এই আলোচনায় আমি কলোনিয়ালিজমের বাংলা পরিভাষা হিসেবে দখলদারিত্ব কথাটাকে ব্যবহার করছি। দখলদারিত্ব বলতে সেইসব নীতি ও চর্চাকে বোঝাচ্ছি যার দ্বারা এক দেশের উপর আরেক দেশের আংশিক বা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পায়। এর একটি বড় পরিণাম হলো দখলদার দেশ কর্তৃক দখলকৃত অঞ্চলের অর্থনৈতিক শোষণ। ধ্রুপদী দখলদারিত্বের যুগে ঔপনিবেশিক দস্যুবৃত্তির চালিকা শক্তি ছিল বেনিয়া পুঁজি। সেই উপনিবাসীদের নজিরবিহীন লুটতরাজের প্রত্যক্ষ সুফল হয়েই আসে প্রথম শিল্প বিপ্লব। যা ছিল বৃহৎ পুঁজিবাদী বিপ্লবের একটি অংশ। পুঁজিবাদী বিপ্লব থেকে উদ্বৃত্ত হওয়া পুঁজ বা পুঁজি পরবর্তীতে শোষণের চাকা ঘূর্ণায়মান রাখতে সাহায্য করেছে। অর্থাৎ শোষণ থেকে আরো শোষণ, পুঁজি থেকে আরো পুঁজি। পণ্ডিতরা বলতে চান, আজকের দিনে নতুন খোলসে সেই একই দখলদারিত্বের হাতিয়ার হয়েছে যাবতীয় ডিজিটাল মাধ্যম। এই নবরূপী দখলদারিত্বর নাম ডাটা কলোনিয়ালিজম বা ডিজিটাল কলোনিয়ালিজম। কর্পোরেট দখলদারিত্বের এ অন্যতম চেহারা। যার পরিণাম হয়ে এসেছে সর্বব্যাপী নজদারির পুঁজিতন্ত্র। এই নজরদারির কাজ তারা স্বদেশ আর কথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় সমান উৎসাহ নিয়েই করে থাকে। তবে ‘সাবেক’ দখলদার দেশগুলোর আইনকানুন তাদের পুঁজিপতিদের ওপর তাও যেটুকু বিধিনিষেধ আনতে পারে, দখলকৃত দেশগুলো সেটুকু পারে না। উন্নত বিশ্ব পুঁজিবাদের আপেক্ষিক সুফল হিসেবে যে গণতন্ত্র উপভোগ করে সেটুকু অনুন্নত পুঁজির দেশগুলোয় একে তো অনুপস্থিত। তবে চীনের মতো নব্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তার নিজের দেশের জনগণের উপরও একই রকম নজরদারি করে। গ্লোবাল সাউথ যে দখলদারদের নজরদারি ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা মার্কিন কংগ্রেসের মতো উদ্যোগ নিতে পারেনা তার কারণ এই দেশগুলো ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রশ্নে নর্থের কাছে একরকম জিম্মি। ডিজিটাল মাধ্যমের অন্তর্ভুক্ত মূলত—সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার, ও সংযোগ। আর এই তিন মাধ্যমের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য গুগল (অ্যালফাবেট), অ্যাপল, ফেসবুক, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট—এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের। সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার, ও সংযোগ অধিগত করার ক্ষমতা সকল দেশে সমানভাবে নাই। বিশেষ করে উপনিবাসী শক্তি দ্বারা শোষিত অঞ্চলের কাছে সেই পুঁজি ছিল না যা তারা ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করতে পারে। আগের মতোই বিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বিপ্লবের একটি সুফলভোগী পক্ষ আছে আর একটি পক্ষ আছে যে কিনা ভোগের শিকার। বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবনের পর উপনিবাসী পক্ষগুলো তাদের দখলকৃত দেশে বিপুল উৎসাহে রেললাইন নির্মাণ করেছে। একসময় তারা ঔদ্ধত্যের সাথে দাবি করেছে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ‘উন্নত’ করতে তারা এই অবদান রেখেছে। যদিও বাস্তবতা হলো এসব রেলপথের উদ্দেশ্যতালিকায় প্রথম দিকে ছিল সম্পদ পাচার, অস্ত্র আনয়ন, বেহতর প্রশাসন (পরিশোষণ) ইত্যাদি ইত্যাদি। ডিজিটাল বিপ্লব-প্রসূত বড় বড় পুঁজিপতি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নীতিবাক্য হয়ে ওঠে: সংযোগ স্থাপন, উন্নত ডিজিটাল যোগাযোগ, মানুষকে কাছাকাছি আনা, পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দেয়া ইত্যাদি। প্রথম প্রথম হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার বিক্রি করে তারা ব্যবসা করেছে। অন্তর্জাল উদ্ভাবনের পর তাদের প্রধান লক্ষ্য হয় কানেক্টিভিটি বা সংযুক্তি। সংযোগ স্থাপনের মিশন নিয়ে তারা হার্ডওয়্যারগুলো নামমাত্র মূল্যে আর বেশিরভাগ সফটওয়্যার একদম বিনামূল্যে বাজারে ছেড়েছে। এই যে আপনি মাগনা মাগনা গুগল ব্যবহার করছেন, টিকটক ব্যবহার করছেন, ফেসবুক চালাচ্ছেন—এতে তাদের লাভটা? তথ্য! দখলদার শক্তি বলে “data is the new oil.” ইন্টারনেট দুনিয়ায় চলতে-ফিরতে-বলতে আমরা যে কোটি কোটি তথ্যের উৎপাদন করছি তা হাতিয়ে নিচ্ছে কে? এই দখলদার প্রতিষ্ঠানগুলোই তো? মোটা দাগে ওই পাঁচটা প্রযুক্তি দানব। এইসব তথ্যকে কীভাবে পুঁজিতে রূপান্তর করে ব্যবহার করা হয় সেই নিয়ে আমার আগের লেখায় আলোচনা করেছি (এখানে দেখুন)। প্রাচ্যের অনেক অভাবের মধ্যেও যার প্রাচুর্য আছে তা হলো জনসম্পদ। উন্নতির নামে এদের হাতে হাতে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ ধরিয়ে দিলে প্রচুর পরিমাণ মানুষ বিনা আপত্তিতে বিপুল পরিমাণ তথ্য উৎপাদন করে দিবে। আর এসব তথ্য—যাকে তারা বলে ‘বিগ ডাটা’—সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে গ্লোবাল নর্থের কুক্ষিগত। শুধুমাত্র যন্ত্র আর সঞ্চয়স্থানই তারা নিজেদের অধিকারে রাখেনি, ধারণকৃত তথ্যকে কাজে লাগাতে জানে এমন মানবসম্পদও তাদের দখলে। প্রাচ্য থেকে যত মেধা পাচার হয় তার মধ্যে দখলদারের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো প্রযুক্তিবিদ্যায় দক্ষ জনশক্তি। অনুন্নত দেশে প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসারকে তারা যেভাবে উৎসাহ দেয় তেমনই সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রযুক্তিবিদ ও বিদ্যার্থীদের পাশ্চাত্যের দিকে আকৃষ্ট করে। তৃণমূল থেকেই আমাদের এডুকেশনের পিছনে বিনিয়োগ করতে তারা ভীষণ আগ্রহী। সুফল হিসেবে একদিকে ডিজিটাল পুঁজিব্যবস্থার নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি হয় আরেকদিকে এই ব্যবস্থাকে সচল রাখার কারিগর ভিসা নিয়ে তাদের দোরগোড়ায় হাজির হয়ে যায়। ‘পিছিয়ে পড়া’ বিশ্বকে টেনে তোলার প্রবল তাড়নাকে সামনে রেখে আড়ালে চুরি আর পাচারের মহাযজ্ঞ তাদের সনাতনী দখলদার নীতিরই অনুকরণ করে। বিগত আমলের বেনিয়া দস্যুদের উপনিবেশ গড়তে তাদের রাজ্য সামরিক-রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দিত। বিনিময়ে লুটের সম্পদ নিজেদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে নিত। আজকের দখলদার রাষ্ট্রও তার পুঁজিপতি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আঁতাত করে চলে। পর্দাফাঁসকারীদের সূত্রে জানি যে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলতে গেলে সমস্ত বিগ টেকের সাথে যৌথ কারবারের অংশীদার। যে কারণে একচেটিয়া বাণিজ্যে তারা বিশেষ প্রশ্রয় পেয়ে থাকে আর ডিজিটাল কলোনির আইন-কানুনকে তো তোয়াক্কাই করে না। এসব প্রতিষ্ঠান যে তথ্য সমারোহ রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাকে উপহার দেয় তা দিয়ে যেকোন দেশের গোপনীয়তার তারা বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। বিগ ডাটা থেকে পূর্বাভাসমুখী বিশ্লেষণ বের করার জন্য তাদের হাতে আছে গণিতবিদ ও কম্পিউটার প্রকৌশলীর বৃহত্তম বাহিনী। এইসব বিশ্লেষণকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করে তারা অন্য দেশের সমাজ ও রাজনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করে। ডিজিটাল দখলমুক্তির লক্ষ্য নিয়ে প্রাচ্যে গবেষণা-আলোচনা-পর্যালোচনা আরম্ভ হয়েছে জোরের সাথে। উল্লেখ্য যে দখলদার বিশ্ব এসবের পিছনেও যথেষ্ট বিনিয়োগ করছে; তাদের একাডেমিয়া, কাগজ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিচ্ছে। একে অবশ্য পশ্চিমের উদারতা ভাবলে ভুল হবে। তারা তাদের কুকীর্তি নিয়ে নথিবদ্ধ আলোচনা চায় যাতে করে তারা জায়গামতো উপস্থাপন করতে পারে। দখলদাররা কীভাবে আমাদের শুষে নিচ্ছে তা যত বিস্তার নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে ওদের বিনিয়োগকারী ও করদাতারা ততই সন্তুষ্ট হয়। অর্থাৎ আমরা আমাদের ক্ষতি বলে যত কাঁদব, ওরা ওদের লাভ জেনে তত তৃপ্তি পাবে। তবে বিকল্প প্রযুক্তির ব্যবহার, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের বিকেন্দ্রিকরণ, স্বচ্ছ-জনমুখী নীতিমালা প্রণয়ন, দখলদারবিরোধী আইন ও আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত ডিজিটাল মাধ্যম বিষয়ক দিকনির্দেশনাও এসকল জ্ঞানচর্চা থেকে উঠে আসছে। এটা ঠিক যে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বসে এই দখলদারিত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে চাওয়া কল্পনাবিলাস। কিন্তু দখলদার চিহ্নিত করতে পারা মুক্তির প্রথম ধাপ তো বটে।
এখানে প্রেম আর বিপ্লব একই সাথে আসে। একই পথে চুপিসারে পাশাপাশি হাঁটে। এখানে বোধহয় তারা সমার্থক...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন