বিশ্লেষণ: চলচ্চিত্র সম্পাদনা
চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সম্পাদনা। একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেমাটিক ফলাফল সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দৃশ্য, শব্দ, ও স্পেশাল এফেক্টসের মতো উপাদানসমূহকে যে সম্মিলিত কৌশল দ্বারা সমন্বয় করা হয় তাকে বলে সম্পাদনা।
আখ্যান
ফরাসি চলচ্চিত্র ‘আমেলি’-র গল্প বলার জন্য ছবির নির্মাতারা বিচিত্র ধরনের সম্পাদনা কৌশল অবলম্বন করেছেন। ছবির মূল আখ্যানের বড় অংশ জুড়েই অবিচ্ছেদ সম্পাদনা ব্যবহার হয়েছে। আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণে শটের সাথে শট জোড়া দেয়ার জন্য এটিই সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। চলচ্চিত্র জুড়ে শটের মসৃণ ও যুক্তিসঙ্গত প্রবাহ তৈরি করতে অবিচ্ছেদ সম্পাদনা ব্যবহার করা হয়। এতে করে আখ্যানভাগ একটি রৈখিক অবস্থানে থেকে একই নির্দিষ্ট দিকে বয়ে চলে। অপরদিকে, বিচ্ছিন্নতা সম্পাদনা দিক, গতি, বা স্থানের পরিবর্তন করে কাহিনী প্রবাহের মাঝে একটা ব্যাবর্তন নিয়ে আসে। এই পরিবর্তন হয়ে থাকে আচমকা এবং কদাচ যুক্তিহীন। ‘আমেলি’ যদিও সম্পাদনার ক্ষেত্রে কিছু পরিমাণে বিচ্ছিন্নতা দেখিয়েছে। যেমন, শুরুর দিকের দৃশ্যে যখন কথক কেন্দ্রীয় চরিত্রদের পছন্দ-অপছন্দের সাথে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেয়, এর মধ্যে কিছু পছন্দ দেখানো হয় সাদাকালো জাম্প কাটের মাধ্যমে। বেশ কিছু মন্তাজের ক্ষেত্রেও ধারবাহিকতায় ছেদ দেখা যায়। যেমন, কতজন যুগল ওই মুহূর্তে রতিসুখ উপভোগ করছে সেই কল্পনা, অথবা টিভি পর্দায় নাম-চরিত্রের দুঃখজনক ভবিতব্য দেখার সময়, অথবা যখন জড়বস্তুরা নড়চড়ে কথা বলতে শুরু করে সেইসব দৃশ্য। অবিচ্ছেদ সম্পাদনা মূলত যেখানে পুরোটাই একাংশ; সেখানে পূর্বোক্ত বিচ্ছিন্নতা দর্শকের মনোযোগ কাহিনীর পরিবর্তে নিজের দিকে টেনে ধরে। এটি নির্মাতাকে প্রচলিত চলচ্চিত্র রীতির বাইরে গিয়ে সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু উত্থাপন করতে দেয়।
ছন্দ
নির্মাতারা নির্মাণকালীন অথবা নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে যুক্ত করা শব্দ ব্যবহার করে দর্শককে বার্তা দিতে পারে। ‘আমেলি’-র ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক শব্দ আর কৃত্রিম সাউন্ড এফেক্ট এত দারুণ যে তাদেরকে প্রায় ছবির একটা চরিত্র বলা যায়। উপান্ত্য দৃশ্যে যখন আমেলি শেষ ও সম্পূর্ণবারের মতো তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সাক্ষাৎ পায়, শব্দ আর নীরবতা যৌথভাবে সেখানে চরিত্রদ্বয়ের মিলন আবেগ প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন আমেলি তাকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত দেয়, দর্শক একটা কৃত্রিম চুরমারের আওয়াজ শোনে। এটাই সর্বশেষ বিস্ফোরণ যার মধ্য দিয়ে তাদের চারপাশের বিচিত্র সব কলকাকলির ইতি ঘটে। সেইসব সাউন্ড এফেক্টের ইতি ঘটে যা তাদের জগতের অন্যান্য চরিত্রের ক্রিয়াকলাপ ও গতিবিধির ওপর জোর দিতে (কিছু ক্ষেত্রে আরো জোরালো করতে) ব্যবহার হচ্ছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যটিতে ভাঙচুরের আওয়াজের আগ মুহূর্তে শোনা গেছে দরজা বন্ধের আওয়াজ। এই শব্দটি অকৃত্রিম, অবর্ধিত, এবং ছবির দৃশ্যের সাথে মিলে এটি নায়িকার জন্য পরিসমাপ্তি বোঝায়। এই জুটি যখন চুম্বনের অদ্ভুত ক্রীড়ায় মাতে, তখনি হঠাৎ নীরবতা নেমে আসে, যেন আমেলি অবশেষে তার শব্দময় অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে শান্তিকে খুঁজে পেয়েছে। এই নীরবতা তাৎপর্যপূর্ণ ও লক্ষণীয় এই কারণে যে, এই প্রথম চলচ্চিত্রের কোথাও নিস্তরঙ্গ শব্দহীনতাকে ব্যবহার করা হয়েছে দর্শকের সাথে কথা বলার জন্য।
শব্দের পাশপাশি সঙ্গীতের মাধ্যমেও আমেলির জগতের বিস্ময়কে তুলে ধরা হয়েছে। কখনো কখনো দুঃখের অনুভূতি প্রকাশে বিষণ্ণ সুর বাজানো হলেও, ছবির সিংহভাগ অংশে শুনতে পাই মজাদার সুর, যেমনটা শোনা যায় মেলা কিংবা পার্বণে। নড়াচড়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এরকম বাজনা মিকি মাউসিং বলে পরিচিত। এই ছন্দ দারুণভাবে খাপ খেয়েছে নাম-চরিত্রের কৌতুহলী, কল্পনাপ্রবণ, অথচ সামাজিকভাবে অপটু ব্যক্তিত্বের সাথে। বেশ ঘন ঘন সঙ্গীতকে পাওয়া যাবে এই ছবিতে, যদিও তাকে কখনো বিভ্রান্তিকর বা উৎপীড়ক মনে হয় না, বরং ছবির প্রাকৃতিক বা অন্য যেকোন শব্দের ব্যবহারের সাথে এটি সংযোজক হিসেবে কাজ করে। যে দৃশ্যগুলোতে আমেলি মঙ্গলবার্তা ছড়িয়ে দেয়ার মহৎ উদ্দেশ্যে বের হয়, সেখানে তার ইতিবাচক ও অভিযাত্রীসুলভ মূলভাবের সাথে মিলে যায় হাসিখুশি আনন্দোৎসবের সুর।
মিজ-অঁ-সেন
'আমেলি'-র অসংস্কারকৃত ছবিগুলিতে লাল-সবুজের প্রাবল্যের বিপরীতে নীলের অনুপস্থিতি দেখলে যেন মনে হয় যেন দুই ফিতার পুরাতন পুরাতন টেকনিকালার পদ্ধতিতে দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেকোন একটি ফিল্মে উষ্ণ কমলা ফিল্টার যুক্ত করে দিলে তা অনেকটাই ‘আমেলি’-র রঙের কাছাকাছি হয়। এই ধরনের কালার কারেকশন সাহায্য করেছে ছবির ভাবকে লঘু করে রোমান্টিক কমেডি জনরার উপযুক্ত করতে।
যে শটে শহরের আনুভূমিক দৃশ্য দেখানো হয়, পোস্ট প্রোডাকশনে সম্পাদক সেখানে বহিঃস্থ কিছু উপাদান অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রযুক্ত লেখা দ্বারা পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে নিনো আর আমেলির বাসার অবস্থান বোঝানো হয়। এই ব্যাপারটা বিস্ময়কর যে তারা পরস্পর থেকে মাত্র ৫ মাইলের দূরত্বে ছিল। এই তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপারটি থেকে মনে হয় যেন একে অন্যের মুখোমুখি হওয়া তাদের অদৃষ্টেই ছিল। ছবির অন্যান্য অংশে পরিচালক বিভাজিত পর্দা ব্যবহার করেছেন সমান্তরতার উপাদান হিসেবে। সম্পাদক এই স্টাইলটি যুক্ত করেছেন দুইটি চরিত্রের মধ্যে মিল ও উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গতি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে।
স্থান এই ছবিতে খুবই কার্যকর। সমসাময়িক শৈল্পিক উপাদানের সাথে ফরাসি অ্যাকোর্ডিয়ন সঙ্গীত ও ফরাসি এলাকার মিশেল এক অদ্ভুত স্বর তৈরি করে। আমেলির সমসাময়িক মেয়েদের হিপস্টার পোশাক ছিল ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকের ফ্যাশনের পুনরুত্থান। এটি সম্পূর্ণ বিচ্যুত অথচ কিছুটা আত্মসচেতন খামখেয়ালিপনার ভাব তুলে ধরে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য সম্ভবত সেই রেল স্টেশন যেখানে আমেলি পরিশেষে নিনোর ছবি অ্যালবাম হাতে পায়। প্রকৃত ফরাসিদেশের দর্শন পেতে হলে যে জায়গায় যেতে হবে তার সমস্ত গুণাবলীই আছে এই জায়গার মধ্যে। একদিকে, লম্বা লম্বা সিঁড়ির ধাপ, ঝর্না, আর কাচের জানালার অনুপস্থিতি তৎকালীন স্থাপত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে, ক্যামেরার অগ্রসরতা, এবং চলচ্চিত্রের অনন্য সুরের কারণে পুরো দৃশ্যটাকে দেখায় উদ্ভটভাবে সাবেকি আমলের। এই দুইয়ের বৈসাদৃশ্য বা বৈপরীত্য দর্শনীয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন