বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর প্রথম যে কেসটা, তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে, আমরা ভূত ধরতে গাজীপুরের ওই রিসোর্টে যাই। চারশ বছর বয়সী এক দরবেশের ভূত। শুধু ধরতে না, ধরতে এবং সেই অভিযানের উপর ছবি বানাতে। যে রিসোর্টের কথা বলছি সেটা মালিকানা বদলে গত বছর থেকে আবার পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে; যে কারণে তার নামটা আমি প্রকাশ করতে পারছি না। রিসোর্টের বর্তমান সত্ত্বাধিকারী(গণ) আমাকে স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করেছেন: আকারে-ইঙ্গিতেও ওই রিসোর্টের পরিচয় প্রকাশ পেলে তারা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ওই অভিশপ্ত জায়গার কবল থেকে আমরা যারা মুক্তি পেয়েছি তারা নিজেদের প্রাণ রাখতে পেরেই সন্তুষ্ট। সেই আতঙ্কদায়ী অতীতকে আরো বেশি নাড়াচাড়া করে আরো বেশি জটিলতায়—বিশেষত আইনি জটিলতায়—পড়ার ইচ্ছা কারো নাই। কিন্তু আমাদের বায়োস্কোপ-ওঝা-অভিযাত্রী দলে একজন লেখক ছিল, আমি শ্রীমান। আর, লেখকদের সহজাত এক অভিশাপ থাকে: নিজেকে ব্যক্ত করার তাড়না। ফলে আমি যা দেখেছি, শুনেছি, অনুভব করেছি তাকে টাইপ না-করে থাকতে পারিনি। এরপর কয়েক দফা ইমেইল চালাচালি, এক দফা উকিল নোটিশ ও হলফনামা বিনিময়ের মাঝে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। বহুদিন ফেলে রেখে, বহু শর্তসাপেক্ষে, বহুনাম কাটাকুটি করে এই লেখা আমার ব্লগে প্রকাশের উপযুক্ত করেছি।
কেটে দেয়া নামগুলোর একটা ধরা যাক: বনচর, ইকো রিসোর্ট। আর বনচরের প্রয়াত মালিক ধনকুবের সুজা সাহেব। এক সময় রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ছিল। দেশের প্রথম সারির ধনীদের কেউ নন; জন পরিসরে খুব পরিচিতও নন। বয়স সেই সময় তিয়াত্তর বছর। আমি নির্ভুল জানি কারণ আমি ওনার আত্মজীবনীর গোস্ট রাইটার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। সেভাবে লেখা হয়নি কিছু, তবে খুচরা নোট যেসব নিয়েছিলাম সেসব আছে, আর কিছু ভয়েস রেকর্ড। সুজা সাহেবের স্ত্রী বিয়োগ হয়েছিল করোনার এক বছর আগে, আমি কেবল ছবিতে দেখেছি। পুত্রকন্যা সবাই প্রবাসে থিতু (যারা এখন বনচরের মালিক) এবং বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগ্রহী ছিল না কারোই। ফলে, নিকট বন্ধুর কাঁধে ব্যবসা সঁপে দিয়ে তিনি জীবনের সঞ্চয় নিয়ে বনচর তৈরি করেন। তা প্রায় এই ঘটনার দেড় বছর আগে।
বনচরের আওতায় শত হেক্টর জায়গা তো অনায়াসে হবে। আমি এই বিষয়ে লিখিত নথি কোথাও পাইনি। তবে গুগলের স্যাটেলাইট দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে এক বর্গকিলোমিটারের মতো বনভূমি দেখায়। জায়গাটা নেওয়া ছিল ফাউন্ডেশনের নামে। কীভাবে কী করেছিলেন, কতটুকু কেনা, কতটুকু ইজারা, সেখান থেকে কাকে কতটুকু বিক্রি করেছেন—সবিস্তার জানার মতো সময় তখন পাইনি, আর আমিও শুরুতেই এ নিয়ে উৎসাহ দেখাইনি। উনি যা বলেছেন সেটুকুই।
আমি তখন ছোটই। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গল্প-উপন্যাস লেখার মহা অলাভজনক বদভ্যাস ছেড়ে চলচ্চিত্রের জন্য লেখা ধরেছি। কাজটা আগের তুলনায় অর্থকরী তো বটেই, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো খাতিরদারি, যেখানেই অর্থের ঘাটতি সেখানেই আদর-যত্নের বাড়াবাড়ি দিয়ে পোষানো হোত। অন্যের পয়সায় সারাদেশ ঘোরাঘুরি, ব্যয়বহুল হোটেলে রাত্রিযাপন, তারকাদের সাথে মোলাকাত—নবিশ অবস্থাতেই এসব অভিজ্ঞতা হতে থাকে। বাঁধা চাকরি করিনা কারো। একসাথে হয়তো দশ জায়গায় মাথা বন্ধক দেয়া থাকে। লেখালেখি এমন এক কাজ, যার পিছনে নির্মাতাদের লগ্নি সবচেয়ে কম, কিন্তু কোথাও আটকে গেলে টাকা ঢেলে রক্ষা নাই। অন্য লেখক ধর। শুরু থেকে শুরু।
লেখালেখি ও সিনেমাই আমাকে নিয়ে যায় ওই প্রেত কবলিত রিসোর্টে। করোনার আগ দিয়ে আরো অনেক কাজের মধ্যে কুশলদাকে টুকটাক লেখালেখিতে সাহায্য করছিলাম। প্রয়াত চিত্রনির্মাতা, ইনি বাংলাদেশে সুপরিচিত, আসল নাম বলা যাচ্ছে না ওনারও। ওনার সাথে টাকার সম্পর্ক ছিল না। কুশলদা আমার সিনেমার গুরু। ডাক পড়লে দক্ষিণা দিতে হাজির হতাম, নিকেতনে, দাদার হোম অফিসে। ছবি নিয়ে গল্প, কিছু লেখা পড়ে দেয়া, বিনিময়ে খাওয়াতেন পিজ্জার সিঙারা, আর ফেরার সময় উবার করে দিতেন। কখনো কখনো লেখার কাজ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। যেহেতু অনুরোধের কাজ, আমি ফেলে রেখে রেখে করে দিতাম এক সময়। তাগাদা ছিল না।
একদিন ডেকে কুশলদা কথায় কথায় বললেন, “ভূত দেখবা? গাজীপুরে চল,” আমাকে ভ্রূ কোঁচকাতে দেখে আরেকটু খুললেন, “এক রিসোর্টের মালিক আমার খুব ক্লোজ। ঘন জঙ্গলের মধ্যখানে রিসোর্ট। অনেকদিন বলতেসেন যেতে। কাজের উসিলা ছাড়া তো যাওয়া হয় না। তো এক ভূতের ওপর ডকুমেন্টারি করতে আমার টিম নিয়ে যাচ্ছি। চল তুমিও।”
কুশলদার হাতে বিয়ারের ক্যানের দিকে চট করে তাকালাম। উনি মূলত বিজ্ঞাপন বানান। ডকুমেন্টারি করেন মাঝে মাঝে কিন্তু সেসবও বিভিন্ন সংস্থার ফরমায়েশে। উনি কাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস লোক। ভূতপ্রেত জাতীয় কোনো কিছুর প্রজেক্ট নিয়ে এর আগে কখনো আলাপ করতে শুনিনি। আর আমি, আমার নিজের এইসব হোক্স ভিডিওতে সামান্যতম আগ্রহ নাই, বললাম, “হঠাৎ?”
“তুমি যাবা নাকি আগে বল। বাকিটা পরে বলব তোমাকে বিস্তারিত।”
“কিন্তু সেখানে আমার কাজ ঠিক—”
“তোমার কাজ হচ্ছে রিলাক্স করা। শ্যুট করে ফেললে আমাকে স্ক্রিপ্টে সাহায্য করবা। পেমেন্ট নিতে হবে বলে রাখলাম। বাজেট ভালোই। আর তোমাকে দেখাতে চাই জায়গাটা, কারণ আছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ক্লাস-পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করোনার কারণে। শ্যুটিং-এ যতদিনই লাগুক আমি এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসব এমন সমঝোতা করলাম। আর বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করে খুলে দিলে একাই ফিরে আসব। কুশলদা বনচরের ফেসবুক পেজ থেকে আমাকে রিসোর্টের ছবি দেখালেন। “হোয়াট দা–” আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এটা বাংলাদেশের কোথাও। এত বড় জায়গা নিয়ে, এত সবুজের মধ্যে এরকম কটেজ—ঠিক যেন আঁকা ছবির মতো।
“করোনা পরিস্থিতি যদি খারাপ হয়ই,” কুশলদা বললেন, এর চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর আছে কি?”
বৃহস্পতিবার বিকালে দুইটা মাইক্রোবাস নিয়ে আমরা রওনা হলাম। কুশলদার মাইক্রোবাসে আমার আরেক শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ফুকো, সিনেমাটোগ্রাফার। আরেকজন ছিলেন সাউন্ড ডিজাইনার নাজমুল ভাই। সবার সামনের আসনে কুশলদার অ্যাসিস্ট্যান্ট ঊর্মি, সে আমার বয়সী। যাত্রাকালে সবাই করোনার আসন্ন প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কুশলদা গল্পগুজবে সাময়িক বিরতি দিয়ে আমাদের ভ্রমণের প্রেক্ষাপট মেলে ধরলেন। সুজা সাহেবের ব্যবসার পার্টনার ওনার প্রোডাকশন হাউজের ক্লায়েন্ট। ওনাদের রিয়েল এস্টেটের জন্য দাদা বেশ কিছু টিভিসির কাজ করে দিয়েছেন। সেই সূত্রে সুজা সাহেবের সাথে আলাপ এবং অচিরেই ঘনিষ্ঠতা। সুজা শিল্পসংস্কৃতির অনুরাগী। ওনার ইচ্ছা শর্ট ফিল্ম গোছের কিছুতে বিনিয়োগ করার। ফিকশন হোক বা নন-ফিকশন।
কুশলদা খোলাসা করেন, “তবে আমি যা বুঝসি, উনি চান ওনার রিসোর্টটা শ্যুটিং স্পট হিসাবে পরিচিতি পাক। দুই ডজনের কাছাকাছি ডুপ্লেক্স ওখানে, কিছু বিক্রি করসেন নিজেদের মধ্যে, কিছু সিজনে ভাড়া দ্যান, বাকি সব পড়ে আছে এমনি। আমাকে টানার জন্যই ভদ্রলোক বলসিলেন যে—এখানেই শ্যুট করার কত কী আছে, এমনকি জলজ্যান্ত ভূত পর্যন্ত আছে।”
যদি কুশলদা ওখানে টিম নিয়ে যান তাহলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তো আছেই সাথে যাবতীয় ভাড়া-পারিশ্রমিক সব উনি দিবেন। অর্থাৎ, উনি ডকুমেন্টারির প্রোডিউসার হতে চান। আর ভবিষ্যতের যেকোন কাজ নিয়ে আলোচনা করতে চান। কুশলদা বললেন, “আমি গত সপ্তাহে ঢাকা ফেরার পথে বনচরে নামসিলাম কিছুক্ষণের জন্য। শ্যুটিং স্পট হিসাবে দারুণ। আর আমাদেরও কাজের নামে স্ট্রেস রিলিফ হলো।”
কিন্তু এসব ভূত দেখা-টেখার অন্তরালে একটা বৃহৎ পরিকল্পনা ছিল ওনাদের। নাজমুল ভাই একটা ওয়েব সিরিজের জন্য স্পট খুঁজছেন। সেটাও হরর। এই ডকুমেন্টারি শ্যুটের নামে চলবে সেটার লোকেশন স্কাউটিং। এখানে আসে আমার ভূমিকা। সেই হরর ফিল্মের জন্য আমাকে প্লট সাজিয়ে দিতে হবে। ভূতের আস্তানায় রাত কাটিয়ে যদি কোনো গল্প মাথায় আসে—সেটাই আশা। আমি আমার মতো থাকব, শ্যুটে আমার কোনো কাজ নাই, ইচ্ছা হলে দেখব, নাহলে না।
ম্যাপ দেখে যেতে যেতে হঠাৎ হাইওয়ে থেকে নেমে গেল মাইক্রোবাস। এবড়োথেবড়ো মাটির রাস্তা। কুশলদা বাদে সবাই চমকে উঠলাম। ঊর্মি জানাল, ম্যাপে এটাই দেখাচ্ছে। কুশলদা হেসে সায় দিলেন, এটাই রাস্তা। একটার বেশি গাড়ি পাশাপাশি যাবার সু্যোগ নাই। পিছের মাইক্রোবাস আমাদের অনুসরণ করে আসতে লাগল। জলাশয়, মাঠ, তারপর হঠাৎ দুইধারে গাছপালা। রাস্তা একেবেঁকে চলে যাচ্ছে তার ভেতর দিয়ে। দুই ধারের জঙ্গল ঘন হতে লাগল। ঘন হতে হতে এক পর্যায়ে এমন হলো যে হেডলাইট ছাড়া আর আশেপাশে কিছু দেখা যায় না। নিজে গাড়ির ভেতর না-থাকলে আমি বিশ্বাসই করতাম না যে, এই সরু বনপথে কোনো মোটরযান চলাচল সম্ভব। একটাই রাস্তা ধরে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। হেডলাইটের আলোয় দেখলাম, গাছের গায়ে টাঙানো: বনচর ১। তার মানে বনচর ২ আছে এখানে কোথাও।
দূর-দূরান্তে কোনো স্থাপনা নাই। পথে নাই সড়কবাতি। চাঁদও আলো দিচ্ছিল না। ফলে হেডলাইটের মোচকাকৃতির আলোর বাইরে সবটাই নিকষ কালো। জঙ্গলের একটা নিজস্ব শব্দ আছে। ঘুমঘোর পাখি, পোকা, পেঁচার সাথে বাতাস আর মর্মরের ঐকতান। মাঝেমাঝে গাছপালার মধ্যে দিয়ে কিছু সরসর করে চলে যাওয়ার আওয়াজ পাই। পরে দিনের বেলা বের হয়েছিলাম জঙ্গল দেখতে: কী যে শান্তি। অথচ অন্ধকার ঘন জঙ্গল—সকলের ভেতর কিনা জানিনা তবে—আমার মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক প্রবৃত্তিজাত এক ভয়কে জাগিয়ে তুলছিল।
চলতে চলতে আবার দুই ধারে গাছপালা ফিকে হয়ে এল। ছোট রাস্তা এসে জুড়ল একটা চার গুণ চওড়া রাস্তায়। যে রাস্তার শেষ মাথায় দেখা যাচ্ছে মস্ত তারজালের বেড়া দিয়ে ঘেরা মানবসৃষ্ট আঙিনা। মাইক্রোবাস এসে থামল সেই দুই মানুষ উঁচু বেড়ার সামনে। হলিউড ছবিতে যেমন দেখা যায়, সেরকম দুইটা সাইন টাঙানো তারজালের গায়ে। একটায় বিপদ সঙ্কেতের নিচে লেখা: সংরক্ষিত এলাকা - অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ নিষেধ। আরেকটায় কুকুরের সিল্যুয়েটের নিচে লেখা: কুকুর হইতে সাবধান। সীমানার ভিতরে মাটি ক্রমশ উঁচু, যেখান থেকে খানিক দূরে বাংলো বাড়ির মতো দেখা যাচ্ছে। আর নিচে মাঠ। মাঠের সীমানা ঘেঁষে আবারও টিলা, যেখানে শালবনের ঘন অন্ধকার দেখা যায়। বুঝলাম, শুষ্ক পরিখায় মত রিসোর্টের চারদিকের মাটি কেটে নিচু করা হয়েছে।
দুইবার হর্ন চাপতেই জলপাই রঙের পোশাক পরা দুইজন লোক বের হয়ে এল। আমরা আসব জানানো ছিল। তালা খুলে তারের গেট টেনে সরিয়ে দিল। একজনের হাতে টর্চ। আরেকজনের কাঁধে ঝুলছে বন্দুক। মাইক্রোবাস তাদের পাশ দিয়ে যেতে থাকলে জানালা দিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তাদের গায়ে জ্যাকেট চাপানো। মার্চের এই গরমে জ্যাকেট! গাড়ি চলতে চলতে দেখলাম কিছুদূর পর পর সমরূপী সুইশ ডুপ্লেক্স। প্রতিটার সামনে মাঠ, বাগান, নুড়ি ছড়ানো আঁকাবাঁকা পথ। শেষ মাথায় যে বাড়িটা, অন্যদের চেয়ে আলাদা, একটু বড়, সেটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুজা সাহেব হাত নাড়ছেন।
ওনার সাথে মোলাকাত করে আমরা পাশের কটেজে চলে আসলাম। আর কারো সাথে দেখা হলো না কারণ এখানে নাকি সবাই নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা যদিও খেয়ে এসেছি, কেয়ারটেকার দেখাল ডুপ্লেক্সের নিচতলায় রান্নাঘর, চুলা, ফ্রিজ, ওভেন, ডাইনিং টেবিল সবই আছে। শোবার ঘর আছে তিনটা যেখানে আমাদের দল ভাগ ভাগ হয়ে আস্তানা গাড়ল। ওপর তলায় আমি আর নাজমুল ভাই এক ঘরে। কুশলদার সাথে ফুকো ভাই। ঊর্মি আর মেক আপের জলি আপু এক সাথে। প্রতিটা ঘরের দুইটা করে দরজা। একটা দিয়ে বের হলে সিঁড়ির সামনে করিডরে, আরেকটা নিয়ে যায় বড় বারান্দায়।
এক ঘণ্টা যেতেই বুঝলাম কী ভীষণ ঠাণ্ডা এখানে। আমাকে বারবার শীতের কাপড় আনতে বলা সত্ত্বেও পরোয়া করিনি। কেয়ারটেকার বদি দেখিয়ে দিল একটা কাঠের আলমারিতে বাড়তি কাপড় ভাঁজ করা আছে। সোয়েটার, জ্যাকেট, টিশার্ট সব। আর বের করে দিলেন স্লিপিং ব্যাগ। কারণ রাতে নাকি এত ঠাণ্ডা পড়বে যে কম্বলে কাজ হবে না। ঘরের ভেতর, খাটের ওপর কেউ স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে ঘুমায় আমার জানা ছিল না। তবুও এইবার আমি ওনাকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করলাম এবং গিজারের জলে মুখ হাত ধুয়ে লক্ষী ছেলের মতো শুয়ে পড়লাম। আমার সঙ্গীরা বারান্দায় হুল্লোড় করে অনেক রাত অবধি মদ-গাঁজা টানল। আমার একটাই নেশা, সেটা হলো ঘুমের। নাজমুল ভাইয়ের খালি স্লিপিং ব্যাগ পাশে রেখে আমি একাকী ঘুমিয়ে গেলাম।
অল্পক্ষণ হয়তো ঘুমিয়েছি একটু পরেই চমকে উঠে ঘুম ভাঙল। অনেকগুলো নেকড়ের ডাক দূর থেকে ভেসে আসছে। সে কী রক্ত হিম করা চিৎকার। আমি স্লিপিং ব্যাগের চেইন খুলে খানিকটা উঠে বসি। দেখলাম নাজমুল ভাই ঘরে ঢুকছেন। আমাকে দেখে হেসে বললেন, “ঘুমায় গেছিলে নাকি? শিয়াল ডাকতেসে। অদ্ভুত না? অনেকদিন পর এত শিয়ালকে একসাথে ডাকতে শুনলাম।”
আমিও শুনেছি শেয়ালের ডাক আগে। কিন্তু এতজনকে একসাথে ডাকতে শুনিনি। ডাকাডাকি থামল একটু পর। আবার শুয়ে পড়লাম। পাশে শুনলাম নাজমুল ভাই খচমচ শব্দ করে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকছেন। কিছুক্ষণ পর ঘুম চলে আসলো আগের মতো।
পরদিন সকালে আমি যখন উঠলাম তখন শ্যুটিং পার্টি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি খানিকক্ষণ খালি পায়ে দোড়ালাম। রোদ উঠেছে এবং ঠাণ্ডা পুরোপুরি কেটে গেছে। অথচ রাতে শিশির পড়েছিল বোঝা যাচ্ছে কারণ মাঠের ঘাস ভেজা। আশেপাশের কটেজগুলোয় অনেকেই উঠে গেছে। পিছনের বাড়ির মাঠে চেয়ার পেতে একজন বয়স্ক লোক কফি খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন: গুড মর্নিং। অত দূর থেকেও এত মৃদু স্বরে বলা কথা আমার কানে আসায় আমি অবাক। আমি অভ্যাসবশত চেঁচিয়ে বললাম, গুড মর্নিং! তারপর লজ্জিত হলাম। চারদিকে এত সুনশান। আশেপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো যানবাহন, কলকারখানা, নির্মাণাধীন ভবন কিচ্ছু নাই। ভদ্রলোকের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ হলো।
ঘরে ফিরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে সুজা সাহেবের বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। উনি দেখি নাশতার টেবিলে। দীর্ঘদেহী তরুণ চেহারা ওনার। কোনভাবেই ৫০ এর বেশি মনে হয় না। আমি জানালাম যে আমার সাঙ্গপাঙ্গ কখন উঠবে তার ঠিক নাই। সুতরাং আমরা খেতে বসে যেতেই পারি। সুজা সাহেব ঘাড় বেঁকিয়ে বললেন, “আমার এখানে বহু গেস্ট আসছে-যাচ্ছে, আমার ওসব ফরমালিটিজ নাই।”
সাথে সাথেই ঊর্মি ফিটফাট হয়ে হাজির। সেও বসে পড়ল। ডিম ভাজি, সবজি, পরোটা। এক আদিবাসী রান্নার লোক আছে, শচীন, তার করা। আলাপে আলাপে সুজা ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা হলো। আমার ব্যাপারে শুনলেন: কী করা হয়, কই থাকা হয় ইত্যাদি। ভদ্রলোক প্রচুর বই পড়েছেন জীবনে। ওনার জানাশোনার পরিধি দেখে আমি আবারও অবাক। একদিকে উপনিষদের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন, আরেকদিকে টরেন্ট সাইটে সর্বশেষ কী ছবি পাওয়া যাচ্ছে সেই নিয়েও কথা বলছেন। সেই টেবিলেই মূলত সুজা ভাই আমাকে প্রস্তাব দিলেন ওনার আত্মজীবনী দেখে দিতে। ওনার লেখালেখির অভ্যাস একেবারেই নাই। পারিশ্রমিকের কথা বলাতে আমি বুঝলাম যে উনি গোস্ট রাইটার চাচ্ছেন।
ঊর্মি ভূতের কথা জিজ্ঞাসা করতে সুজা ভাই হেসে বললেন, “সবাই আসুক, তারপর বলব।”
সকলের নাশতা ঘরে ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ঊর্মি এর মধ্যে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড জোগাড় করে ফেলেছে। খুবই দ্রুতগতির ইন্টারনেট। প্রতিটা কটেজেই নাকি রাউটার লাগানো। আমার এটুকুই চাহিদা। ল্যাপটপ সাথে এনেছি। যেমন পরিবেশ, চুটিয়ে লেখালেখি করতে পারব।
আমি ঘরে ফিরে এসে একটু গড়াচ্ছিলাম। নাজমুল ভাই বারান্দায় বসে খাওয়া সারছেন কুশলদার সাথে। ঊর্মি বেড়িয়েছে সমগ্র এলাকার সবার সাথে পরিচিত হতে। এর মাঝে বদি এসে বলে গেল, খাওয়া শেষে সুজা ভাই সবাইকে ডাকছেন। আমি আরেকটু গড়িয়ে নিয়ে বড় ভাইদের সাথে রওনা দিলাম পাশের কটেজে। ক’টা বাজে না-বাজে কোনো হুঁশ নাই আমার। পরে যে কয়দিন ছিলাম দিন-তারিখও মনে রাখতে পারিনি।
সবাই উঠলাম সুজা ভাইয়ের বারান্দায়। চারদিক খোলা বিশাল বারান্দা। মাঝে মাঝে পিলার। উল্টাপাশে আরেকটা তুলনামূলক ছোট বারান্দা আছে। সেটা ছাদযুক্ত। সব বাড়িরই নকশা মোটামুটি এক। এই বাড়িটা আয়তনে বাকিগুলোর দ্বিগুণ, এই যা। সুজা ভাই দোলনায় বসে ছিলেন। পায়ের কাছে ডক্টর জিঞ্জার, ওনার বিড়াল। চা-সিগারেটের পালা চলছিল। চা আমি খাই মাঝেমধ্যে। সুজা ভাই এখানে কত বিচিত্র লোক আসে তার গল্প করছিলেন। গল্প চলে গেল উনি দেশ-বিদেশ দেখার অভিজ্ঞতায়। আবার ফিরে এল এই রিসোর্ট তৈরির অভিজ্ঞতায়। উনি একাই বক্তা। আমাদের মধ্যে যারা বয়েসে বড় তারাও মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে সুজা ভাই বললেন, “এত বিক্ষিপ্ত আলোচনা করলে আসল কথাই বলা হবে না। একটা অদ্ভুত ফেনোমেনন আছে এই জায়গার। কেউ যদি এর ব্যাখ্যা দিতে পার আমি তাকে আমার বন্দুক চালাতে দিব। আমি তোমাদের একটা স্বপ্নের কথা বলব। এই স্বপ্ন প্রথম দেখে তারিন, ওর আসার কথা বিকালে। স্বপ্নটা এরকম: শালবনের ভেতর সে হারিয়ে গেছে। হঠাৎ গাছপালার ভিতর থেকে সাদা আলখাল্লা পরা একজন বের হয়ে এল। তার চুল শাদা, ইয়া লম্বা দাড়িও ধবধবা শাদা। তার মুখে ছড়ানো হাসি। সে কাছে এসে কথা বলে কিন্তু তার মুখ নড়ে না। কথা শোনা যায় মাথার ভিতর। কী কথা সেটা আর তারিনের মনে নাই। তো, এই হলো স্বপ্ন। মজার ব্যাপার হলো, ও আমাকে স্বপ্নটা বলার পর একই স্বপ্ন আমিও দেখি। আমাকেও ওই লোক মুখ না-নাড়ায় কিছু বলে, কিন্তু কী যে বলে তা আর মনে নাই। শুধু বাড়তি মনে আছে যে লোকটা হাওয়ার ওপর ভাসছিল। যাই হোক, এখানেই শেষ না ঘটনা। আসল রহস্য এখানে যে, মোটামুটি যাকেই এই স্বপ্নের কথা আমি বলসি সে-ই এক বা দুই রাতের মধ্যে স্বপ্নটা দেখসে।”
সুজা ভাইয়ের মুখ হাসি হাসি। চোখে দুষ্টামির ভাব। আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। কেউ একজন বলল, “তাহলে তো আমাদেরও এই স্বপ্ন দেখার কথা।”
“একদম বিট বাই বিট,” সুজা ভাই দোলনা দোলাতে দোলাতে বললেন, অলমোস্ট প্রত্যেকেই দেখবা।”
আমার কাছে ব্যাপারটা রহস্যজনক লাগল না। খুব খেলো লাগল। কারণ একই পরিবেশে থাকাকালীন একই রকম স্বপ্ন দেখা খুবই সাধারণ ঘটনা। বিশেষ করে যেহেতু এই পরিবেশ সবার জন্য অন্যরকম। তার উপর আগাম আলোচনা করে রাখলে তো কথাই নাই। আমি এই মুহূর্তেই ব্যাখ্যা দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু একে তো বন্দুক চালানোর বিশেষ লোভ নাই আমার আর তার ওপর এখানে এত অগ্রজের মাঝখানে পণ্ডিতি করতে চাই না। তবে ফুকো ভাই আমার মনের কথাটাই বললেন, “ভাই এটা তো খুব কমন। আমাদের অনেকেরই এরকম অভিজ্ঞতা থাকার কথা। একদিকে এরকম পরিবেশ আবার তার উপর আপনি তো আগে থেকে বলে ম্যানিপুলেট করে দিচ্ছেন। এই স্বপ্ন দেখতে অনেকে বাধ্য হবে। আর যারা কাছাকাছি টাইপের কিছু দেখবে তারাও ঘুম থেকে উঠে আপনার মতোই বর্ণনা দিবে। ফেনোমেনাল ঠিক আছে এটা কিন্তু মিস্টিক কিছু বলতে পারতেসি না ভাই।”
অনেকেই সায় দিল। কিন্তু সুজা ভাই আগের মতোই দুষ্টামির হাসি হাসেন, “আগে রাতটা কাটাও না বৎস। তারপর নাহয় সবাইকেই বন্দুক চালাতে দিব, যদি সবাই মনে কর তোমরা রহস্যের সমাধান করে ফেলস।”
জলি আপু আমাদের সবচেয়ে সিনিয়র। উনি সিগারেট খান না। শলাকার ভেতর গাঁজা ভরে খান। সুজা ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে তা-ই খাচ্ছিলেন। আপু বললেন, “না বাপু আমি এসব অদ্ভুত স্বপ্নও দেখতে চাই না, বন্দুক-টন্দুকও চালাতে চাই না।”
সবাই হাসলাম। কুশলদা ওই আরবান মিথের কথা মনে করালেন যখন একজন লোককে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ স্বপ্নে দেখছিল। নানারকম আলোচনা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে নেটিজেনরা মেতে ওঠে। পরে জানা যায় পুরোটাই হোক্স, বানোয়াট। আরেকটা যে প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরছিল সেটাও ফুকো ভাই করলেন, “তা এই সাদা আলখাল্লাই কি ওই দরবেশ? মানে যার ভূত এখানে দেখা যায়—”
সুজা ভাই কাঁধ ঝাঁকালেন: উনি জানেন না।
“আপনি দেখেছেন ভূত?” কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল।
“ন্যাহ, আমি ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করিনা, আর বিশ্বাস না-করলে নাকি ওরা দেখা দেয় না। তবে অনেকেই দেখসে এখানে। তারিন দেখসে। শচীন দেখসে। ওইদিকের কটেজগুলায় অনেকে দেখসে। তোমাদের কপাল ভালো থাকলে তোমরাও দেখবা।”
“আমাদের মধ্যেও কেউ ভূতে বিশ্বাস করে না,” কুশলদা বলছিলেন। কিন্তু সাথে সাথে জলি আপু হাত তুলে বসে থাকলেন। আমরা হাসলাম। নাজমুল ভাই কথা কম বলেন, শোনেন বেশি, উনি গম্ভীরভাবে হাত তুললেন। আমি ঊর্মির দিকে তাকালাম। ঊর্মি পাল্টা চোখ রাঙাল আমাকে। সুজা ভাই সেটা দেখে ফেললেন, “কী ঊর্মি, তোমার ভূতের ভয় আছে নাকি?”
“বিশ্বাস করি না কিন্তু খুব ভয় পাই।”
“এহে দুই ভীতু এক ঘরে ঘুমাচ্ছে নাকি!” কুশলদার কথায় আবার হাসলাম সবাই।
আমাদের খাবার সময় হয়ে গেল। সুজা ভাই জানালেন, ভূতের ইতিবৃত্ত বলবেন এই বারান্দায় সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে।
আমরা যার যার ঘরে ফিরে স্নান-টান সারলাম। এবার খাওয়া হলো যার যার কটেজের ডাইনিং টেবিলে। শচীনদা আর ওনার বউ মিলে রান্না করেন। রান্না বেশ ভালোই। খাওয়ার পর সবাই বের হলো আশেপাশে দেখতে। আমি সকালে যেহেতু খানিকটা দেখেছি তাই আরামে ঘুমিয়ে নিলাম। ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে সবার সাথে গেলাম সুজা ভাইয়ের দরবারে। তখন বিকাল শেষ হয়ে আসছে। থেকে থেকে মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস দেয়া শুরু করেছে।
সুজা ভাই এবার ভূতের বিবরণ দিলেন।
এই জায়গা ছিল পুরোটা ঘন জঙ্গল। বছর চারেক আগে ভাই সিদ্ধান্ত নেন উনি ঢাকা শহরে থাকবেন না। তখন থেকে এখানে একটু একটু করে জায়গা নেয়া শুরু করেন। আগেই বলেছি, কী উপায়ে কিনেছেন, কার থেকে কিনেছেন এগুলো আমার কাছে তখনো ধোঁয়াশা ছিল, এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। তবে এটা ঠিক বনভূমি বলে বিবেচিত না। এটা পড়ছে একটা গ্রামের মধ্যে। গ্রামের নামটা বলা যাচ্ছে না কেন তা তো বলেছিই। এখান থেকে আরেকটু দূরে আছে বনচর-২, সেটাও এরকমই রিসোর্ট, ওনার ব্যবসায়িক পার্টনারের। এখানে কটেজগুলো কিছু বিক্রি করা, কিছু ভাড়া দেয়া। সব কাছের মানুষজনের কেনা। মালিকরা মাঝে মাঝে আসে, কিছুদিন থেকে যায়। মতিউর সাহেব, ওনার বন্ধু, সামনের একটা কটেজ নিয়ে ওনার মতোই স্থায়ীভাবে আছেন (যে ভদ্রলোককে আমি কফি খেতে দেখেছিলাম)।
প্রথমে যখন এখানে আবাস করার কথা ভাবেন তখন পরিচিত সবাই নিরুৎসাহিত করে সুজা ভাইকে। শেয়াল, সাপখোপ এসবের মধ্যে থাকা। গ্রামে ছিল ৫-৬টা পরিবার। তারা কেউই আর থাকে না এখন এখানে। সবকিছু বেচে দিয়েছে বনচর ফাউন্ডেশনের কাছে। তো প্রথম প্রথম যখন এখানে কাটাকাটি চলছে, পাশের গ্রামের মানুষ নাকি ভয় দেখাত পীর সাহেবের। পীর সাহেবের নাম দিলাম শরীফ খাঁ। কেউ কেউ কেন তাকে দরবেশ বলে কে জানে। কেউ বলে, চারশ বছর, কেউ বলে আটশ বছর আগে উনি আশেপাশের গ্রামে ধর্মপ্রচার করতে এসেছিলেন। কিছু জঙ্গল পরিষ্কার করে উনি নিজের আবাস বানান এখানে। কিছু মুরিদ ধর্মান্তরিত হয়ে এখানে পরিবার নিয়ে ঘরও তোলে। তো পীর সাহেবের হাত ধরেই এই বনগ্রামের উৎপত্তি। এখন জঙ্গল কাটতে গিয়ে নাকি ওনার সাথে স্থানীয় দেবদেবীদের একটা ঝগড়া বেঁধে যায়। দেবদেবী নানারকম মড়ক-টড়ক দিয়ে তাকে নাজেহাল করার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। পারে না পীর সাহেবের অলৌকিক ক্ষমতার কারণে। উনি জ্বিন ডাকতে পারতেন। জ্বিনদের দিয়ে উনি গ্রামকে বেঁধে দেন।
হঠাৎ এক সময় পীরের হয় অকাল মৃত্যু। কেউ বলে দেবতার কোপে। কেউ বলে বদ জ্বিনের হাতে। গ্রামবাসী তো আতঙ্কিত এখন কে বাঁচাবে তাদের।
“তারপর থেকে পীর সাহেব ভূত হয়ে গ্রামবাসীকে পাহারা দেন,” ফুকো ভাই বলেন সুজা ভাইকে শেষ করতে না-দিয়ে। ভাবলাম গল্প-কথক বিরক্ত হন কিনা। কিন্তু উনি হেসে ফেললেন, “একদম ঠিক। সেই চিরায়ত কাহিনী আরকি।”
সন্ধ্যা নেমে গেছে। নিচ থেকে চানাচুর আর মুড়ি মাখার গামলা আসলো। আরেক দফা চা দিতে বলা হলো, আমাকে বাদে, আমি একবেলা চা খাই সর্বোচ্চ। মুড়ি মাখায় হাত ঢুকালাম।
“পীর সাহেবের ভয়টা কী দেখাত আসলে তারা?”
“ঠিক নাই। কেউ বলে পীর সাহেবের কবর আশেপাশে কোথাও, পীর সাহেব গোস্যা হবেন। কেউ বলে তাকে দেখলে অসুখবিসুখ করে। বেশিরভাগই বলে ক্ষতি কিছু নাই তবে ভূত নিয়ে থাকার যে অস্বস্তি আরকি, মাঝে মাঝে দেখা-টেখা দিবেন। অনেকে ভয় পেতে পারেন।”
জলি আপু জিজ্ঞাসা করলেন এমন পীরের কথা জানা যায় কিনা ইতিহাসে।
সুজা ভাই আবার কাঁধ ঝাঁকালেন স্বভাবমতো, “কী জানি। এই অঞ্চলের ইতিহাস খুব কম জানা যায় এমনিতেই। গাজীপুরের নাম কোথা থেকে আসলো তাই নিয়েই নানা মতভেদ। তবে এই এলাকা নিঃসন্দেহ প্রাচীন, অশোকের স্তম্ভ যেহেতু আছে।”
“তাছাড়া পীর তো কতই আছে,” কুশলদা যোগ করেন, “আর কাহিনীও সব এক। দেশের যেখানেই যাবেন শুনবেন। পীরের সাথে দেবদেবতার দ্বন্দ্ব, তারপর নানামুখী সমাধান। কী হিন্দু পুরাণ, কী ইসলামী ধারণা, কী লোকবিশ্বাস—সব মিলেমিশে একাকার।”
প্রথমে মাটি কাটা শ্রমিকরা পীর সাহেবকে দেখা শুরু করে। সন্ধ্যা হলেই সাদা আলখাল্লা পরে, সাদা ঘোড়ায় চড়ে টগবগ করে চলছেন। কখনো ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছেন চারদিকে। মাঠেই দেখা যায় বেশিরভাগ সময়।
“আর চাঁদনী রাতে দেখা যায় এই এখানে,” সুজা ভাই হাত ইশারা করে সামনের বাগানে দেখালেন। সবাই চমকে উঠেছিলাম একটুক্ষণের জন্য। হাসি পেল বোকার মতো চমকেছি বলে।
সুজা ভাই আবার পুরাতন কথায় ফিরে গেলেন। সেই চার বছর আগে। শ্রমিকরা সূর্যাস্তের পর আর কেউ কিছুতেই থাকবে না। বিকাল হতেই তাড়াহুড়া করে চলে যায়। মাটি কাটার কাজ শেষ হলে যখন রাজমিস্ত্রীরা আসলো তখন গ্রামের লোকের এই তল্লাটে আসা নিষেধ। কারণ একটাই, ভূতের কথা যেন না-ছড়ায়। তা কী আর গোপন থাকে। মিস্ত্রীরা বড় রাস্তার ওপর এক হোটেলে খেতে যায়। সেখান থেকে শুনে আসলো। অমনি শাদা আলখাল্লা দেখার হিড়িক পড়ে গেল। কথা ছিল, মিস্ত্রীরা এখানে থেকে কাজ করবে। রাতে তাঁবুতে থাকবে দরকার হলে পরিবার নিয়ে। কিন্তু কেউই আর রাজি না। সুজা ভাইয়ের মাথায় হাত, এক বছরের কাজ সেক্ষেত্রে আড়াই বছর লেগে যাবে। পরে এক স্থানীয় বৃদ্ধ বলল যে, সাথে আগুন রাখলে নাকি পীর সাহেব কাছে আসেন না। তখন থেকে সবাই সাথে করে দেশলাই নিয়ে চলাচল শুরু করল। ঘুমানোর সময় মাঝখানে আগুন জ্বেলে চারদিকে তাঁবু খাটিয়ে শোওয়া।
“তবে আমি অনেকদিন পুরা এলাকায় একা ছিলাম। মাটিয়ালরা সবাই চলে যেত বাসায়। তাঁবুতে একা একা কত রাত কাটাইসি। সাথে একটা বন্দুক।”
“কী সাহস আপনার!” জলি আপু বললেন।
“সাহসের জন্য বলছি না। আমি কখনো পীর সাহেবকে দেখলাম না তাই বলছি।”
“রাতে আগুন জ্বালাতেন না?” স্বল্পবাক নাজমুল ভাইয়ের প্রশ্ন।
“হ্যাঁ জ্বালাতাম, নাহলে শিয়ালের পাল আসবে যে। ওহ, বলতেস আগুন জ্বালাতাম জন্য ভূত আসেনি! হাহা। তাই হবে হয়তো।”
এবার আসলাম কাজের কথায়। আমি ভেবেছিলাম স্রেফ ভূতদর্শীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ডকুমেন্টারি হবে। কারণ দরবেশ বাবা আসবেন আমাদের ক্যামেরার সামনে আর পোজ দিবেন এমন আশা করা বৃথা। কিন্তু সুজা ভাই জানালেন যে ওনার এক অনুজ বন্ধুর পরিচিত গোস্ট হান্টিং টিম আছে। সেই টিমের মানুষ এসে উপস্থিত হবে আগামীকাল। তারা যদি আগামীকাল থেকেই কাজ শুরু করে তাহলে নাকি জমবে। ভাই বললেন, “আমার এখানে থাকে ইমরান, সেই ইমরানের সূত্রে পরিচয় ওদের সাথে। গোস্ট হান্টার কাম এক্সরসিস্ট। নাক সিটকাইও না আগেই। ওরা মডার্ন ওঝা কিন্তু ওদের মতো স্কেপ্টিক মানুষ আমি আর দুইটা দেখি নাই। অলৌকিক ঘটনা স্বীকার যা-করে, তার চেয়ে নাকচ করে বেশি। আসুক। তারপর বাকিটা বুঝবা।”
আমি এইসব ডিবাংকিং টিম ইউটিউবে দেখেছি। বাংলাদেশে এমন আছে জানা ছিল না। এদিকে আমাদের কথাই ছিল একদিন বিশ্রাম নিয়ে পরদিন থেকে শ্যুট করার। সুজা ভাই কাজের ব্যাপারে তাড়াহুড়া পছন্দ করেন না। সুতরাং প্রথম দিন এভাবে গল্পে গল্পে কেটে গেল। সন্ধ্যায় একবার শেয়াল ডেকেছিল আগের মতোই। সুজা ভাই বলেছিলেন ওরা নাকি প্রতি প্রহরে ডাকে। আমার মিলিয়ে দেখা হয়নি। কয়েকবার ডাকে এটা মনে আছে।
রাতে ফিরে এসে কিছুক্ষণ কাজ করলাম। তারপর ঘুমিয়ে গেলাম। স্বপ্ন দেখিনি কোনো।
কিন্তু আমি বাদে সকলেই দেখল।
পরদিন সকালে প্রথমেই এটা নিয়ে একটা শোরগোল পড়ে গেল। কে দেখেছে, কে দেখেনি। আমার রুমমেট নাজমুল ভাই দেখেছেন। প্রত্যেকেই দেখেছেন আমি ছাড়া। সবার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমিও দেখেছি কিন্তু মনে নাই। দেখলাম, সবার মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না গতকাল যারা এত হালকাভাবে নিচ্ছিল ব্যাপারটা তারা এখন সিরিয়াস কেন। কোনমতে খেয়েদেয়ে সবাই সুজা ভাইয়ের কাছে হাজির। উনি আগের থেকেই হাসছেন।
“তোমার পরনে কী ছিল স্বপ্নের ভেতর?” সুজা ভাইয়ের জিজ্ঞাসা ফুকো ভাই বসতে বসতেই।
“কিচ্ছু না, নাথিং, আই ওয়াজ নেকেড টপ টু বটম।”
“শুধু তাই?”
ফুকো ভাইকে পুরো গম্ভীর দেখাচ্ছে। থুতনিতে হাত। কুশলদা প্রথমে নাজমুল ভাইয়ের দিকে তাকালেন। তারপর সুজা ভাইকে বললেন, “গায়ে টাটকা রক্ত লেগে ছিল।”
“তোমাদেরও তাই?”
আমি বাদে সকলেই মাথা নাড়ল। মেয়েরাও একইভাবে নিজেদের দেখেছে। আমাদের দলের কারিগরি সহায়তাকারী যারা ছিল, গতকাল যারা শুনেছে স্বপ্নের কথা, কেউই বাদ যায়নি।
“এত চিন্তিত কেন ভাই? এটা স্রেফ স্বপ্নই তো। আরো দুই-একবার দেখতে পার। তাতে কারো ঘুমের সমস্যা হয় না। হইলে আমাকে জানাইও, ব্যবস্থা আছে,” সুজা ভাই সবাইকে হালকা করার চেষ্টা করলেন, “এখন বল এর ব্যাখ্যা কে দিবা?”
ভাই গতকাল ইচ্ছা করে আমাদের থেকে একটা তথ্য গোপন রেখেছেন। স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্নে নিজেকে পুরো নগ্ন দেখে। আর গায়ে লেগে থাকে রক্ত। এই কথাটা তানিয়া নামের মেয়েটা চেপে গিয়েছিল সুজা ভাইকে প্রথমবার বলার সময়। ভাই যখন স্বপ্নটা দেখেন তখন নিজেকে রক্তাক্ত গায়ে বিনা পোশাকে দেখেন। পরদিন তানিয়া স্বীকার করে যে সে নগ্নতার কথা কাউকে প্রথমে বলেনি। সুজা ভাই এরপর থেকে এই ছোট্ট এক্সপেরিমেন্টটা করেন সবার সাথে।
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন