এই গল্পের শুরুটা খুব পরিচিত। ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন যখন স্ট্যানফোর্ডের ছাত্র তখন তারা ‘গুগল’ নামের একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেন। সার্চ ইঞ্জিন, অর্থাৎ যেখানে আপনি কোনো বিষয়ে খোঁজ করলে, ইন্টারনেট সে বিষয়ে যা যা জানে তা আপনার সামনে হাজির হবে। গুগল নামের এই সার্চ ইঞ্জিনের অনানুষ্ঠানিক মূলমন্ত্র ছিল: “শয়তান হব না”। তরুণ ল্যারি ও সের্গেই দু’জনেই ছিলেন বিজ্ঞাপনের বিপক্ষে কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন এই নতুন দুনিয়া—ইন্টারনেট দুনিয়া—একে কলুষিত করবে বিজ্ঞাপন। একটি পরিচ্ছন্ন বিশ্বস্ত সার্চ ইঞ্জিন তারা আমাদের দিয়েছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, লক্ষ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে গুগল হয়ে উঠেছে ‘কানার লাঠি’-র মতো। এই অবস্থায় গুগলের বিনিয়োগকারীরা ল্যারি-সের্গেইয়ের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে লাগল এটাকে আরো বেশি অর্থকরী করে তোলার জন্য। ওনারা দেখলেন, গুগল থেকে বিপুল টাকা কামানোর যদি কোনো তড়িৎ উপায় না-পাওয়া যায়; তাহলে এত এত ব্যবহারকারী, এত ব্যবস্থাপনা, এত বিনিয়োগ সবকিছুর বোঝা নিয়ে গুগলের ভরাডুবি রক্ষা করা যাবে না। চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেল দুইজনের।
সমান্তরালে আরেকটা ঘটনা ঘটে যা আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকে বদলে দেয়। এটা খোদ ইন্টারনেট আবিষ্কারের চেয়ে কম বৈপ্লবিক নয়। আমরা প্রতিনিয়ত সার্চ ইঞ্জিনে যা খুঁজতাম, যেসব শব্দ ও শব্দগুচ্ছ আমরা ইনপুট দিতাম, আউটপুট আসার পর সেসব ইনপুট এক জায়গায় ফেলে দেয়া হোত। এই অনুসন্ধানগুলো সার্চ ইঞ্জিন প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজেই আসত না। এর নাম ছিল ‘ডিজিটাল উদ্বৃত্ত’। এটা এক রকম পুঁজ। এরকম লক্ষ লক্ষ লোক প্রতিদিন যে অসংখ্য শব্দ সার্চ ইঞ্জিনে প্রবেশ করাত পুরোটাই উদ্বৃত্ত বা পুঁজ হিসাবে পড়ে থাকত। খুব বেশি পরিমাণে জমে গেলে তা এক সময় ফেলে দেয়া হোত।
প্রযুক্তি দানবরা এক সময় আবিষ্কার করলেন, এই ছোট ছোট অনুসন্ধান থেকে আপনার সম্বন্ধে অকল্পনীয় পরিমাণে তথ্য জেনে ফেলা সম্ভব। যেমন, আপনি যখন সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজবেন “ভালো ছাতা কীভাবে চেনা যায়” তখন বোঝা যাবে আপনার পুরাতন ছাতা নষ্ট হয়েছে বা হারিয়ে গেছে এবং আপনি একটি নতুন ছাতা কিনতে চাচ্ছেন। আপনি যখন কোনো এন্টিবায়োটিক সম্বন্ধে খুঁজবেন তখন ধরে নেয়া যায় আপনি বা আপনার পরিচিত কারো অসুখ হয়েছে। যত বিশদে সার্চ করবেন তত বিশদে জানা যাবে আপনার কী ধরনের অসুখ হয়েছে, কতদিন ধরে আছে, কেমন বোধ করছেন ইত্যাদি। একইভাবে, আপনি যখন ট্যুরিস্ট স্পটের ছবি দেখতে চান, সহজ রেসিপি খোঁজেন, সেমি ডবল বিছানার দাম জানতে চান, বাচ্চাদের কান্না থামানোর উপায় জিজ্ঞাসা করেন কিংবা উপজেলা নির্বাচনের আপডেট চান—সবকিছু থেকে এন্তার এন্তার উপাত্ত তৈরি হয় যেগুলো দিয়ে আপনার চাহিদা-সামর্থ্য-বিশ্বাস-জীবনযাপন সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।
দেখা গেল, এতদিন যা ছাই ভেবে ফেলা দেয়া হচ্ছিল তার পুরোটাই অমূল্য রতন। কীভাবে, সেটা ধরতে পারলেন কী? এই তথ্যগুলো, যার মূল্য আপনার কাছে নাই, যা সার্চ ইঞ্জিনের তেমন কোনো কাজে আসবে না, সেসব যদি বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করা হয় তারা আপনাকে ‘টার্গেটেড’ বিজ্ঞাপন দেখাতে পারবে। অর্থাৎ, দৈনিক সংবাদপত্রের মতো আপামর জনসাধারণের জন্য ঢালাও বিজ্ঞাপন দেয়ার দিন শেষ। আপনার ছাতা দরকার হলে ছাতার, হেডফোন লাগলে হেডফোনের এবং বাসায় খাবার দরকার হলে খাবার ডেলিভারির বিজ্ঞাপন আপনাকে দেয়া হবে। ব্যস, টাকা কামানোর এমন এক ফন্দি এসে গেল গুগলের হাতে যা আগে কেউ চিন্তাও করে নি। পুঁজকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহারের এই চর্চা থেকে উদ্ভুত হলো নজরদারি পুঁজিতন্ত্র নামে এক ভয়াবহ বাজার ব্যবস্থার। ল্যারি-সের্গেই চেয়েছিলেন, এই অভিনব ব্যাপারটা যেন আর কেউ জানতে না-পারে। দীর্ঘ সময় গোপন রেখেও ছিলেন, কিন্তু বেশিদিন নয়।
কীভাবে নিলামে বিক্রি হচ্ছে আমার-আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা? আমাদের কালের কার্ল মার্ক্স খ্যাত সোশানা জুবফের বই “দি এজ অব সারভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম” (২০১৮) থেকে সর্বগ্রাসী এক নতুন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উত্থান ও দৌরাত্ম্যের গল্প
সেই থেকে শুরু হলো গুগলের নজরদারির অভ্যাস। আগে যেসব তথ্য তারা অনিচ্ছায় হাতে পেয়ে যেত, এখন সেসবই হয়ে গেল তাদের মূল লক্ষ্য। এবং তারা ডেটাবেজ তৈরি করল। যেখানে আপনার সার্চের ওপর ভিত্তি করে আপনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
এরপর তাদের মনে হলো কী: সার্চ ইঞ্জিন থেকে যেসব ওয়েবসাইটে আপনারা যাচ্ছেন, সেখানে যাওয়ার পর আপনারা কোথায় কোথায় ক্লিক করেন সেই তথ্যগুলো তো গুগলের হাতে আসছে না। তখন তারা তৈরি করল ব্রাউজার: গুগল ক্রোম। এরপর তাদের মনে হলো: মুঠোফোন ব্যবহারকারী বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পরিমাণ বেড়ে চলেছে এবং সেই তথ্যগুলো তাদের হাতের নাগালে নাই। তারা তৈরি করল: অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম। উপরন্তু বিনামূল্যে! এখন পর্যন্ত যতগুলো সেবার কথা বলেছি সবটাই বিনামূল্যে। এইভাবে যেই যেই খাতের উপাত্ত তাদের হাতছাড়া হয়েছে সেখানেই তারা একটা করে গুগল পণ্য এনেছে। ডক বলেন, ম্যাপ বলেন, নিউজ বলেন, ট্রান্সলেটর বলেন—সবকিছুই বিনামূল্য। আর তার কারণ একটাই এইসব পরিষেবা থেকে হাতানো কোটি কোটি গ্রাহকের তথ্য তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দিচ্ছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতার কাছে। এজন্য স্বল্পমূল্যে এমনকি বিনামূল্যেও তারা তাদের পণ্য দিতে রাজি।
আজকের দিনে এমন এক পর্যায়ে আমরা এসেছি যেখানে অনলাইন জীবনের কোনো চিপাচাপা নাই যেটা গুগলের নজরদারির বাইরে। আর এখন যখন অনলাইন-অফলাইন জীবনের সীমারেখা দিন-দিন ফিকে হয়ে আসছে তখন গুগলের নজরদারি নিয়ন্ত্রণে পরিণত হচ্ছে। এখানে বলে রাখা ভালো, এই তথ্য হাতিয়ে নেয়ার জন্য কিন্তু তারা আপনার অনুমতি ঠিকই নিচ্ছে। গুগলের যেকোন পণ্য ব্যবহার করার আগে আপনার সামনে যেই শর্তাবলী আসে—যেটা আপনি বা কোনো সাধারণ গ্রাহক কখনোই পড়বেন না—তার মধ্যে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উল্লেখ করা থাকে যে, তারা আপনার সুবিধার্থে আপনার গোপন তথ্য বাইরের তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে দিতে পারে। তা এখানে আপনার সুবিধাটা কী? আপনার ব্যবহার অভিজ্ঞতা উন্নত হবে। কীরকম উন্নত? আপনাকে তৃতীয় পক্ষ তাদের লক্ষ্য-নির্ধারিত বিজ্ঞাপন দেখাবে। এই হচ্ছে আপনার সুবিধা।
অনেকের কাছেই মনে হতে পারে, এই ব্যাপারটা ন্যায়সঙ্গত। যেহেতু আমরা প্রযুক্তি দানবের কাছে অসহায় সেহেতু আমরা কয়েক ধরনের যুক্তি সান্তনা হিসেবে নিজেদের শোনাই। প্রথমত বলি যে, বিনা পয়সায় এত ধরনের অপরিহার্য সেবা ব্যবহার করার কিছু তো মূল্য দিতে হবে। নাহলে গুগল এত বড় প্রতিষ্ঠান চালানোর অর্থ পাবে কোথায়? দ্বিতীয়ত বলি যে, আমরা এই ধরনের বিশিষ্ট বিজ্ঞাপন দেখতে চাই। আমাদের চাহিদামাফিক নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন দেখিয়ে গুগল আমাদের সুবিধা করে দিচ্ছে। তৃতীয়ত কেউ কেউ বলি যে, আমাদের লুকনোর কিছু নাই সুতরাং আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলেও কিছু নাই।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ইমেরিটাস অধ্যাপক সোশানা জুবফ এই সব কয়টি যুক্তিকে খণ্ডন করেন। তাঁর “নজরদারি পূঁজিতন্ত্র” মতবাদের উৎস একই নামের বই থেকে। আমরা শেষ থেকে শুরু করি তাহলে সবগুলো যুক্তির জবাব পাওয়া যাবে। শ্রীমতী সোশানা বলছেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার মানে কোনো কিছু লুকানো নয়। আপনাদের বোঝানোর সুবিধার্থে বলি, আপনার শরীর হয়তো লুকানোর মতো কিছু নয় কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনি নেংটু হয়ে সবখানে যাবেন। আপনি হয়তো খারাপ কোথাও যান না কিন্তু তার মানে এই নয় যে, অচেনা কেউ সর্বক্ষণ আপনার পেছন পেছন লেগে থাকবে। আমাদের বাথরুমে গান গাওয়া, ব্যক্তিগত হাসি-কৌতুক, আমাদের বোকা বোকা প্রশ্ন—এইসব কিছুই আমাদের গোপন রাখার অধিকার আছে। কেউ যদি এসব বিক্রি করে লাভবান হন তাহলে তাকে ‘না’ বলারও অধিকার থাকা উচিৎ।
একটা বাস্তব উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে নজরদারি পূঁজিতন্ত্র কী চেহারা নিয়েছে। এক মেয়ে সন্তানসম্ভবা। এই তথ্য কেবলমাত্র সে একাই জানতো। কিন্তু তার অনুসন্ধানের প্রবণতা দেখে গুগল নির্ভুল অনুমান করে ফেলে যে মেয়েটি মা হতে যাচ্ছে। হয়তো প্রেগন্যান্সি কিট খোঁজা, হয়তো বিভিন্ন প্রশ্ন, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গতিবিধি—নানাকিছু মিলিয়ে গুগলের অ্যালগরিদমের কিছুই জানতে বাকি থাকে না। আমরা যা কিছু খুঁজি সেটাই যে গুগল ট্র্যাক রাখে তা নয়, আমরা যেসব শব্দ অনুসন্ধান বক্সে লিখে আবার ডিলিট করে দেই সেসবও কিন্তু সে আত্মস্থ করে রাখে। যেটা দাঁড়াল, মেয়েটাকে তো গুগল প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছেই, মেয়ের বাবাকেও সে চমকে দিল নতুন আগন্তুকের জন্য ডায়পারের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে। বুঝুন অবস্থা। গুগল জানে কে আপনার বাবা, কে আপনার মা, কার সাথে কথা বলেন, আর কে কে আপনার ওয়াইফাই ব্যবহার করে। আপনি যখন অফলাইনে ফোন চালাচ্ছেন তখনো সে আপনার উপাত্ত সংরক্ষণ করে চলেছে। যেই না ইন্টারনেট সংযুক্ত করেন অমনি অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেম আপনার যাবতীয় খুঁটিনাটি কার্যকলাপ সুন্দর করে আপলোড দিয়ে দেয়।
যা আপনি কাউকে জানাতে প্রস্তুত নন, গুগল সেটা জেনে বসে আছে। শুধু জেনে বসে নাই, সেই তথ্য আপনার অগোচরে চোদ্দ জায়গায় বিক্রি করে বসে আছে।
ফেসবুকে একটা উক্তি ভেসে বেড়ায়: যেখানে কোনোকিছু বিনামূল্যে পাবেন বুঝে যাবেন আপনি নিজেই সেখানে পণ্য। এটা দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয়? এটা কি নেহাত একটা ভারিক্কি কথা?
নাকি সত্যিই প্রতিদিন বাজারে বিক্রি হচ্ছি আমরা?
আপনারা জানেন যে, পশ্চিমা বিশ্বে গুগল হোম নামের একটি যন্ত্র বেশ প্রচলিত। ওই যন্ত্র দ্বারা ঘরের তাপমাত্রা, নিরাপত্তা, সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদির ওপর গুগলের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এক প্রকৌশলী একবার আবিষ্কার করলেন যে গুগল সেই যন্ত্রের ভেতর সাউন্ড রেকর্ডার ঢুকিয়ে বিক্রি করে। এ নিয়ে তো তোলপাড় হয়ে গেল। বাসার ভেতরের শব্দ কেন গুগল রেকর্ড করবে,কাকে পাঠাবে? পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে গুগল স্রেফ বলল যে, উপস, দুঃখিত, আর হবে না। যেন তারা মনের ভুলে একটা করে সাউন্ড রেকর্ডার রেখে দিচ্ছিল মানুষের বাসায় বাসায়।
শুধু নজরদারিতেই গুগল সীমাবদ্ধ নয়। তারা মানুষের মতামত ও বিশ্বাসকেও প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। গুগলের হোম পেজ দেখুন: একদম পরিচ্ছন্ন, বেশিরভাগ সময়ই সাদা ফকফকা। দেখলে এমন একটা ভাব আসে যে, গুগল কোনো ব্যবসায়িক ফন্দি, হাবিজাবির ধার ধারে না। কিন্তু গুগলের যে সার্চ ফলাফল আসে তা কীসের ভিত্তিতে ক্রমবিন্যস্ত করা হয়? বেশিরভাগ মানুষ প্রথম পাতার পরে আর যানই না। কেন ১ নম্বর ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা ২, ৩, বা ১০ নম্বরের চেয়ে বেশি? ঘাটাতে গিয়ে দেখা গেছে গুগলের এই সাজানো ভীষণ পক্ষপাতদুষ্ট। অথচ মানুষ ধরে নেয় প্রথম যে ওয়েবসাইট এসেছে সেটাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এখানেই গুগলের স্বার্থ কাজ করে। তা নিয়ে পরবর্তী লেখায় আলোচনা করব।
শুধু অনুসন্ধান ফলাফল দিয়ে নয়, গুগল আমাদেরকে সার্চ সাজেশন দিয়েও বোকা বানায়। আপনি সার্চ বক্সে পুরো কথাটা লেখার আগেই গুগল অনেকগুলো পরামর্শ দেয় না? অনেকেই সেইসব পরামর্শ অনুযায়ী চালিত হয়ে যায়। এভাবেই গুগল তার উদ্দেশ্য হাসিল করে। সে চাইলে তার অপছন্দের গোষ্ঠীকে নিয়ে ইচ্ছামত পচা পচা সার্চ সাজেশন দেয়। মানুষ নেতিবাচক পরামর্শের দিকে বেশি ধাবিত হয় তাই সবাই সেসবে ক্লিক করে। উল্টোটা তারা করতে পারে পছন্দের গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, করছেও। গুটিকতক মানুষের বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে সার্চ ফলাফল ও পরামর্শ ফিল্টার করে আসছে তারা।
গুগল শুধু একা নয়, ফেসবুকও একই রকম উপায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি রেখে যাচ্ছে। ছবি, ভিডিও, লেখা, মেসেজ, লাইক-রিএকশন, যত রকম জায়গায় আপনি ক্লিক করছেন ফেসবুক সমস্ত তথ্য জড়ো করে রাখে। এটা শুধু তাকে বিজ্ঞাপন দিতেই সাহায্য করে না; আপনাকে চিনতে, আপনাকে বুঝতে, আপনার অতীত-বর্তমান দেখে ভবিষ্যৎ গতিবিধি পর্যন্ত হিসাব করে ফেলতে পারছে ফেসবুক। এমনকি সেই গতিবিধি ইচ্ছামতো বদলে দিতেও সক্ষম তারা। আপনাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে তারা সিদ্ধান্ত নেয় আপনাকে কী দেখাবে, কতটুকু দেখাবে, পৃথিবীর কোন দিকটার সাথে আপনাকে পরিচিত করাবে। ফেসবুকের পাশাপাশি অ্যামাজন, অ্যাপল, ডিজনি প্রভৃতি বড় বড় দানবও এই একই কাজে জড়িত। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো ফেসবুক আর গুগলের সমকক্ষ কেউ নাই।
আমরা যারা ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তারা গুগল-ফেসবুকের মূল ভোক্তা নই। তাদের আসল ক্লায়েন্ট হলো বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান। আমরা হলাম পণ্য। আমাদের ব্যবহারের কথা ভেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা তারা সংযুক্ত করে সেগুলো আসলে পশুখাদ্য গেলানোর মতো। আমরা যত গিলব, তত মোটাতাজা হব, তত তাদের লাভ। তারা সবসময় বলে এমন এক পৃথিবীর কথা যেখানে সবাই তাদের ছাতার তলে যুক্ত হবে। তারা বলে, একজন মানুষও যেন বিচ্ছিন্ন না-থাকে। মূলত তারা চায়, পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কেউই তাদের নজরদারির বাইরে থাকবে না।
পুঁজিবাদী বিশ্বে বসে এক সময় সোভিয়েত কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করেছিলেন জর্জ অরয়েল তার বিখ্যাত উপন্যাস “১৯৮৪” লিখে। সেই উপন্যাসের বিগ ব্রাদার সর্বক্ষণ সবকিছু দেখতেন ও শুনতেন, ইচ্ছামতো পরিবর্তন-পরিমার্জন করতেন তথ্য-উপাত্ত। সেই একই কাজ, যা বাস্তব পৃথিবীর কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসক কল্পনাও করতে পারেনি, আজ তা বাস্তবায়ন করছে নজরদারি পুঁজিতন্ত্রের পুঁজিপতিরা। সিলিকন ভ্যালির কয়েক মাইলের মধ্যে বসা কিছু লোক বিশ্বের কোটি কোটি গ্রাহকের বাসার ঠিকানা, জুতার মাপ, ঋতুচক্র থেকে প্রিয় তারকা, অপছন্দের ব্যক্তিত্ব, পছন্দের নির্বাচনী প্রার্থী সবকিছুরই খবর রাখছে। খবর রাখছে, যার-তার কাছে সেসব বিক্রি করছে এবং যখন মন চায় তখন বদলে দিচ্ছে সাধারণের পছন্দ-অপছন্দ। এছাড়াও বিরোধী মতকে ফিল্টার করা, একাউন্ট অবরোধ করা, নিষ্ক্রিয় করা, ডি-মনিটাইজ করা থেকে শুরু করে প্লাটফর্ম কেড়ে নেয়ার অভিযোগ তো আছেই। যেমন এই লেখাও প্রকাশ পাওয়ামাত্র নানারকম ডিজিটাল ব্যারিকেডের মুখে পড়বে। মুক্তবাক ও মুক্তচিন্তার বুলি আওড়ে তারা—অল্প কিছু মানুষ—পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কর্তৃত্ববাদীতে পরিণত হয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই যে তারা নিজেদের ভগবান মনে করে। আইনের ঊর্ধ্বে মনে করে।
এখন করণীয় কী? এটা সত্যি যে আমরা নেহাত দুর্বল, এটাও সত্যি যে প্রতিপক্ষের শক্তির সাথে আমাদের তুলনা হবে না। পুঁজিবাদের অহংকার যে, সে মানুষকে বংশানুক্রমিক দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। পুঁজিবাদ আমাদেরকে দিয়েছে বেছে নেয়ার স্বাধীনতা। কিন্তু কোন কোন বিকল্পের মাঝে বেছে নেয়া? কারখানায় নিম্ন মজুরিতে শোষণের শিকার না-হতে চাইলে বিকল্প অনাহারে মৃত্যু। এছাড়া বিকল্প কী আছে, শোষিত না-হতে চাইলে শোষক হতে হবে—-সেই রাস্তা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবসময়ই খোলা। সেই একই খেলা নজরদারি পুঁজিতন্ত্র খেলছে আমাদের সাথে। অবাধে যোগাযোগের সুযোগ চাইলে, বিচ্ছিন্নতা না-চাইলে আমাদেরকে বেছে নিতে হবে আত্মবিক্রয়। কিন্তু এরকম চলতে দেয়া যেতে পারে না। আমাদেরকে জিম্মি করে বড় বড় প্রতিষ্ঠান মুনাফার পাহাড় করতে পারে না। তাদের একচেটিয়া আধিপত্য রুখতে অবশ্যই সুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দিতে হবে এবং আরো বেশি জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে সবাইকে। এজন্য গণতন্ত্রের পূর্ণ চর্চার কোনো বিকল্প নাই।
আমরা সংখ্যাগুরু এবং গুগল, ফেসবুক, উবার এরা সবাই আমাদের ওপর নির্ভরশীল—এটাই প্রকৃত সত্য। গ্রাহক আছে বলেই তারা আছে। সুতরাং, আমাদের পূর্ণ অধিকার আছে তাদের সাথে দেনদরবার করার। এজন্যই অবাধ প্রতিযোগিতার কথা বলেছি। অন্যান্য বিকল্প উদ্যোগ থাকলে দুই-তিনটি কোম্পানি আর যাচ্ছেতাই করতে সাহস পাবে না। সচেতন মানুষ সবসময় বেহতর বিকল্প বেছে নিবে এবং দানবরা নিজেদের মুনাফার লোভকে সংযত রাখতে শিখবে। ভোক্তাদেরকে সংগঠিত হতে হবে—-একতাই বল—-রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে আমাদের সুবিধা বিবেচনায় এনে আইন তৈরি ও প্রয়োগে। এছাড়া ইন্টারনেটের ওপর সাধারণের কর্তৃত্ব আনা এবং সাইবার অবকাঠামোকে পুঁজির কবল থেকে মুক্ত করার দাবি তো আছেই।
ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালত রায় দিয়েছে যে: কোনো প্রতিষ্ঠান যদি গ্রাহকের তথ্য সঞ্চয় করে তবে অবশ্যই গ্রাহকের অধিকার আছে নিজের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য দেখতে চাওয়ার। কার কার কাছে এই তথ্য যাচ্ছে, কীভাবে সেই তথ্য ব্যবহার হচ্ছে সেটাও তারা প্রকাশ করতে বাধ্য থাকবে। শুধু তাই নয়, গ্রাহক যদি বলে, আপনারা আমার তথ্য কাউকে বিক্রি করবেন না, তবে প্রতিষ্ঠান সেটা করতে পারবে না।
সেদিন বেশি দেরি নাই যেদিন সাইবার যোগাযোগ হবে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার। এ নিয়ে যারা ব্যবসা করবে তারা অনেক বেশি স্বচ্ছ হতে বাধ্য হবে। ব্যবসা করতে গিয়ে কেউ সাধারণ গ্রাহককে বিক্রি করার সাহস পাবে না।
পুঁজিতন্ত্র ধ্বংস হোক। পৃথিবী জনগণতান্ত্রিক হোক। মহান সমাজতন্ত্র জীবন পাক। মানুষ ও মনুষ্যত্বের জয় হোক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন