ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র ‘সম্পাদনা’ নামক নিবন্ধে একে বলেছেন ছবির ‘সম্রাট’ বলেছেন। একইসাথে বলছেন এটি চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় খুঁটি। আইজেনস্টাইনের ‘দ্বন্দ্ব’ ও পুদোভকিনের ‘সমন্বয়’ প্রাচীন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এটিই চলচ্চিত্র সম্পাদনার ভিত্তি হয়ে রয়েছে। ঋত্বিকের মতে, ছবি তৈরি করতে গিয়ে যে কয়টি অস্ত্র নির্মাতার হাতে থাকে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে সম্পাদনা। ‘মন্তাজ’ শীর্ষক অপর এক নিবন্ধে ফিল্মকে বলছেন ‘অত্যন্ত মার্ক্সিস্ট ব্যাপার’। ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির সম্পাদনাতেও সেই একই মার্ক্সবাদী থিসিস অ্যান্টিথিসিসের দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট।
চিত্রগ্রাহক | দিলীপ রঞ্জন মুখার্জী |
---|---|
সম্পাদক | রমেশ যোশি |
মুক্তি |
|
দৈর্ঘ্য | ১৪৩ মিনিট |
দেশ | ভারত |
ভাষা | বাংলা |
ধারাবাহিকভাবে যদি বলা হয়, সুবর্ণরেখা শুরু হয় ফেড ইন দ্বারা। এরপর একটি দীর্ঘ শটে শিরোনাম ও কলাকুশলীদের নাম স্ক্রলে দেখানো হয়। পিছনে আবহ সঙ্গীত চলে। পটভূমি বলার জন্য ওই স্ক্রলটিকেই ব্যবহার করা হয় যেমনটা প্রচলন ছিল নির্বাক যুগের ছবিতে। পরবর্তীতেও ছবির অনেক স্থানেই দীর্ঘতর সময়ের ব্যবধান নির্দেশ করে ইন্টারটাইটেলের ব্যবহার দেখতে পাই। ক্রেডিট সিকোয়েন্স শেষ হলে দ্বিতীয়বার ফেড ইনের মাধ্যমে ছবির গল্প শুরু হয়। আগে শটের ফেড আউট এবং পরের শটের ফেড ইনের মাঝে ‘জে’ কাটের ব্যবহার দেখা যায়। যার অপর নাম সাউন্ড ব্রিজ। অর্থাৎ, মূল দৃশ্য দেখানর আগেই তার শব্দ আমরা শুনতে পাই। এর বিপরীত ‘এল’ কাটও দেখা যায়। যেমন, কলোনিতে “রাত্রে কোনো যুবক ঘুমাবেন না” এই সংলাপ বলার সময় পরের দৃশ্যাংশে হরপ্রসাদের স্ত্রী ও ছোট শিশুদের লো এঙ্গেল শট দেখা যায়।
একই দৃশ্যের মধ্যে দৃশ্যাংশ থেকে দৃশ্যাংশে যেতে সাধারণ কাট ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, হরপ্রসাদ বক্তৃতা শেষ করে বসার সময় ‘কাট ইন অ্যাকশন’ দেখতে পাই। কিন্তু দৃশ্য ও দৃশ্যপর্যায়ের পরিবর্তনে ঘন ঘন ডিজলভের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন, অভিরামের ঈশ্বরের কোলে মুখ রাখার দৃশ্য থেকে ক্রস ডিজলভ ব্যবহার করে রাতের কলোনির দৃশ্যে যাওয়া হয়। ছবিতে প্রথমবার সমান্তরাল অ্যাকশন দেখতে পাই যখন সীতা ও হরপ্রসাদের কথপোকথন কাট করে বাগদি বউ ও জনৈক শরণার্থীর মধ্যকার সংলাপ দেখানো হয়। জমিদারের গুণ্ডারা বাগদি বউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পুনরায় প্রথম শটে ফিরে যাওয়া হয়।
রিভার্স এঙ্গেল শটের বহুল ব্যবহার রয়েছে চলচ্চিত্রে, বিশেষত দুই চরিত্রের কথোপকথনের সময়। রিএকশন শটের সময়ও তাই। আবার, সীতাকে যখন তার ভাই পাত্রপক্ষের সামনে আসার জন্য ডাকছে, তখন সীতার ক্লোজ আপ থেকে ঈশ্বরের ওভার দ্য শোল্ডারে অভিনেত্রীর বসা অবস্থার মিড লং শট দেখানো হয়। এটিকে জুম আউটের মাধ্যমে দেখানোই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সম্পাদক তিনটি জাম্প কাটের মাধ্যমে দৃশ্যটি উপস্থাপন করলেন। ক্রস কাটিং-এর মাধ্যমে দেখানো পরের ছয়টি এঙ্গেল-রিভার্স এঙ্গেল শটের একটিতে মাত্র সংলাপ। মাঝে চলে সেতারের নন-ডায়াজেটিক বাজনা যার সাথে মিলে যায় একটি ডায়াজেটিক তান যখন সীতার কপাল তানপুরার ওপর পড়ে।
ছবির এই দৃশ্যে ওস্তাদ বাহাদির খানের যে সেতার বাজতে থাকে এটিই পুরো চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলির লেইটমোটিফ।
এই চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় এর অভিযাত্রীসুলভ সম্পাদনা রীতি। কিছু নির্মাতা আছেন যাদের সম্পাদনা চিত্রনাট্য তৈরির সময়ই সম্পন্ন হয়ে যায়। পূর্বপরিকল্পিত ছক অনুযায়ী শটের দৈর্ঘ্য, ধারাবাহিকতা, শৈলী মেনে চিত্রগ্রহণ করা হয়। আবার কিছু নির্মাতা আছেন যারা চিত্রনাট্যকে একটি গাইড-টু-অ্যাকশন হিসেবে ধরে নিয়ে খোলা মনে দৃশ্যধারণ করেন। তাদের ছবি তৈরি এমন একটি যাত্রা, যার বাঁকে বাঁকে থাকে নতুন আবিষ্কার। নির্মাণ-পরবর্তী সম্পাদকের টেবিলে যাবার আগ পর্যন্ত যার কিছুই স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকে না। যেমন, আলোচ্য ছবিতে শিশু নায়িকা ভাঙা এরোড্রামে বহুরূপীর মুখোমুখি হয়। বাংলা ছায়াছবির অন্যতম সেরা এই জাম্প কাটটি চিত্রনাট্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সম্পাদনার পর দেখা গেল, ছবির বিশাল গতিপ্রকৃতিকে অনেকখানিই বদলে দিয়েছে এই আকস্মিক সংযোজন। পরিচালকের নিজের ভাষ্যেই, একে ছাড়া ‘সুবর্ণরেখা’-কে ভাবা যায় না।
নির্মাতা ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজের প্রয়োগ করেছেন কয়েকবার। যেমন, মায়ের মৃত্যুতে অভিরামের চিৎকারের সাথে রেলগাড়ির ম্যাচ কাট এবং এই দুই শটের মাঝে দোদুল্যমান একটি শিশুকে দেখা যায়। সীতার বিয়ের শূন্য আসন দেখানর পরের দৃশ্যাংশেই দেখতে পাই সীতার বিয়ের মুকুট ভেসে যাচ্ছে সুবর্ণরেখার স্রোতে। যা সীতা-অভিরামের নব জীবনের অনিশ্চিত গতিপথের প্রতীক।
‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ব্যবহার করেছেন আশি ফুট দীর্ঘ ক্লোজ আপ। ক্লাইম্যাক্সে যখন ভাই তার বোনের কাছে যায়, তখন এই এক্সট্রিম ক্লোজ আপে সীতা তাকিয়ে থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকে প্যাট্রিসিয়া মিউজিকের অস্ফুট অনুরণন। ভারতীয় ছবিতে এত দীর্ঘ ক্লোজ আপ বিরল।
ছবির শেষ তৃতীয়াংশে উচ্চ কন্ট্রাস্টের আলোকসজ্জা দেখা যায়। বিশেষত অভ্যন্তরীণ দৃশ্যগুলোতে। এই ফিল্ম নোয়া স্টাইলের আলো অনেকটা সীতা অভির দৈন্যের সংসারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একইভাবে ক্যাইম্ল্যাক্টিক দৃশ্যের আলোও তাই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন