার, ম্যান?"
"আমরা কি এদের দমন করতেই এখানে এসেছি?" মেজর কঠিন মুখে জানতে চাইলেন।
"ও হো" চিফ হাসলেন। "ডোন্ট বি এক্সসাইটেড, ওয়েট, হামলোগ আজ যাবে মেইন মিশন মে। উই উড হ্যাভ আ লঞ্চ উইথ আস।"
"কোথায় জানতে পারি কি, স্যার?"
"মুক্তি ক্যাম্প মে।" চিফ গলা নামালেন, "হামাদের কাছে আল-শামস কা রিপোর্ট আছে। দেয়ার ইজ আ মুক্তি ক্যাম্প নিয়ার। উই শ্যড অ্যাটাক ইট দিস নাইট।"
মেজর আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। তিনি শুনেছেন ট্যাঙ্ক আনানোর জন্য এপ্লাই করা হবে। তা দিয়ে যুদ্ধ চলবে না। হত্যাযজ্ঞ চলবে। নির্বিচার গণহত্যা।
***
গরম কাল। ভ্যাপসা গরম। অথচ নদীর ওপর দিয়ে বাতাস বইছে। আকাশে অজস্র তারা। আকাশজুড়ে কেউ যেন চিকচিকে বালুকণা ছড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানি লঞ্চটা ছোট্ট নদীটার ওপর দুলছে। দুলে দুলে সামনে এগুচ্ছে। ডেকে দুজন সশস্ত্র সৈনিক দাঁড়িয়ে। তাদের শরীরে চাঁদের আলো পড়েছে। লঞ্চটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে না এর ভেতরে কত্ত অস্ত্রশস্ত্র ঠাঁসা। বোঝাই যাচ্ছে না. এর ভেতরের লোকগুলো নরহত্যার এক পৈশাচিক খেলায় মেতেছে।
মেজর দাঁড়িয়ে আছেন গ্রেনেড লঞ্চারটার পাশে। তিনিই লঞ্চ করবেন। এক ক্যাম্পভর্তি মানুষ উড়িয়ে দেবেন। মানুষগুলো যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে!
মেজর নির্বাক, নিশ্চল হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ তাঁর সামনে একজন লোকের কান কেটে নেওয়া হয়েছে। অকারণে। আরেকজনের হাঁটু বেয়নেট দিয়ে চেঁছে দেওয়া হয়েছে। অকারণে। তাদের সেই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আর্তনাদ এখনও মেজরের কানে বাজছে। কয়েকজন হিন্দুর হাত জোর করে আগুনে চেপে রাখা হয়েছে। মেজরের সামনে দু'জন রাজাকার, চিফকে দেখিয়ে, দু'জনকে জবাই করেছে। রাজাকাররা তো বাঙালি! তবে তাঁরা কেন এই অমানবিক কাজ করছে? ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য? ইসলাম প্রতিষ্ঠার অর্থ যদি এই হয় তবে ধিক সেই ধর্মকে!
লঞ্চটা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। গাছপালায় ঢাকা মুক্তিক্যাম্প। রিপোর্ট না পেলে তাঁরা অনুমানও করতে পারতেন না যে পাকিস্তানি ক্যাম্পের এতো কাছে, শীর্ণ একটা নদীর ঠিক ওপারেই এটা আছে। ভারী রকেট লঞ্চারটা ঘুরিয়ে মেজর রাশেদ মুক্তিক্যাম্পের দিকে তাক করালেন। চিফ সব কিছু দেখছেন। তিনি একতলার ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠিক তাঁর পেছনেই, মুক্তিক্যাম্পের সমান দূরত্বে, পাকিস্তানি ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে।
"পজিশন অলরাইট?" চিফ কমান্ডার প্রশ্ন করলেন।
মেজর কিছু বললেন না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলেন শূন্য দৃষ্টিতে। চিফ উত্তরের জন্য আর অপেক্ষা করলেন না। ওপর থেকেই চেঁচালেন-
"ও কে, নাউ লা-উঞ্চ!"
মেজর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে।
"আই রিপিট। লা-উঞ্চ!"
মেজরের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
"কেয়া হুয়া? আই সেইড লাউঞ্চ।"
চিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। উপায় না দেখে নিচে নেমে আসতে আসতে বললেন, "শুনা নেহি? ছোঁড়ো!"
মেজর এবার অতিদ্রুত রকেট লঞ্চারের মুখটা ঘোরালেন। কেউ কিছু বোঝার আগেই হাতল দাবিয়ে দিলেন। গ্রেনেডগুলো একের পর এক সশব্দে উড়ে গিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে বিস্ফোরিত হলো। দাউ দাউ করে ক্যাম্পে আগুন ধরে গেল। বিপুল অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদসহ ক্যাম্পটা নিজে থেকে আরও উজ্জ্বলতর হয়ে জ্বলে তছনছ হয়ে গেল। পাখিবা কিচমিচ করে জেগে উঠল।
বিপুল মূল্যবান সম্পদ এভাবে ধ্বংস হতে দেখে সেদিক থেকে চোখ ফেরালেন চিফ। মেজরের দিকে চেয়ে চিৎকার করে উঠলেন, "হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান!" চিফ ছুটে এলেন। সাথে সাথে আরও অফিসাররা। "হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান!" চিফ আবার চেঁচিয়ে উঠলেন পাগলের মতো।
মেজর ভাবলেশহীনভাবে তাঁর রিভলবার বের করলেন, তাক করলেন চিফের দিকে। পয়েন্ট ২২ ক্যালিবার। চিফ রক্তাক্ত বুকে লুটিয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে মুক্তিফৌজরা সজাগ হয়ে গেছে। সৈন্যরা সব স্তব্ধ হয়ে লঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে।
"শ্যুট হিম!" হঠাৎ মেজর মুস্তাক চেঁচিয়ে উঠলেন। আশপাশ থেকে অনেক গুলি এসে মেজর রাশেদকে ধরাশায়ী করল। আর অন্যান্যদের ধরাশায়ী করল মুক্তিফৌজের গুলি।
চারদিকে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে মেজর রাশেদও। তাঁর চেহারায় আর বিরাগ বা হতাশার ভাব নেই, বরং যেন ফুটে উঠেছে গৌরব আর সাফল্যের হাসি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন