দিন ২৮০
ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সভামধ্যে সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনাদের জন্য দিন-নাই রাত-নাই জন্তু জানোয়ারের মতো খাটাখাটনি করে শরিলের রক্ত পানি করতেসি। তাও আপনাদের কারো কারো চক্ষের বিষ হইলাম। আমি রাতে ঘুমাই না। লতিফরে জিগান, রাত জাইগা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আপনাদের জন্য দোয়া করি। আর আপনাদের ভাবে মনে হয় যেন আমি আপনাদের শত্রু। মনে হয়, ওই চুন্নীটাই আপনাদের জন্য ভালো ছিল।’
এই পর্যন্ত বলে সে একটু থামে। সভার মধ্যে নীরবতা। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা আরেকটু ঘনালো। বুলবুল জিলানি বা কেউ একজন ছাদের সব বাতি জ্বেলে দেয়। আমরা জানি, এখন সুফিয়া তার বাবার কথা বলা শুরু করবে। বলবে, এই বাড়ি তোলার সময় কীভাবে ঠিকাদারি নিয়ে মারামারি করে তার মহান পিতা প্রাণ হারিয়েছে। তারপর, পৃথিবীতে আমরা ছাড়া তার কেউ নাই এই বলে পরের দফা বিশ্রীভাবে কাঁদতে শুরু করবে। সভাপতি বদরে আলির বউ মিসেস বদরে আলি জান্নাতারা সেই কান্না দেখে একটু পরপর আঁচলে চোখ মুছবেন। আমরা যারা সুফিয়াকে সহ্য করতে পারি না, সুফিয়ার কান্নাও আমাদের কানে অসহনীয় ঠেকে। উঠে যেতে পারি না, জিলানিরা পাহারা বসিয়ে রেখেছে। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে সাদ্দাম। হয় এখন যেতে বাধা দিবে নয়তো চেহারা দেখে রাখবে। যে উদ্দেশ্যে সভা ডাকা হয়েছিল পুরাটাই ভণ্ডুল। কেউ একটাবার এই প্রশ্ন করছে না যে, মালিক সমিতির সভায় সুফিয়া কী করছেটা কী।
সুফিয়া মালিক না, প্রতিনিধি না, ভাড়াটিয়াও না।
সে কাজের বুয়া।
দিন ৬৭
মেইন গেটে হাত লাগাতেই রে রে করে ছুটে এল মস্ত সান্ত্রী। জব্বর কাশেম ভালো রকম ভড়কে গেলেন। সান্ত্রী জলদি হাতে গেট চেপে ধরে, ‘কই যান?’
জব্বর কাশেম নিতান্তই নিরীহ লোক। অন্য কোনো বাসিন্দা হলে সান্ত্রীর এমন প্রশ্নে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত। উনি কোনমতে খেই খুঁজে পেয়ে পালটা জিজ্ঞাসা করলেন, কেন বাবা? বাজারে যাই!
যদিও তাঁর হাতে বাজারের ব্যাগ দৃশ্যমান। অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, বাজারে ছাড়া এই বেলায় কোথায় আর যাবেন।
‘না-’ সান্ত্রী চোখ বন্ধ করে দুই দিকে জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘যাবেন না।’
‘অ্যাঁ? যাব না?’
মস্ত সান্ত্রী দ্বিতীয়বার একইরকমভাবে দুইদিকে তার মস্ত মাথা নাড়ল। এবারে কোনো শব্দ ছাড়া।
‘কী বলো বাবা আমি তো বুঝতে পারতেছি না তোমার কথা।’
‘বাজারে যাওয়া লাগবে না আপনার। এই বাড়ির কেউ আজকে থেকে বাজারে যাবে না। নতুন নিয়ম।’ জব্বর কাশেমকে চশমার ওপর দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সান্ত্রী নিজে থেকেই যোগ করে, ‘আপার নিয়ম। মতি ভাই সকালে বলে গেছেন।’
‘আপা?’
‘সুফিয়া আপা।’
‘বুঝলাম না, কোন সুফিয়া? বুয়া?’
সান্ত্রী উত্তরে বলল, গেট থেকে সরে দাঁড়ান আঙ্কেল। সরে কথা বলেন। আর বাজারের ব্যাগ আমার কাছে দ্যান।
জব্বর কাশেম বাধ্য বালকের মতো নির্দেশ মানলেন। এখনো তার বিস্ময়ের ঘোর কাটে নাই। কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রায় বিড়বিড় করে বললেন, কিন্তু… কেন?
সান্ত্রী বেশ বিরক্ত হয় এই প্রশ্নে। গলা হাঁকিয়ে ধ্বনিমধ্যে অনাবশ্যক বিরতি দিয়ে বলে, ক-রো-না!
‘অ, তাহলে বাজার…’
‘বাজার ফ্ল্যাটে পৌঁছায় যাবে। মোখলেস বাজার করবে।’
‘কে মোখলেস?’
‘আপার লোক। আপা আনসেন। সে এখন থেকে সবার বাজার করে দিবে। বাসায় যান।’
দিন ১২৪
ফেসবুকে আমরা গোপন গ্রুপ খুললাম। সুপ্তিদি নাম দিলেন ‘বিশৃঙ্খলা’। বেছে বেছে মানুষ যুক্ত করলাম গ্রুপে। মুরব্বিদের কাউকে নেয়া যাবে না। মুরব্বিরা না বুঝেই বেশি কথা বলবে। তাদের কায়দা করে যুক্ত রাখতে হবে।
আমাদের প্রথম লক্ষ্য, সুফিয়া বুয়াকে উচ্ছেদ করে ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা। বুয়ার অত্যাচার, বিশেষ করে কোভিড পরিস্থিতিতে তার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের যথেচ্ছাচারে আজকের যে সংকট সেটা সবার সামনে তুলে ধরা। পাশাপাশি নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। গ্রুপে আমাদের সব কাজের আপডেট থাকবে। আবার, বুয়াদের যেসব কীর্তি-কলাপ সর্বসম্মুখে আসে না সেসব এখান থেকে ফাঁস হবে।
দুই মাস হলো আমাদের মোবাইল ডাটা খরচ করে নেট চালাতে হচ্ছে। বুয়ার ছেলে ফেলুর হাত দিয়ে বাসার সব বিল যায় এখন। ইন্টারনেট সার্ভিসের ওদেরকে কম টাকা দেয় নাকি ওদের সাথে কী আঁতাত করেছে কে জানে। দিনে রাতে কখনোই সংযোগ পাওয়া যায় না। সবার চাঁদা তুলে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট একই সরবরাহকারীর কাছ থেকে ইন্টারনেট নেয় এখন। মহল্লায় এত ভালো ভালো কোম্পানি থাকতে বাধ্য হয়ে ওদের দুই নম্বর সংযোগ ব্যবহার করছি দশ গুণ দামে। হুবহু একই অবস্থা ডিশ সংযোগের। কিছু করার নাই।
‘বিশৃঙ্খলা’-য় আমার দায়িত্ব পড়ল, বুয়ার বিরুদ্ধে বাসায় বাসায় গোপনে প্রচারপত্র বিলি করা। আমি হাতে লিখে প্রচারপত্র বানানো শুরু করলাম। এই সমস্ত কিছু লিখব সেখানে।
দিন ২৯
ছয় তলার শেফালি বেগম মাসের বেতন হাতে দিয়ে বললেন, সুফিয়া তোমার কাজ ভালো না। সমানে ফাঁকি দাও। তোমারে কতবার বলসি তাও যে কি সেই। আর দুইদিন দেখব। এরকম দেখলে আগামী মাস থেকে তোমার আর আসা লাগবে না।
‘আমি না আসলে কারে দিয়ে কাজ করাবেন?’
‘সেটা আমি দেখব।’
‘এই করোনার মধ্যে লোক পাবেন?’
‘না পাইলে নাই। তোমার পিছনে এতগুলি টাকা ঢালব কেন। আর সি ফাইভে ময়নার মা কাজ করে, শুনসি ভালোই, তোমার চেয়ে কম নেয় বেতন।’
বুয়া ফুঁসে ওঠে, ‘নিবে না? ময়নার মা তো চুরি করে।’
‘বললেই হলো! চুরি করে তো রাখসে কেন তারে?’
‘কেন রাখসে সেটা জানেন না? এক বিল্ডিং-এ পাঁচ খান ঠিকা পাইসে। কেমনে পায় আমি সব জানি। ওরে একদিন ধরতে পারলে…’
এই বুয়ার কাজের চেয়ে কথা বেশি। শেফালি বেগমের এত কথা ভালো লাগে না, ‘তোমার সেই নিয়ে মাথা ঘামানো লাগবে না। তুমি নিজের কাজ ঠিকমতো করো বাবা। নাহলে সামনের মাস থেকে তোমার ছুটি।’
দিন ৩০০
বাবলুদের ফ্ল্যাটে কান্নাকাটি। ফ্ল্যাটের দরজায় গোবিন্দ দাঁড়িয়ে। আমাদের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। সমিতির চাঁদা লোপাট করার অভিযোগে বুলবুল জিলানিকে খেদিয়েছে বুয়া। তার জায়গায় দেশের বাড়ি থেকে এনে চাকরি দিয়েছে বিশালদেহী গোবিন্দকে।
সম্ভবত বাবলুর আব্বার কিছু হয়েছে। বাবলু ফেসবুকে বলেছিল যে, ওদের ধারণা তাঁর করোনা হয়েছে। কিছুদিন আগে ওদের ভাড়াটিয়া তবারক খান করোনায় মারা গেলেন। সুফিয়া কাউকে টেস্ট করতে যেতে দেয় না। টেস্ট করতে গেলে নাকি বিল্ডিং-এ করোনা আসবে। অথচ অন্য কোনো প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মানার নাম নাই। এখন আঙ্কেলকে হাসপাতালে নেয়া দরকার হতে পারে। কে শোনে কার কথা।
‘বললাম তো, আমরা দেখতেছি। ডাক্তার আসতেছেন। উপরতলার সাদ্দাম সব ব্যবস্থা করতেছে। তোমরা যাও এখন। ঝামেলা কইর না।’
সাদ্দাম কেন, কীভাবে, কিসের ব্যবস্থা করবে বুঝলাম না। ও একটা বাচ্চা ছেলে, স্কুলে পড়ে। বুয়া ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে সাদ্দামসহ কয়েক ফ্ল্যাটের বিচ্ছুরা একেবারে বেপরোয়া হয়ে গেছে। ইচ্ছামতো বাইরে যায়-আসে। সারাদিন হইচই দাপাদাপি। সিঁড়ি দিয়ে দল বেঁধে ওঠে আর গলা ফাটিয়ে ঘন ঘন স্লোগান দেয় ‘সুফিয়া আম্মা সুফিয়া আম্মা, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ!’ ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে তারা চাঁদাবাজি করছে, এমনকি নিজেদের মা-বাপের থেকেও!
এদিকে বাবলুর বড় ভাই টুটুলও এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ। কখন বাসা থেকে বেরিয়েছে কেউ বলতে পারে না। তিনজনের জায়গায় নিচে এখন তেরজন সান্ত্রী রেখেছে বুয়া। কেউ নাকি জানে না টুটুল কোথায় গেছে, কখন গেছে।
ডাক্তার কোথায়। সাদ্দাম কোথায়। আমাদের তাড়ানো গেল না। সিঁড়ির ওপর বসে পড়লাম কয়েকজন। ডাক্তার আসে না, আসে না। ভিতর থেকে অনবরত বাবলুর মা-বোনের কান্নার শব্দ আসে।
দিন ৫৫
জয়নাল স্যারের ড্রয়িং রুমে চা খেতে খেতে দারোগা বাবু আমাদের কথা শুনে খুব একচোট হাসলেন, ‘বলেন কী, কাজের বুয়া আপনাদের জিম্মি করে রেখেছে - সেটা আবার কেমন!’
আমরা কেউই হাসলাম না। স্যার বিষয়টা আরেকবার ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাখ্যা করলেন। ব্যাপার এই যে, আমাদের এক ফ্ল্যাটে প্রায় মাস দুই আগে সুফিয়া নামের এক মধ্যবয়স্কাকে ঠিকা বুয়ার কাজ দেয়া হয়। কিছুদিন পর সে সিঁড়ি মোছার বুয়াকে হটিয়ে গায়ের জোরে সেই কাজটাও আদায় করে। এরকম করতে করতে এখন নিজেকে নিজে ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার ঘোষণা করেছে।
জয়নাল স্যারকে থামিয়ে দারোগা চোখ বড় বড় করে বললেন, নিজেকে নিজে ঘোষণা করে মানে! এ হয় নাকি। সে কি পিএম নাকি যে…
‘আমাদের সভাপতি তাকে নিয়োগ দিয়েছে আরকি।’
‘মালিক সমিতির সভাপতি? তো তাহলে তো হলোই।’
স্যারের বউ মাথা নাড়লেন, ‘আপনি জানেন না, বাধ্য হয়ে নিয়োগ দিয়েছে। বদরে আলি লোকটা অথর্ব। তাকে চালায় তার বউ। আমাদের ওপর শোধ নিতে সুফিয়াকে কাজ দিয়েছে। সুফিয়া কেয়ারটেকার হয় কীভাবে? সে একটা বকলম ছোটলোক…’
‘থামেন থামেন। আমার মাথা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই সব ফয়সালা করতে কেউ পুলিশ ডাকে? আপনারা শিক্ষিত লোক, আপনাদের কি কোনো বিবেচনা বোধ নাই? লক ডাউন পাহারা দিতে দিতে আমাদের হয়রান অবস্থা। তার মধ্যে আপনারা কাজের বুয়া সঙ্ক্রান্ত ঝামেলা নিয়ে…’
‘এসব বাদ দ্যান তাহলে। আরো ব্যাপার আছে-’ সুপ্তিদি মাস্কের ভিতর থেকে মুখ খোলেন, ‘অন্য বাড়ির ঠিকা বুয়া ময়নার মাকে সে মেরে খোঁড়া করে দিয়েছে। ভাঙা পা নিয়ে ময়নার মা এখন বস্তিতে পড়ে আছে।’
দারোগা বাবু এবার একটু গম্ভীর হয়ে কী যেন চিন্তা করলেন। সবার মুখের ওপর নজর বুলিয়ে বললেন, ‘সিওর আপনারা?’
উপস্থিত সবাই সাক্ষ্য দিলাম।
‘তাহলে তো সিরিয়াস ব্যাপার। আর কেউ আহত হয়েছে?’
‘এখন পর্যন্ত না। তবে যেকোন সময় হতে পারি এই ভয়ে আছি।’
দারোগা উঠে দাঁড়ালেন, ‘এখন কোথায় পাব সুফিয়াকে?’
সুফিয়া বুয়ার সাথে ওনার কী কথা, কী আঁতাত হয় জানিনা। তবে সেদিনের পর থেকে আমরা পুলিশের কাছ থেকে আর কোনো দিশা পাইনি।
দিন ১১১
সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। গোলাপদের বাসায় দুই দিন ধরে গ্যাস নাই, রান্না বন্ধ। সিলিন্ডার ভরতে বুলবুল জিলানিকে টাকা দিয়েছিল। সে নানান অজুহাত দেয়। এতদিনে সবাই বুয়ার কর্তৃত্ব একরকম মেনে নিয়েছে। তার কাছে ধর্না দেয়া হলো।
বুয়ার তাণ্ডবে জব্বর কাশেমদের ভাড়াটিয়া এই করোনার মধ্যে বাড়িছাড়া হয়েছে। বুয়া আজকাল ওই বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকে। যদিও সে সারাক্ষণই বলত, তার পৃথিবীতে কেউ নাই, এখন কোথা থেকে বেশুমার স্বজন জুটছে কে জানে।
গোলাপ আর গোলাপের বউ যেয়ে বুয়ার দরবারে নালিশ করল বুলবুল জিলানির নামে। সুফিয়া খোশ মেজাজেই বসে ছিল চৌকির উপর। আজকাল চশমাও পরছে। অনাবাসী ফ্ল্যাট মালিক সাবান সাহেব তার সমস্ত আসবাবের জোগান দিয়েছেন।
সব শুনে বুয়া উলটা গোলাপের উপর রেগে গেল, ‘গ্যাস নাই তো দুইদিন ধৈর্য ধরতে পারেন না? আপনাদের কি না খাওয়ায় রাখসি?’
‘না মানে-’
‘কিসের “না মানে”? আমি তো সবই শুনসি। লতিফের বউ রান্না করতেছে সেখান থেকে প্রতি বেলায় আপনাদের দেয়। চাওনের শেষ নাই আপনাদের তাই না? জানেন না এখন কীরকম অবস্থা চলতেছে? আরো দুই তিন ফ্যালাটের গ্যাস শেষ হোক। একবারে আনাব সিলিন্ডার। আমিই তো মানা করসি। কী ভাবসেন, আপনার টাকা ও খায়া ফেলসে?’
‘না না…’
‘যত্তসব। শোনেন, এই পুরা বিল্ডিং-এ ফ্লোর কয়টা, কয়টা মানুষ থাকে, জানেন কিছু? সবার খবর আমার একলার রাখা লাগে। আসছে নালিশ নিয়ে…’
দিন ৭০
এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ একজন আরেকজনের চেয়ে বড় ডাকাত। এর-ওর কাছে তদবির করতে করতে শেষমেশ কর্তার কর্তা সামি সাহেবের কাছেও একই ঝাড়া বুলি শুনলাম, ‘মদন বাবু তো আপনাদের প্রতিবেশী। উনি থাকতে আমার কাছে কেন এসেছেন। আমি এতদূর থেকে কী করব। ফিরে যান। আমি মদন বাবুকে বলে দিচ্ছি যেন একটা সুরাহা করেন।’
মদন বাবু কাউন্সিলর। এই পাড়া ওনার নিয়ন্ত্রণে। শুরুতেই ওনার কাছে গিয়েছিলাম। লাভ হয়নি। শেষে সামি সাহেবের চাপে পড়ে একদিন লোকজন নিয়ে সরেজমিনে এলেন। সব দেখেশুনে বললেন যে, ফিরে যেয়ে সমাধান করবেন।
মাঝে ওনাকে কয়েকদিন দেখা গেছে কিন্তু সমাধান দেখা যায়নি। আজকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, সুফিয়া তার মেয়ের মতো। জোর করে বুয়ার দায়িত্ব ধরে রাখাটা তার অন্যায় হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সুফিয়া ছাড়া আমাদের বিকল্প নাই।
মদন বাবু সম্পর্কে সুপ্তিদির জ্যাঠা হন। দিদির পরিবার তার সাথে আলাদা করে দেখা করে আমাদের যাবতীয় সমস্যার কথা বলে এসেছেন। জ্যাঠা স্রেফ বলেছেন, ‘তোদের এত সমস্যা হলে তোরা আমার এখানে উঠে আয় না!’
দিন ৫৪
ভাড়াটিয়া মাওলানা তবারক খান কোনো কথাই কানে নেন না। মাস্ক তো পরেনই না, ইচ্ছামতো বাইরে যান, হাত স্যানিটাইজ করেন না আর না। গ্যারাজে কি সিঁড়িঘরে, যার তার দরজার সামনে থুতু ফেলেন। এখন অবধি কোনো ওয়াক্তেই মসজিদে যাওয়া বাদ দেন নাই। পুরা রমজান মাস মুখ না ঢেকে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে এসে চাঁদা তুলেছেন। ঘাম আর আতরের গন্ধ মিশে শরীর থেকে এমন একটা বদবু আসে। আমরা বলি, উনি শৌচ না-করে সারা গায়ে আতর লাগান।
ওনার এই যখন-তখন বাড়ি বয়ে আসার আমরা প্রতিবাদ করলাম। একগাদা থুতু ছিটাতে ছিটাতে উনি বললেন, যারা নামাজ পড়বে না তাদের এই ভাইরাস হবে।
ভালো যে উনি স্বীকার করছেন ভাইরাসের অস্তিত্ব। প্রথম এক মাস বলতে শুনেছি, এরকম কোনো কিছুর অস্তিত্ব নাই। করোনার মধ্যে তাবলিগের কাজ শুরু করেছেন। কারণ দুর্যোগের সময়তেই ওপরওয়ালাকে বেশি বেশি ডাকতে হবে। এক সপ্তাহ ধরে ওনার বাসায় সময়-অসময়ে লোকজন জড়ো হচ্ছে।
সন্ধ্যায় বদরে আলির কাছে নালিশ করতে গিয়ে জানা গেল, জান্নাতারা বেগম খোদ তবারক খানের বউয়ের মজলিশে মোনাজাত ধরে বসে আছেন। দুই-তিন ফ্ল্যাটের লোককে বলতে গিয়ে গালি শুনলাম, যাদের ভয় বেশি তাদের করোনা বেশি ধরে।
‘তাবলিগ পছন্দ না-হলে যাবা না, তাহলেই হয়। মানুষের সৎ কর্মে বাধা দেয়া কেন।’
দিন ২৭৩
বুয়া দেখলাম ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। খুবই অবাক করা একটা দৃশ্য। আমাদের দেখে ময়লা এক পাশে সরিয়ে রাখল। লতিফ আমাদের বসতে বলে। বসার সময় নাই। আমার বাপ এসেছেন তাঁর ছোট ভাইয়ের নামে মামলা তুলে নেয়ার অনুরোধ করতে। গত সপ্তাহে আমার ফারুক চাচার নামে নারী নির্যাতনের মামলা দিয়েছে বুয়ার মেয়ে ডলি। মামলায় এক ডজন সাক্ষী, সব এই বিল্ডিংএর বাসিন্দা। চাচা আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন। সেই থেকে পালিয়ে আছেন। বাসায় ফিরতে পারছেন না।
‘মামলা তোলে কেমনে আবার। যান, কোর্টে ফয়সালা হবে।’
আব্বা আজকে খালি হাতে ফিরবেন না। আদালতে এই মামলায় জয়ের কোনো সম্ভাবনা নাই। এই দুঃসময়ে আমরা একটা ভালো উকিল কোথায় পাব। চাচার শরীর ভালো না। জেল হাজতে থেকে একবার আক্রান্ত হলে তাকে বাঁচানো যাবে না। চাচী নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। উনি পারলে বুয়ার পায়ে ধরেন।
বুয়া এই মাত্র ঝাড়ু দেয়া মেঝেতে পানের পিক ফেলল, ‘কেন, আমার কাছে আসছেন কেন। আপনাদের তো কাজের লোক দরকার নাই। আপনেরা নিজেরাই নিজেদের ফ্যালাটের দেখভাল করতে পারেন। এখন নিজেরা নিজেরা মামলা সামলান।’
আব্বুসহ আমার পুরা পরিবার কথা দিল, আর কোনোদিন সুফিয়ার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ উচ্চারণ করবে না কেউ।
‘সুখে থাকলে আপনাদের ভূতে কিলায়। কতবার বলসি, ঝামেলা করবেন না। ভালো না লাগলে আশেপাশে আরো অনেক বাড়ি আছে, উঠে যাবেন, আমরা সাহায্য করব। খামোখা হাঙ্গামা করে বিল্ডিংএর মানুষের শান্তি নষ্ট করেন কিসের জন্য। আপনারা কয়টা ইউনিটের লোকই ঘুরেফিরে এইসব অশান্তি করেন, আমি দেখসি। আর কেউ তো কিছু বলে না।’ উনি লতিফের দিকে হাত বাড়ালেন, ‘এই দেখি কাগজগুলা কই রাখসিলি দে তো।’
লতিফ কিছু কাগজ ধরিয়ে দিল বুয়ার হাতে। তারপর বুয়ার অসমাপ্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মে হাত লাগাল। বুয়া নিজে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার আব্বুকে দেখতে দিল কাগজগুলি। এটা আমার হাতে লেখা প্রচারপত্র। দুইদিন আগে সাদ্দামরা বাসায় বাসায় গিয়ে সবার হাতের লেখা মিলিয়েছে। আমার ঘরেও এসেছিল। আমার টেবিলের খাতাপত্র উল্টেছে। কোনো মিল পায়নি লেখায়।
‘ছালামত সাহেব, আমি লেখাপড়া পারি না। এগুলায় কী লেখা পড়ে শোনান আমারে। আপনার ছ্যামড়াটা কই? ওই যে, ও না? আসো আসো বাবু। ওরে দ্যান, ও পড়ে শোনাক।’
আব্বু নীরবে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার বাসার অন্যরাও নিশ্চুপ। চাচী ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন